shono
Advertisement
Mahatma Gandhi

গান্ধী কৌশলের আর প্রয়োজন নেই, বিকশিত ভারত তাই গান্ধী-হীন!

মহাত্মা গান্ধী কদাচ সংঘ ও বিজেপির চোখের মণি ছিলেন না।
Published By: Kishore GhoshPosted: 09:32 PM Dec 17, 2025Updated: 09:32 PM Dec 17, 2025

‘মনরেগা’-র নতুন নাম ‘বিকশিত ভারত গ্যারান্টি ফর রোজগার অ্যান্ড আজীবিকা মিশন (গ্রামীণ) বিল ২০২৫’। মহাত্মা গান্ধী কদাচ সংঘ ও বিজেপির চোখের মণি ছিলেন না। বরং তাঁর হত্যাকারী সংঘের প্রশ্রয় পেয়ে এসেছে। ক্ষমতায় এসে গান্ধীজিকে মোদি ব্যবহার করেছেন কৌশল হিসাবে। এখন সম্ভবত ভাবছেন, ওই কৌশলেরও আর প্রয়োজন নেই। কর্তৃত্ববাদী নার্সিসিস্টদের চরিত্র সব দেশে সবকালে এমনই হয়! লিখছেন সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়। 

Advertisement

মহাত্মা গান্ধী ও পূজ্য বাপু নিয়ে চারদিন তুমুল বিতর্কের পর সোমবার জানা গেল, ১০০ দিনের কাজের প্রকল্প ‘মনরেগা’ থেকে গান্ধীজিকে পুরোপুরি ছেঁটে ফেলছে নরেন্দ্র মোদি সরকার।
নতুন যে-বিল আসছে, তাতে ‘মহাত্মা গান্ধী’ নেই, ‘পূজ্য বাপু’-ও নন, আছেন ‘রাম’। এই বিলে রামচন্দ্র আপাতত বিরাজমান ‘জি রাম জি’ হিসাবে। প্রচারের জোরে ‘হিন্দুস্তান’-এ হয়তো অচিরেই তা ‘জয় রামজি’ হয়ে উঠবে।

‘মহাত্মা গান্ধী ন্যাশনাল রুরাল এমপ্লয়মেন্ট গ্যারান্টি স্কিম’, সংক্ষেপে ‘মনরেগা’, এবার পরিচিত হবে এই নামেই। নতুন বিলের পোশাকি নাম ‘বিকশিত ভারত গ্যারান্টি ফর রোজগার অ্যান্ড আজীবিকা মিশন (গ্রামীণ) বিল ২০২৫’।

লম্বা নামের ইংরেজি আদ্যক্ষর গুলো পাশাপাশি দাঁড় করালে হবে ‘ভিবি-জি রাম জি’।
২০ বছর আগে ২০০৫ সালে মনমোহন সিং সরকারের চালু করা এই গ্রামীণ কর্মসংস্থান প্রকল্পের নাম ছাড়াও বদল হচ্ছে অনেক কিছু। যেমন, ১০০ দিনের বদলে কাজ দেওয়া হবে ১২৫ দিন। ‘মনরেগা’-য় একশো ভাগ খরচ ছিল কেন্দ্রের। নতুন বিলের প্রস্তাব, যেসব কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে বিধানসভা নেই, সেখানে এই প্রকল্পের পুরো খরচ দেবে কেন্দ্র। উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলি, হিমালয় সংলগ্ন উত্তরাখণ্ড, হিমাচল প্রদেশ ও জম্মু-কাশ্মীর এবং বিধানসভা থাকা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলির খরচের ৯০ শতাংশ দেবে কেন্দ্র। বাকি সব রাজ্যে খরচের মাত্র ৬০ শতাংশ কেন্দ্রের। অর্থাৎ, গান্ধীজিকে ছেঁটে ফেলার পাশাপাশি রাজ্যগুলোর ঘাড়ে চাপছে ৪০ শতাংশ বাড়তি বোঝা।

চারদিন আগে প্রথম যখন শোনা গিয়েছিল ‘মনরেগা’-র নাম হচ্ছে ‘পূজ্য বাপু গ্রামীণ রোজগার গ্যারান্টি যোজনা’, তখন থেকেই ব্যাপক হইচই শুরু। কেউ কেউ ঠাট্টা করেছেন, রবি ঠাকুরের দেওয়া ‘মহাত্মা’ বিশেষণটি প্রধানমন্ত্রী সম্ভবত নিজের জন্য তুলে রাখছেন। ‘গান্ধী’-তে তঁার অ্যালার্জি আজন্ম। তাই ‘পূজ্য বাপু’-র আমদানি। এমন কটাক্ষও ভেসে এসেছে, পরমাত্মার ডায়রেক্ট নন বায়োলজিকাল সন্তান আগামী প্রজন্মের কাছে ‘মহাত্মা’ হতে চান। তাই ‘মনরেগা’ থেকে ‘মহাত্মা গান্ধী’ বাদ!

