প্যালেস্টাইনের ‘হামাস’ সংগঠনটি সন্ত্রাসে বিশ্বাসী। ইজরায়েলে ঢুকে নিরীহ মানুষদের হত্যা করেছে। আমরা কেন তা সমর্থন করব? আবার, ইজরায়েলের উগ্র আক্রমণের রণনীতিকে সমর্থন করা মানে প্যালেস্টাইনের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব পোষণ করা। কোনও পক্ষে না-ঝুঁকে ভারত কি পারে না নিরপেক্ষ অবস্থান নিতে? কলমে জয়ন্ত ঘোষাল
প্রণব মুখোপাধ্যায় তখন রাষ্ট্রপতি, নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী। ইজরায়েল সফরের কর্মসূচি তৈরি করে পাঠানো হল প্রণববাবুর কাছে। তিনি দেখলেন, সেখানে প্যালেস্টাইন নেই। বললেন, যদি আমাকে প্যালেস্টাইনে নিয়ে যাওয়া না হয়, তাহলে ইজরায়েল যাব না।
নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হলেন ২০১৪ সালে। ২০১৫ সালে ইজরায়েল সরকার পাঁচ জন সাংবাদিকের একটি প্রতিনিধি দলকে তাদের দেশে আমন্ত্রণ জানায়। সেই দলের সদস্য হয়ে সেবার তেল আভিভ থেকে জেরুজালেম- বেশ কিছু দিন ঘুরেছিলাম। ইজরায়েল দেশটিকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল। সেখানকার সরকার আমাদের গাজা সীমান্ত পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিল। গাজা এবং প্যালেস্টাইন এলাকার বাসিন্দারা কীভাবে জীবন নির্বাহ করছে, দেখেছিলাম। সরকার পক্ষ মূলত দেখাতে চাইছিল, এলাকা কেমন শান্তিপূর্ণ! যদিও ইজরায়েলের সেনা চারদিকে টহলরত ছিল। শান্তি স্থাপিত হলে মিলিটারি বুটের কুচকাওকাজের কি দরকার পড়ে? দেখেছিলাম বিশাল বিশাল ট্রাক- বিভিন্ন দেশ তো বটেই এমনকী রাষ্ট্রসংঘও শুকনো খাবারের প্যাকেট, বনস্পতি তেল-সহ অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় ভোজ্যদ্রব্য সরবরাহ করছে স্থানীয়দের জন্য। ’১৫-র সেই দৃশ্যপট মনে করলে এখন মনে হয়- তা ছিল অলীক বাস্তব। এখন গাজায় শুধুই বোমাবর্ষণের শব্দ!
[আরও পড়ুন: পূজারি যোগ্য হলে লক্ষ্মী ও সরস্বতীর একত্র আরাধনা সম্ভব, প্রমাণ করেছিলেন বিদ্যাসাগর]
সকালে দিল্লির চিত্তরঞ্জন পার্কে আড্ডা হয়। সেখানেও এখন ইজরায়েল এবং প্যালেস্তাইন সম্পর্ক নিয়ে রাজা-উজির মারা চলছে। কারও মতে, ইজরায়েল ঠিক করেছে। হামাস তো প্রথম আক্রমণ করেছিল। ইজরায়েল পাল্টা দিচ্ছে মাত্র। কারও মতে, সন্ত্রাস-দমনের নামে ইজরায়েল যথেচ্ছাচার চালাচ্ছে। প্রবল যুদ্ধনীতি কি সন্ত্রাসী-নির্মূলের টোটকা হতে পারে?
