‘ম্যাজিক্যাল থিঙ্কিং’ বলে একটি শব্দবন্ধ রয়েছে মনোবিজ্ঞানে। যা বলে, মহান’ ব্যক্তির শরীরে রয়েছে ‘দেবত্ব’। সেই দেহাংশ নিজের করে নেওয়া মানে– ‘অমরত্ব’ পাওয়া, ‘পবিত্র’ হওয়া। সেজন্যই তো রবি ঠাকুরের শেষযাত্রায় চুল-দাড়ি উপড়ে নিয়েছিল বাঙালি। উত্তমকুমারের শেষযাত্রায় ছিল তঁাকে ছুঁতে চাওয়ার আকুতি। সদ্য যুবভারতীতে মেসির সংলগ্ন থেকে কিছু মানুষের সেল্ফি তোলার উন্মাদনা প্রমাণ করল– এখনও কত সংযমহীন আমরা! লিখছেন স্বাগতম দাস।
কলকাতার ইতিহাসে কিছু দিন আছে, যেগুলো শুধুই দিন নয়– বরং এই শহরের সমষ্টিগত মানসিকতার প্রতিচ্ছবি। ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুদিনটি ছিল এমনই একটি দিন। আবার, ১৯৮০ সালের ২৪ জুলাই, উত্তমকুমারের মৃত্যুর দিন, সেদিনও সেই দৃশ্য যেন ফের আর-একবার ফিরে এসেছিল। দু’টি ঘটনাই এই শহরের জটিল মানসিক গঠনতন্ত্রের প্রমাণ– যেখানে শ্রদ্ধা, ভালবাসা, আবেগ, আর আত্মপরিচয়ের আকাঙ্ক্ষা মিলেমিশে এক অদ্ভুত রূপ নেয়– যাকে একজন মনোবিজ্ঞানী বলতে পারেন ‘ভক্তিমিশ্রিত গণ-উন্মাদনা’।
রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর সেই দৃশ্য এখনও আমাদের সাংস্কৃতিক স্মৃতিতে জীবন্ত। যিনি ছিলেন জাতির আত্মা, সাহিত্য ও দর্শনের প্রতীক, তঁার মৃত্যুর পর মানুষ যেন নিজ-অন্তরে শূন্যতা অনুভব করেছিল। তাই তঁাকে শেষবার দেখতে চেয়ে রাস্তায়-রাস্তায় ভিড় জমল। নিমতলা শ্মশান পর্যন্ত রাস্তা ছিল অচল। মানুষ দলে-দলে ছুটে আসছিলেন– কেউ গাছের ডাল বেয়ে উঠছে, কেউ গেট ভেঙে ঢুকছে, কেউ তঁার মরদেহের ফুল ছুঁয়ে আশীর্বাদ নিচ্ছে। শোনা যায়, কেউ-কেউ আরও একধাপ এগিয়ে, তঁার চুল-দাড়ি ছিঁড়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন ‘পবিত্র স্মৃতি’ রূপে।
এখানেই জনতার মানসিকতার রহস্য। এই আচরণ কেবল অশিক্ষার ফল নয়, এটি এক গভীর প্রতীকী প্রবণতা– মানুষ মনে করে, ‘মহান’ ব্যক্তির শরীরে ‘দেবত্ব’ রয়েছে। তাই সেই দেহাংশ নিজের করে নেওয়া মানে– একটুখানি ‘অমরত্ব’ পাওয়া। এই প্রবণতাকে মনোবিজ্ঞানে বলা হয় ‘ম্যাজিক্যাল থিঙ্কিং’– অর্থাৎ বিশ্বাস যে, কোনও মহান ব্যক্তির স্পর্শে নিজের ভাগ্য বা আত্মা ‘পবিত্র’ হবে।