মহাত্মা গান্ধী কোনওকালেই সংঘ ও বিজেপির চোখের মণি ছিলেন না। বরং তঁার হত্যাকারী সংঘের প্রশ্রয় পেয়ে এসেছে। ক্ষমতায় এসে গান্ধীজিকে মোদি ব্যবহার করেছেন কৌশল হিসাবে। পৃথিবীর শতাধিক দেশে যঁার মূর্তি রয়েছে তঁাকে হুট করে অস্বীকার করা বোকামি হত। এখন সম্ভবত ভাবছেন, ওই কৌশলের আর প্রয়োজন নেই। কর্তৃত্ববাদী নার্সিসিস্টদের চরিত্র সব দেশে সব কালে এমনই হয়।

বিল নিয়ে আলোচনার সময় এসব কটাক্ষ মোদিকে শুনতে হবে। এও শুনতে হবে, ‘মনরেগা’ তুলে দেবেন মনস্থির করেও পিছিয়ে এসে ২০১৫ সালে কী বলেছিলেন। সংসদে কংগ্রেসের উদ্দেশে‌্য তাচ্ছিল্য ভরে বলেছিলেন, ‘আমার রাজনৈতিক বোধবুদ্ধি বলছে, মনরেগা বন্ধ করা উচিত হবে না। এই প্রকল্প আপনাদের ব্যর্থতার জীবন্ত স্মারক। স্বাধীনতার ৬০ বছর পরও আপনারা মানুষকে দিয়ে গর্ত খোঁড়াচ্ছেন।’ বিতর্ক চলাকালীন মোদির ওই মন্তব্য বিরোধীদের হাতিয়ার হবেই। শুনতে হবে, টানা ১১ বছর শাসনের পর জনগণকে দিয়ে তিনি আরও বেশি গর্ত খোঁড়াচ্ছেন। দেশের উন্নতিও এতটাই যে, ৮০ কোটি মানুষকে বছরভর বিনামূল্যে রেশন দিতে হচ্ছে।

‘মনরেগা’ নিয়ে মোদি কখনও খুশি ছিলেন না। অসন্তুষ্ট ছিলেন বলেই মনমোহন-সরকারের এই প্রকল্পকে তিনি কংগ্রেসের ‘ব্যর্থতার ইতিহাস’ বলে অভিহিত করেছিলেন। তঁার ধারণা, প্রকল্পের বুদ্ধি বাতলেছিলেন কংগ্রেসের বামপন্থী বন্ধু ও ‘ঝোলাওয়ালা উপদেষ্টা’রা। অথচ, কার্যত দেখা গিয়েছিল, নোটবন্দির পর কাজ হারানো গ্রামে ফেরা শ্রমিকদের রোজগারের একমাত্র উপায় হয়ে উঠেছিল মনরেগা। ২০১৯ সালের নির্বাচনের আগে মোদিকে যখন শুনতে হচ্ছিল ‘১০ কোটি চাকরি কোথায়?’, শ্রমমন্ত্রক তখন জানিয়েছিল, মনরেগা বছরে ২৩৫ কোটি শ্রম দিবস তৈরি করেছে। কোভিডের সময়েও গ্রামীণ রোজগারের ক্ষেত্রে এই প্রকল্পই হয়েছিল মুশকিল আসান। কিন্তু ২০২১ সাল থেকেই মোদির চোখে মনরেগা দুয়োরানির সন্তান। বরাদ্দ ১ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকা থেকে কমতে কমতে ৮৫ হাজার কোটিতে দঁাড়িয়েছে। রাজ্যগুলি তীর্থের কাকের মতো বসে আছে পাওনার জন্য। কোটি কোটি টাকা অনাদায়ী। শুধু পশ্চিমবঙ্গেরই পাওনা ৩ হাজার ৭০০ কোটি (কেন্দ্রীয় হিসাবে)। এবার চাপতে চলেছে মোট খরচের ৪০ শতাংশ।

মোদির রাজনীতি চিরকালই চমক ও প্রচার নির্ভর। আত্মপ্রচারে মোদি সরকার ২০১৪ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত কত খরচ করেছে সেই হিসাব ২০২২ সালে লোকসভায় জানিয়েছিলেন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর। আট বছরে শুধু প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় সরকার বিজ্ঞাপন দিয়েছে ৬ হাজার ৪৯১ কোটি টাকার! এর বাইরে ছিল নানা ধরনের আউটডোর পাবলিসিটি, রেডিও ও সিনেমা হলে বিজ্ঞাপনের খরচ। বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক বিজ্ঞাপন বাবদ কীভাবে সরকারের গুণগান করেছে, সেই হিসাব মন্ত্রী দেননি। তুলনায় কংগ্রেসের দশ বছরের শাসন? আরটিআই জানিয়েছে, ২০০৪ থেকে ২০১৪, ১০ বছরে ইউপিএ সরকার বিজ্ঞাপন বাবদ খরচ করেছিল ২ হাজার ৬৫৮ কোটি।