কেউ-বা প্রশ্ন তুলল- ইজরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা ‘মোসাদ’ তো বিশ্বের অন্যতম সেরা। তারা কেন টেরই পেল না হামাস আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে? আমি শ্রোতা, সব-ই শুনলাম। পরে একজন গোয়েন্দাকর্তার সঙ্গে কথা হওয়ার সময় তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম- ‘মোসাদ’ কেন কোনও আগাম ইনটেল দিতে পারেনি? গোয়েন্দাপ্রবর হেসে বলে- যতই আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহৃত হোক না কেন, কুয়াশার মধ্যে এরোপ্লেন ল্যান্ডিংয়ের সময় ভিজিবিলিটি প্রায় ‘জিরো’-য় নেমে আসে। তেমনই গোয়েন্দারা যত আধুনিক এবং প্রখর রুদ্র হোক না কেন, তাঁরা অব্যর্থ সব কাজে- এমন হলফ করে বলা যায় না।
ইজরায়েল যুদ্ধ-সম্ভূত দেশ। ছোট ভূখণ্ড, অথচ পাশের অন্য রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে তাদের বছরের পর বছর ধরে যুদ্ধ-সম্পর্ক। জর্ডন, সিরিয়া, পশ্চিম এশিয়া- দীর্ঘ অশান্ত ইতিহাস। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে ইজরায়েলের প্রত্যেককে সামরিক প্রশিক্ষণ নিতে হয়। মুসলমান জনসমাজ, যারা ইজরায়েলের নাগরিক হিসাবে নিজেদের পরিচয় দেয়, তারাও সাংবিধানিকভাবে সংশ্লিষ্ট প্রশিক্ষণ নিতে বাধ্য। বোরখা পরিহিত মহিলা বা যারা মাদ্রাসায় পড়াশোনা করে, তারা সরাসরি সামরিক প্রশিক্ষণ নিতে আপত্তি তুললে, অন্য উপায় রয়েছে। তাদের সেনা হাসপাতালে নার্সের ট্রেনিং দেওয়া হয়। কিন্তু নার্সিংয়ের পাশাপাশি রিভলবার চালানোও শিখিয়ে দেওয়া হয়। সব মিলিয়ে ইজরায়েলের মানুষের শারীরিক গঠন-শৃঙ্খলা অতুলনীয়। ৩০ বছর দিল্লিতে ইজরায়েল দূতাবাসের কর্মীদের দেখছি, তাঁদের সঙ্গে মিশেছি। এমন কাউকে দেখিনি যিনিস্বাস্থ্য-সচেতন নন।
ইজরায়েলের মানুষের মধ্যে জাতীয়তাবাদী আবেগ এখন একশো ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে ফুটছে। সেই সুযোগে টলমলে ইজরায়েলের শাসক পক্ষ অনেকটা পুলওয়ামা স্টাইলে কোর্টে গিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে চাইছে। অনেকটা আমাদের এখানকার মতো সে-দেশেও মেরুকরণের রাজনীতি। ভারতের হিন্দুত্ববাদী দল/ সংগঠন (যেমন, বিজেপি ও আরএসএস) বরাবর ইজরায়েলের পক্ষে- যারা ইসলামিক ‘সন্ত্রাসবাদী’ সংগঠন হামাসের বিনাশ চায়। অন্যদিকে, কমিউনিস্টরা বরাবর প্যালেস্তিনীয়দের পক্ষে। জ্যোতি বসু অবশ্য কমিউনিস্ট নেতা হয়েও মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে ইজরায়েলে গিয়েছিলেন। কংগ্রেসও প্যালেস্তিনীয় আন্দোলনের দীর্ঘদিনের সমর্থক।
প্রণব মুখোপাধ্যায় তখন রাষ্ট্রপতি, নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী। ইজরায়েল সফরের কর্মসূচি তৈরি করে পাঠানো হল প্রণববাবুর কাছে। তিনি দেখলেন, সেখানে প্যালেস্তাইন নেই। বললেন, যদি আমাকে প্যালেস্তাইনে নিয়ে যাওয়া না হয়, তাহলে ইজরায়েল যাব না। যদিও আমি রাষ্ট্রপতি, কিন্তু দীর্ঘদিনের কংগ্রেসের মতাদর্শ আমার রক্তে। ফলে ইজরায়েলের সঙ্গে মোদি সরকারের কথা হয়। ইজরায়েল জানায়, তাদের আপত্তি নেই। কেননা, তত দিনে জর্ডন এবং প্যালেস্টাইনের সঙ্গে চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে। প্রণববাবু গেলেন।