কিন্তু সেই আবেগ এতটাই বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল যে, রবীন্দ্রনাথের ছেলে রথীন্দ্রনাথ পর্যন্ত পৌঁছতে পারেননি চিতার কাছে– ভিড়ের চাপে আটকে পড়েছিলেন মাঝপথে। যখন দাহ শেষ হয়, তখনও ভিড় থামেনি– মানুষ ছুটে গিয়েছিল ছাই খোঁজার জন্য, কেউ হাড়ের টুকরো নিয়ে ফিরেছে ‘তাবিজ’ বানিয়ে রাখবে বলে। সেই দৃশ্যটিই সত্যজিৎ রায় তঁার তথ্যচিত্রে দেখিয়েছিলেন– রবীন্দ্রনাথের দেহ যেন ভাসছে মানুষের মাথার সমুদ্রে। সেটি কেবল এক অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া ছিল না, সেটি ছিল এক জাতির আবেগের বিস্ফোরণ, যেখানে শ্রদ্ধা আর উন্মাদনার সীমানা মিলেমিশে গিয়েছিল।
উনত্রিশ বছর পরে, ১৯৮০ সালে, যখন মারা গেলেন উত্তমকুমার– বাংলা সিনেমার ‘মহানায়ক’– তখনও কলকাতা যেন নিজের প্রিয় সন্তানকে হারিয়ে উন্মাদ। উত্তমকুমার কেবল একজন অভিনেতা নন; তিনি ছিলেন বাঙালির রোমান্টিক কল্পনার প্রতীক, এমন এক ‘নায়ক’, যিনি পর্দায় স্বপ্ন বিক্রি করতেন, আর পর্দার বাইরেও ছিলেন মানুষের প্রিয়তম মুখ। সেদিনের ভিড়ও ছিল অবিশ্বাস্য। বালিগঞ্জের বাড়ি থেকে কেওড়াতলা পর্যন্ত রাস্তা জুড়ে মানুষের ঢল। বিশেষ করে মহিলারা– যঁারা উত্তমকে দেবতার মতো দেখতেন– কঁাদছিলেন বুক ভেঙে। আকাশে ভেসে আসছিল স্লোগান: ‘গুরু তুমি ফিরে এসো!’ এ যেন শোকবার্তা নয়, এক আহ্বান, যেন মৃত্যুকে অস্বীকার করার শেষ চেষ্টা। তবে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর তুলনায় এই ঘটনায় কিছুটা সংযম ছিল। উত্তমের মরদেহ রাখা হয়েছিল ঢাকা গাড়িতে, যাতে মানুষ স্পর্শ করতে না পারে। পুলিশি নিয়ন্ত্রণও ছিল তুলনামূলক ভাল। ফলে শোক ছিল গভীর, কিন্তু বিশৃঙ্খলা সীমিত। তবুও, শহর থেমে গিয়েছিল। যান চলাচল বন্ধ, দোকানপাট বন্ধ– মানুষের চোখে একরকম শূন্যতা।
এই দুই ঘটনার মধ্যে চার দশকের ব্যবধান, কিন্তু জনতার আচরণে যে ‘মিল’, তা অবাক করে। মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে, এটি এক সমষ্টিগত প্রক্ষেপণ– মানুষ নিজের অপূর্ণতা, নিজের স্বপ্ন, নিজের অপ্রাপ্তি এক ‘মহান ব্যক্তি’-র মধ্যে স্থানান্তরিত করে। ফলে সেই ব্যক্তির মৃত্যু মানে নিজের ভিতরের একটি অংশের মৃত্যু। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন চিন্তার প্রতীক, উত্তম ছিলেন আবেগের; দু’জনেই ছিলেন ‘বাঙালি সত্তা’-র প্রতিরূপ। যখন এই সত্তা ভেঙে পড়ে, তখন শহরও যেন নিজের ভারসাম্য হারায়। এটাই গণ-শোক, যা প্রায়ই গণ-উন্মাদনার রূপ নেয়– এমন এক অবস্থা, যেখানে ব্যক্তি আর গোষ্ঠীর সীমা মুছে যায়। প্রত্যেকে ভাবে, ‘আমি যা করছি, সেটি অন্যরাও করছে’– পরিণতি– নিয়ন্ত্রণ হারায় সমাজ।
