ডলারের সাপেক্ষে টাকার মূল্য ৯০-এর গণ্ডি ছাড়িয়ে গেল। এর আগে ‘রুপি’ কখনও এতটা দুর্বল হয়নি। চলতি বছরে টাকার ৪.৮ শতাংশ অবমূল্যায়ন ভারতীয় মুদ্রাকে ‘এশিয়ার দুর্বলতম মুদ্রা’-র আখ্যা দিয়েছে। ভারত-মার্কিন বাণিজ্যচুক্তির অনিশ্চয়তা, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের ভারতীয় স্টক এবং ঋণ বাজার থেকে ক্রমাগতভাবে অর্থ তুলে নেওয়া– কারণ একাধিক। লিখছেন গৌতম সরকার।
একদিকে মোট উৎপাদনের অঙ্কে বিশ্ব অর্থনীতিতে চতুর্থ থেকে কয়েক দিনের মধ্যেই তৃতীয় বৃহত্তম হতে চলেছে, শক্তিসূচকে আমেরিকা ও চিনের পর তৃতীয় বৃহত্তম শক্তিশালী দেশের তকমা পেয়ে গিয়েছে; অন্যদিকে ‘মানব উন্নয়ন সূচক’ থেকে শুরু করে, ‘বিশ্ব সুখ সূচক’, ‘বিশ্ব ক্ষুধা সূচক’, ‘লিঙ্গ বৈষম্য সূচক’ ইত্যাদিতে ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে– এই তো এখনকার ভারত! এবার সেই কঁাটার মুকুটে নবতম সংযোজন– ডলারের সাপেক্ষে টাকার মূল্য ৯০-এর গণ্ডি ছাড়িয়ে যাওয়া। এর আগে ‘রুপি’ কখনও এতটা দুর্বল হয়নি। চলতি বছরে টাকার ৪.৮ শতাংশ অবমূল্যায়ন ভারতীয় মুদ্রাকে ‘এশিয়ার দুর্বলতম মুদ্রা’-র আখ্যা দিয়েছে।
ডলারের সাপেক্ষে ভারতীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন রাজনৈতিকভাবে বুমেরাং হয়ে ফিরেছে প্রধানমন্ত্রীর দিকে। বিরোধীরা মনে করিয়ে দিচ্ছে– ইউপিএ জমানায় যখন ডলার ৬০ টাকা ছুঁয়েছিল, তখন তার সবচেয়ে বড় সমালোচক ছিলেন গুজরাতের তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদি। এখন তঁার জমানাতেই রুপির এই লজ্জাজনক পতন। অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা টাকার দামের এই লাগাতার পতনের নেপথ্যে কিছু কার্যকারণ খুঁজে পেয়েছেন–
এক) ভারত-মার্কিন বাণিজ্য চুক্তি: দীর্ঘমেয়াদি অনিশ্চয়তা ও বারবার চুক্তির দিন পিছিয়ে যাওয়ার কারণে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ভারতের ভবিষ্যৎ প্রশ্নচিহ্নের মুখে পড়েছে। দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এদেশে বিনিয়োগে ভরসা হারাচ্ছে। এছাড়া ৫০ শতাংশ আমদানি শুল্কের জেরে মার্কিন বাজারে ভারতের রফতানি ২৮ শতাংশ কমে ৬.৩ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে। গত অক্টোবর মাসে ভারতের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল রেকর্ড ৪১.৭ বিলিয়ন ডলার।
দুই) বৈদেশিক বিনিয়োগ: বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ভারতীয় স্টক এবং ঋণ বাজার থেকে ক্রমাগতভাবে অর্থ তুলে নিচ্ছে। চলতি বছরেই ভারতীয় বাজারে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের ‘নিট শেয়ার’ বিক্রির পরিমাণ ছিল প্রায় ১৭ বিলিয়ন ডলার। ডিসেম্বরের প্রথম দুই ট্রেডিং সেশনে ফরেন পোর্টফোলিও ইনভেস্টমেন্ট তুলে নেওয়া হয়েছে ৪,৩৩৫ কোটি টাকা, চলতি বছরে বিদেশি মূলধনের মোট বহির্গমন ঘটেছে ১.৪৮ লক্ষ কোটি টাকা। প্রাইভেট ইক্যুয়িটি এবং ভেঞ্চার ফার্মসমূহ তাদের বিনিয়োগ নগদে তুলে নেওয়ায় ডলারের নিট বহিঃপ্রবাহ অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে। এই সবকিছুর সম্মিলিত ফল– ভারতীয় মুদ্রার রেকর্ড অধঃপতন।