তবে মোদি সরকারের আমলে ইজরায়েলের সঙ্গে বন্ধুত্ব অন্য মাত্রা পায়। সুষমা স্বরাজ, রাজনাথ সিংয়ের মতো একের-পর-এক নেতা সেদেশে গিয়েছেন; গিয়েছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী আমাদের দেশে এসেছেন। এখনও ভারত-ইজরায়েল মৈত্রী মজবুত। আমরা ইজরায়েলের কাছ থেকে প্রতিরক্ষা খাতে অনেক সাহায্য পাচ্ছি। জল, পরিবেশ নানা ক্ষেত্রে ইজরায়েলের প্রযুক্তি ব্যবহার করছি। কৃষিতেও তাদের প্রযুক্তি ব্যবহার করে অভূতপূর্ব সাফল্য এসেছে। এমনকী, ইজরায়েলি প্রযুক্তি ধার করে টেলিফোনে আড়ি পাতার যন্ত্রপাতি কিনেছি- এমন অভিযোগও সংসদে উত্থাপিত হয়েছিল।
‘ডান্ডা দিয়ে ঠান্ডা’ করার রণকৌশল তাহলে ঠিক না ভুল- এই প্রশ্নটিও আলোচনায় আসবে বইকি! হিংসা দিয়ে সন্ত্রাস-দমন হয় কি? ‘অপারেশন ব্লু স্টার’ করে ইন্দিরা গান্ধী ভেবেছিলেন- পাঞ্জাব শান্ত হয়ে যাবে। অথচ এত বছর পরেও কানাডা-কাণ্ড বুঝিয়ে দিল- পাঞ্জাবের বিচ্ছিন্নতা-বোধ শমিত হয়নি পুরোপুরি। খালিস্তানের পক্ষে পাঞ্জাবের স্থানীয় সমর্থন আছে, টের পাওয়া যাচ্ছে। লন্ডনের গুরুদ্বারেও ভারতের হাই কমিশনারকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। কানাডার কথা না-হয় বাদই দিলাম! ফলে আমরা আন্দাজ করতে পারি- ভারতে যেমন কাশ্মীর থেকে খালিস্তান, মাওবাদী থেকে উত্তর-পূর্বের সন্ত্রাসকে মিলিটারি-নীতির মাধ্যমে নির্মূল করা যাচ্ছে না- অনর্গল আলোচনার ভিতর আমাদের দিয়েই সমাধানে আসতে হবে- ঠিক এই কথাটি ইজরায়েলের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। প্যালেস্টাইনের সঙ্গে আলোচনা প্রক্রিয়ায় গিয়ে সন্ত্রাসমুক্তির পথে এগনো উচিত তাদের।
অবশ্য সবসময় তা হয়ও না। ’১৪-য় ক্ষমতায় এসে নরেন্দ্র মোদি চিন এবং পাকিস্তানের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ আলোচনার পথে এগতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাদের তরফে সহযোগিতা মেলেনি। তাই হঠাৎ করে ইজরায়েলের কাছে “ভেঙেছ কলসির কানা/ তা’ বলে কি প্রেম দেব না?” প্রেম-গীতির প্রত্যাশা হাস্যকর।
হামাস সন্ত্রাসে বিশ্বাস করে। তারা ইজরায়েলের প্রতি বিদ্বেষবশত নিরীহ মানুষদের হত্যা করেছে। হামাসকে সমর্থন করব কেন? আবার, ইজরায়েলের চাল-গম এক করে দেওয়া অতি আক্রমণাত্মক রণনীতিকে সমর্থন করার অর্থ প্যালেস্তাইনের প্রতি বিদ্বেষ-ভাবাপন্ন মানসিকতা পোষণ করা। এর কোনও দিকেই না-ঝুঁকে ভারত কি পারবে নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়ে আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে?
শেষে একটিই জিজ্ঞাস্য। ‘রাষ্ট্রসংঘ’ বলে যে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা আছে, হালে তার টিকিটিও কেন দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না? খবরের কাগজে ‘নিরুদ্দেশ সম্পর্কে ঘোষণা’ কলামে বিজ্ঞাপন দিতে হবে বুঝি?
(মতামত নিজস্ব)
লেখক বিশিষ্ট সাংবাদিক
redhat.jayanta@gmail.com