প্রশ্ন উঠতে পারে– এমনটা কেন শুধু ভারতে, বিশেষত কলকাতায়, দেখা যায়? ইউরোপে যখন কোনও মহাতারকা মারা যান, মানুষ ফুল রেখে যায়, নীরবে প্রার্থনা করে, কখনও দূর থেকে শ্রদ্ধা জানায়। সেখানে ‘শোক’ ব্যক্তিগত, কিন্তু সংযত। আমাদের এখানে তা সমষ্টিগত, প্রায় ধর্মীয় রূপে। কারণ, আমাদের সংস্কৃতিতে ‘ব্যক্তি’ নয়, ‘জনতা’-ই প্রধান সত্তা। ব্যক্তির অনুভূতি গোষ্ঠীর আবেগে মিশে যায়, আর সেই গোষ্ঠীর আবেগের সংযমের ক্ষমতা কম। তাছাড়া, পশ্চিমে আইনের চোখে সবাই সমান। তাই মানুষ জানে, শৃঙ্খলা ভাঙলে শাস্তি হবে। কিন্তু ভারতে মানুষ দেখে, প্রভাবশালীদের জন্য নিয়ম আলাদা। ফলে, তারা ভাবে– ‘যখন ওরা পারে, আমরাও পারি।’ এটাই সেই মানসিক প্রক্রিয়া, যা বিশৃঙ্খলাকে জন্ম দেয়।
এই মনোবৃত্তির ধারাবাহিকতা আমরা দেখলাম সদ্য, যুবভারতীতে, লিও মেসির আগমন ঘিরে। এক শতাব্দী পেরিয়েও আবেগের প্রকৃতি বদলায়নি– শুধু উপকরণ বদলেছে। এখন আর কেউ দেবতার দাড়ি বা চুল রাখে না, এখন সবাই চায় তারকার সঙ্গে সেল্ফি। সেই একই মনোভাব– নক্ষত্রের স্পর্শ পেলে জীবনের অর্থ যেন বেড়ে যাবে। মেসিকে ঘিরে যে-বিশৃঙ্খলা দেখা গেল– মাঠে ‘ভিভিআইপি’ ভিড়, সাধারণ দর্শকের বঞ্চনা, ধর্মীয় স্লোগান, চেয়ার ছোড়াছুড়ি– সবই আসলে সেই একই মানসিক প্রবণতার অন্য রূপ।
ভক্তি যখন নিয়ন্ত্রণ হারায়, তা হয়ে যায় প্রদর্শন। শ্রদ্ধা যখন প্রকাশের মাধ্যম খোঁজে, তখন তা বিকৃত হয়ে ওঠে। আগে মানুষ দেবতার মূর্তিতে ফুল দিত, এখন সেলিব্রেটিদের ইনস্টাগ্রাম পোস্টে ‘লাইক’ দেয়, ‘ফলো’ করে। গণমাধ্যম, বিজ্ঞাপন, ও সোশ্যাল মিডিয়া– সব মিলে সেলিব্রেটিকে অনাবৃত অথচ দর্শিত ঈশ্বরে পরিণত করেছে। মেসির মতো কেউ যখন বাস্তবে আসেন, তখন সেই দেবতার সাক্ষাৎ পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা জনতার ভেতরে তৈরি করে সম্মোহনের অঁাচ।
যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে যা ঘটল, তা শুধু এক প্রশাসনিক ব্যর্থতার গল্প নয়, এটি এক শহরের আত্মপরিচয়ের সংকটের প্রতিচ্ছবি। লিও মেসির আগমন ছিল আনন্দের, গর্বের; কিন্তু তা মুহূর্তেই পরিণত হল বিশৃঙ্খলার, লজ্জার, গভীর সামাজিক অস্থিরতার নিদর্শনে। ‘ভিভিআইপি’-দের সেল্ফি উন্মাদনা, মাঠে ঢুকে পড়া নেতা-মন্ত্রীদের ভিড়, ধর্মীয় স্লোগান, ভাঙচুর– সব মিলিয়ে মনে হচ্ছিল, আন্তর্জাতিক ফুটবলের ‘ইভেন্ট’ নয়, যেন এক বেসামাল লোকাল পাড়া ফাংশন চলছে।
মিনিটে-মিনিটে মেসিকে জড়িয়ে ধরে সেল্ফি তোলা হোমড়াচোমড়া ব্যক্তিরা যেভাবে মাঠ দখল করলেন, তা টিভির পর্দায় দেখা দর্শকদের কাছে ছিল এক জাতীয় লজ্জা। অথচ যঁারা ৫,০০০ থেকে ১৫,০০০ টাকা খরচ করে টিকিট কেটেছিলেন, তঁারা পেলেন কেবল জায়ান্ট স্ক্রিনে কয়েক মিনিটের ‘দর্শন’! ২০ টাকার খাবার জল সেদিন ২০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে, মাঠে চেয়ার ছোড়া, গেরুয়া পতাকা ও ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান– সব মিলিয়ে এক আন্তর্জাতিক ক্রীড়ামঞ্চে যা ঘটেছে, তা ভারতের ভাবমূর্তিকেই প্রশ্নের মুখে ফেলেছে।
এখনকার কলকাতায় ক্ষমতা, সেল্ফি আর প্রচারই সব। যঁারা টিকিট কেটে এসেছিলেন, তঁারা ছিলেন সাধারণ মানুষ– যঁাদের অনেকেই হয়তো এক মাসের বেতন দিয়ে মেসিকে দেখতে গিয়েছিলেন। কিন্তু মাঠে যঁারা ছুঁয়ে দেখলেন, তঁাদের টিকিট ছিল তো? আসলে তঁারা তো ‘ক্ষমতার আসনে বসা’ মানুষ। তাই জনতা ক্ষুব্ধ হয়েছিল, আর সেই ক্ষোভই মুহূর্তে রূপ নেয় হুল্লোড়ে। গুস্তাভ লে বঁ তঁার ‘দ্য ক্রাউড: আ স্টাডি অফ দ্য পপুলার মাইন্ড’ বইয়ে বলেছিলেন, ভিড়ের মধ্যে মানুষ যুক্তি হারায়, আবেগের দাসে পরিণত হয়। যুবভারতীর সেদিনের ভিড়ও যেন তা-ই। যে-মানুষরা মেসিকে দেবতার মতো দেখতে গিয়েছিলেন, তঁারা শেষে ক্ষোভে দেবমূর্তি ভাঙলেন।
তবু এই বিশৃঙ্খলার মাঝেও এক নিঃশব্দ সৌন্দর্য ছিলেন– মেসি স্বয়ং। তিনি হাসি মুখে সবকিছু সহ্য করলেন, কোনও বিরক্তি প্রকাশ করলেন না, অন্তত প্রকাশ্যে। তঁার মুখে ক্লান্তি নেই, চোখে শান্তি। যেন বলছেন– ‘তোমরা বিশৃঙ্খল, কিন্তু আমি খেলাটার মর্যাদা জানি।’ ভারত-ভ্রমণের যেসব ভিডিও পরে সমাজমাধ্যমে আপলোড করলেন, সেখান থেকে অবশ্য নিঃশব্দে সরিয়ে দিলেন কলকাতাকে। এ শহরের জন্য এটি এক শিক্ষা। ফুটবল কেবল খেলা নয়, এটি সংস্কৃতি। আর, ‘সংস্কৃতি’ মানে সংযম, মর্যাদা, শ্রদ্ধা। সেই সংস্কৃতির অভাবেই যুবভারতীর সেই দিনটি ইতিহাসে থেকে যাবে চরম এক লজ্জার দলিল রূপে।
(মতামত ব্যক্তিগত)