প্রচারের এই বহরের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে মোদির চমকের রাজনীতি। মনরেগা-র জায়গা ‘জি রাম জি’ নিলে সেটাও হবে নতুন বোতলে পুরনো মদ পরিবেশন। ১১টি বছর ধরে মোদি এটাই করে চলেছেন। কংগ্রেস আমলে চালু করা প্রকল্পের নাম বদলে এমন একটা ভাব দেখাচ্ছেন যেন আইডিয়ার উৎস তঁারই উর্বর মস্তিষ্ক। তিনিই স্রষ্টা! উদাহরণ চাই? একটা দুটো নয়, ডজনখানেক দেওয়া যাবে।

১) ২০০৯ সালে মনমোহন সরকার চালু করেছিল ‘নির্মল ভারত অভিযান’। গান্ধীজির
চশমা জুড়ে মোদি তার নাম দিয়েছেন ‘স্বচ্ছ ভারত অভিযান’।
২) ২০০৫ সালে চালু ‘নো ফ্রিল্‌স’ বা ‘জিরো ব্যালান্স’ অ্যাকাউন্টের নাম ২০১২ সালে মনমোহন সিং বদলে করেছিলেন ‘বেসিক সেভিংস ব্যাঙ্ক ডিপোজিট অ্যাকাউন্ট’। নাম পাল্টে সেটাই মোদির ‘প্রধানমন্ত্রী জন-ধন যোজনা’।
৩) ২০১০ সালের ‘স্বাবলম্বন যোজনা’ নাম পাল্টে হয়েছে ‘অটল পেনশন যোজনা’।
৪) ২০০৬ সালে মনমোহন সিং চালু করেছিলেন ‘ন্যাশনাল ই-গভর্নন্যান্স প্ল্যান’। উদ্দেশ্য, ডিজিটাল মাধ্যমে সব সরকারি পরিষেবা পৌঁছে দেওয়া। মোদির ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া’ সেটাই।
৫) রাজীব গান্ধী প্রধানমন্ত্রী হয়ে ১৯৮৫ সালে চালু করেছিলেন ‘ইন্দিরা আবাস যোজনা’। দারিদ্রসীমার নিচে থাকা গ্রামীণ মানুষদের জন্য পাকা ঘর তৈরির প্রকল্প। মনমোহন সিং ২০১১ সালে শহুরে দরিদ্রদের জন্য চালু করেছিলেন ‘রাজীব আবাস যোজনা’। মোদি ২০১৬ সালে
এই দুই পৃথক প্রকল্পকে এক করে চালু করেন ‘প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা’।
৬) ‘রাজীব গান্ধী গ্রামীণ বিদ্যুতিকরণ যোজনা’ নাম বদলে হয়েছে ‘দীনদয়াল উপাধ্যায় গ্রাম
জ্যোতি যোজনা’।
৭) শহরের নাগরিক পরিষেবার উন্নতিতে ‘জওহরলাল নেহরু ন্যাশনাল আর্বান রিনিউয়াল মিশন’ প্রকল্প চালু হয়েছিল ২০০৫ সালে। মোদি সেটার নাম বদলে করেছেন ‘অটল মিশন
ফর রেজুভিনেশন অ্যান্ড আর্বান ট্রান্সফরমেশন’, যার লক্ষ্য স্মার্ট সিটি তৈরি।
৮) ২০১১ সালের ‘ন্যাশনাল ম্যানুফ্যাকচারিং পলিসি’ মোদি জমানার ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’।
৯) ‘ইউনিভার্সাল ইমিউনাইজেশন প্রোগ্রাম’ নাম বদলে হয়েছে ‘মিশন ইন্দ্রধনুষ’।
১০) ‘ন্যাশনাল এগ্রিকালচারাল ইনশিওরেন্স স্কিম’ হয়েছে ‘প্রধানমন্ত্রী ফসল বিমা যোজনা’।
১১) ‘ন্যাশনাল আর্বান লাইভলিহুড মিশন’ আজকের ‘দীনদয়াল অন্ত্যোদয় যোজনা’।
১২) গ্রামে গ্রামে ব্রডব্যান্ড সংযোগ পৌঁছে দিতে মনমোহন সিং ২০১১ সালে চালু করেছিলেন ‘ন্যাশনাল অপটিক্যাল ফাইবার নেটওয়ার্ক’। ২০১৫ সালে মোদি সেটারই নাম দেন ‘ভারত নেট প্রকল্প’।
১৩) ‘জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন মিশন’ হয়েছে ‘স্কিল ইন্ডিয়া’।
১৪) ‘জাতীয় কন্যা শিশু দিবস কর্মসূচি’ মোদির ‘বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও’। কত বলব?
‘জি রাম জি’ এই তালিকার সর্বশেষ সংযোজন। স্বামীজি বলেছিলেন, চালাকির দ্বারা মহৎ কাজ হয় না। তবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়ে দিব্যি টিকে থাকা যায়।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

হাইলাইটস

Highlights Heading
  • লম্বা নামের ইংরেজি আদ্যক্ষর গুলো পাশাপাশি দাঁড় করালে হবে ‘ভিবি-জি রাম জি’।
  • প্রচারের এই বহরের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে মোদির চমকের রাজনীতি।
  • মোদির রাজনীতি চিরকালই চমক ও প্রচার নির্ভর।
Advertisement