তিন) সোনা আমদানি বৃদ্ধি: বিদেশ থেকে সোনার আমদানি দিন দিন বাড়ছে। অক্টোবর মাসে সোনার আমদানি বৃদ্ধি পেয়ে ১৪.৭ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। এর ফলে ডলারের চাহিদা প্রভূত পরিমাণে বেড়েছে, এবং ডলারের মূল্য ক্রমাগতভাবে বাড়ছে।
চার) নিরাপদ মুদ্রার খোঁজে: বিশ্ব অর্থনীতির এই টালমাটাল সময়ে বিনিয়োগকারীরা মার্কিন ডলারকে ‘নিরাপদ আশ্রয়’ বা ‘সেফ হেভেন’ মুদ্রা রূপে বিবেচনা করছে। এছাড়া মার্কিন বন্ডের উপর সুদের হার বাড়ার ফলে বিনিয়োগকারীরা ভারত থেকে অর্থ তুলে নিয়ে ডলারে বিনিয়োগে উৎসাহী হয়ে উঠেছে, এর ফলে ডলার দিন দিন শক্তিশালী হয়ে উঠছে।
পঁাচ) রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের ডলার ক্রয়: রুপির রেকর্ড অবনমনের আশঙ্কা করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি ডলার কেনার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছে। এই অতিরিক্ত চাহিদা রাতারাতি ডলারের মূল্য ৯০ পার করে দিয়েছে। টাকার দামের এই হ্রাস আমজনতার দৈনন্দিন জীবনযাপনে প্রভাব ফেলেছে।
যেমন– এক) আমদানি ব্যয়বহুল হয়ে পড়েছে। যেসব জিনিস ডলারের মূল্যে বাইরের দেশ থেকে আমদানি করা হয়– মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, টিভি, রেফ্রিজারেটর, এসি, ওষুধ, চিকিৎসার যন্ত্রপাতি ও বিভিন্ন ছোটখাট গ্যাজেট– সবেরই দাম বেড়ে যাবে। দুই) মুদ্রাস্ফীতির সৃষ্টি হবে। টাকার অবমূল্যায়নের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি– আমদানি মুদ্রাস্ফীতি, যার ফলে জীবনযাত্রার ব্যয় যাবে বেড়ে। স্থির-আয় বিশিষ্ট পরিবারের সঞ্চয়ে হাত পড়বে, যার ফলে আগামী দিনে বিনিয়োগ কমতে পারে।
তিন) বিদেশে পড়াশোনা এবং বেড়ানোর খরচ বাড়বে। যেসব ছেলেমেয়ে বিদেশে পড়াশোনা করছে– টাকার অঙ্কে তঁাদের খরচ অনেকটাই বেড়ে যাবে। ডলার শক্তিশালী হয়ে যাওয়ায় এখন টাকার অঙ্কে টিউশন ফি, থাকা-খাওয়ার খরচ, এবং রেমিট্যান্স বাবদ খরচ সবকিছুই বেশি বেশি-দিতে হবে। বিদেশ ভ্রমণের ক্ষেত্রেও হোটেল খরচ, পরিবহন, এন্ট্রি ফি, মার্কেটিং– সবই পর্যটকদের কাছে ব্যয়বহুল হয়ে উঠবে। চার) পেট্রোলিয়াম তেলের দাম বৃদ্ধি। এই মুহূর্তে খনিজ তেলের মোট চাহিদার ৯০ শতাংশ মেটানো হয় আমদানিকৃত তেল দিয়ে। ডলারের দাম বৃদ্ধির ফলে পেট্রল, ডিজেল ও রান্নার গ্যাসের দাম বৃদ্ধি পাবে। এর ফলে পরিবহণ খরচ বৃদ্ধি পাবে, এবং সেই বর্ধিত দামের ক্রম-প্রভাবের জেরে নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রতিটি দ্রব্যের পাইকারি মূল্য বৃদ্ধি পাবে। এর অর্থ: রুপির অবমূল্যায়ন সমগ্র অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতির একটি শৃঙ্খল প্রতিক্রিয়া ঘটাবে। পঁাচ) চাকরিতে নিশ্চয়তা কমবে। বেশিরভাগ শিল্পেই আমদানিকৃত উপাদান এবং যন্ত্র ব্যবহৃত হয়। ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় এই সমস্ত প্রতিষ্ঠান ব্যয়-বৃদ্ধিজনিত মুদ্রাস্ফীতির সম্মুখীন হবে। লাভের অঙ্ক কমে যাওয়ায় তারা এখন সম্প্রসারণের পথে হঁাটবে না, উল্টে নিয়োগ হ্রাস, শ্রমিকদের সুযোগসুবিধার ছঁাটকাট, মজুরি বৃদ্ধির ধীরগতি, এমনকী শ্রমিক ছঁাটাইয়ের মতো রাস্তায় হঁাটবে। এসবই চাকরির বাজারে অনিশ্চয়তা, এবং শ্রমিকদের মজুরিতে বিরূপ প্রভাব ফেলবে। ছয়) শেয়ার বাজারে প্রভাব। রুপির পতন শেয়ার বাজারে আতঙ্কের সৃষ্টি করছে। ১০ ডিসেম্বর, যেদিন ডলারের মূল্য ৯০ ছুঁল, সকাল থেকেই স্টক মার্কেটের দুই বেঞ্চমার্ক ইনডেক্স ডাউন ছিল। ‘নিফটি ৫০’ ১১৯ পয়েন্ট অর্থাৎ ০.৪৬ শতাংশ কমেছে। এই হ্রাসের জেরে এই সূচকের মান ২৬ হাজারের নীচে নেমে যায়। অন্যদিকে ‘সেনসেক্স’ কমেছে ৩১৭ পয়েন্ট (০.৩৭ শতাংশ)। শুধুমাত্র ‘নিফটি আইটি সেক্টরাল ইনডেক্স’ এই বাজারে বেড়েছে ০.২০ শতাংশ।
বিদেশি মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারণের দু’টি পদ্ধতি আছে। স্থির বিনিময় হার, আর পরিবর্তনশীল বিনিময় হার। প্রথমটিতে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক ‘হার’ স্থির করে, কোনও কারণে ডলারের মূল্য বাড়লে বা কমলে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক প্রয়োজনীয় ডলার বিক্রি বা কিনে এক্সচেঞ্জ রেটকে আগের জায়গায় রাখে। অন্যদিকে, পরিবর্তনশীল হারের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের ভূমিকা নেই, বাজারের চাহিদা-জোগানের ঘাত-প্রতিঘাত রুপি-ডলারের বিনিময় মূল্য স্থির করে। সেক্ষেত্রে ডলারের চাহিদা বাড়লে ডলারের দাম বাড়ে, ঠিক এখন যেটা ঘটছে এবং রিজার্ভ ব্যাঙ্ক কোনও দায়ভার নিচ্ছে না। বিশেষজ্ঞের একাংশের মতে, এই মুহূর্তে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের খাতে জমা বিপুল বিদেশি মুদ্রার সম্ভারই (৬৯০ বিলিয়ন ডলার) নিস্পৃহতার অন্যতম প্রধান কারণ।
বিষয়টি কিন্তু এতটাও সহজ-সরল নয়। মনে রাখতে হবে, ২০২২ সালে ডলারের শক্তিশালী হওয়ার কারণে অনেক মুদ্রার সঙ্গে টাকার অবমূল্যায়ন ঘটেছিল, এবারে ডলার কিন্তু পুরোপুরি স্থিতিশীল এবং টাকার কমজোরি হয়ে পড়ার কারণেই ডলারের আপেক্ষিক দরের বৃদ্ধি ঘটেছে। এই ঘটনাকে বিশেষ উদ্বেগপূর্ণ না ভেবে নিশ্চিত হয়ে বসে থাকলে আগামী দিনে বিদেশি মুদ্রার স্টকে বড়সড় ধাক্কা আসতে পারে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, ভারতীয় অর্থনীতি দাঁড়িয়ে আছে বাজারের উপর, আর সেই বাজারের সিংহভাগই শাসন করে বিদেশি মূলধন। তাই বিদেশি বিনিয়োগকারীরা মুখ ফিরিয়ে নিলে মেদ-মাংস সরে গিয়ে অর্থনীতির কঙ্কালটাই না প্রকট হয়ে পড়ে। এ-কথাটা তো মিথ্যে নয় যে, দেশীয় মূলধন-নির্ভর শিল্পস্থাপন এখন অলীক স্বপ্ন!
(মতামত নিজস্ব)
