পাকিস্তানের মতো শ্রীলঙ্কাও তার দুই নিকটতম প্রতিবেশী ভারত ও বাংলাদেশের অভিজ্ঞতার আলোয় নিজেকে আলোকিত করতে পারেনি। ক্রমশ তারা তলিয়ে যাচ্ছে অতলে। ক্ষমতায় টিকে থাকার অদম্য তাগিদে পরিবারতন্ত্রের প্রাধান্য পাওয়া, মাত্রাছাড়া দুর্নীতির বহর, ঋণের অপব্যবহার, ভূরি ভূরি অবিবেচক সিদ্ধান্ত এবং আইনের শাসনের চূড়ান্ত অপব্যবহার দেশটাকে তলিয়ে দিচ্ছে। ঋণের ফাঁদে আটকে পড়া এই দেশকে রাজাপক্ষ পরিবার বাঁচাতে পারলে সেটা হতে পারে পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য! কলমে সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রতিবেশী দুই দেশের হাল দেখে ভারতবাসী হিসাবে গর্ব হয়। গর্বিত বোধ করি ভারতীয় গণতন্ত্রের জন্য। আড়াই বছরের টুকরো বিচ্যুতি বাদ দিলে এত প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও ভারতীয় গণতন্ত্র লাইনচ্যুত হয়নি। কখনও বেগবান, কখনও হয়তো ঢিমেতালে, কিন্তু গণতন্ত্রের অগ্রগতি অব্যাহত। এর মূল কৃতিত্ব ভারতীয় গণতন্ত্রের স্রষ্টাদের, যাঁরা দেশের বৈচিত্রকে সম্মান ও মর্যাদা দিয়ে অসামান্য এক সংবিধান রচনা করেছেন, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের স্বার্থে সামাজিক দায়িত্ব পালন করেছেন এবং তা রক্ষায় সদা সচেষ্ট থেকেছেন।
এই অনবদ্য নেতৃত্ব কেন যে প্রতিবেশীদের অনুপ্রাণিত করতে ব্যর্থ তা বোঝা দুষ্কর। ৭৫ বছরের পাকিস্তানের দিকে তাকালে সেই বিস্ময়ের বহর বহুগুণ বেড়ে যায়। সেনাতন্ত্র ও কর্তৃত্ববাদী শাসকের দাপটে গণতন্ত্র সেখানে বিকশিত হওয়ার আগেই ঝরে পড়ে। ভারতের পশ্চিম প্রতিবেশীর গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষের জন্য এ এক নিদারুণ অভিশাপ। নইলে কোনও নির্বাচিত সরকারের মেয়াদ পূর্তি না-হওয়ার ঐতিহ্য এবারেও এমনভাবে কেন অক্ষুণ্ণ থাকবে? বারবার এক চিত্রনাট্যের পুনরাবৃত্তি ঘটবে? ইমরান খান ব্যতিক্রমী শাসক হয়েও ইতিহাস রচনায় ব্যর্থ। এটা তাঁর ও তাঁর দেশবাসী দুয়েরই দুর্ভাগ্য।
[আরও পড়ুন: দেশজুড়ে হাহাকার, এই বসন্তে বিপ্লব দেখবে শ্রীলঙ্কা?]
অথচ দুর্ভাগ্যের সেই করাল ছায়া থেকে নিজেদের মুক্ত করে বাংলাদেশ তরতর করে এগিয়ে চলেছে। এই দৃষ্টান্তও পাকিস্তানকে অনুপ্রাণিত করতে পারেনি। সেই না-পারার মধ্য দিয়ে বেশ বোঝা যায় সময়ের সঙ্গে পাকিস্তান নিজের ভাগ্য বদলাতে কী নিদারুণ ব্যর্থ। এর ঠিক বিপ্রতীপে বাংলাদেশের অবস্থান। শেখ হাসিনার সাফল্যের সাতকাহন পাকিস্তানি রাষ্ট্রনায়কদের লজ্জায় ফেলবে। উপযুক্ত ও বিচক্ষণ নেতৃত্ব একটা দেশকে কীভাবে সমৃদ্ধ করে, প্রগতির পথে আগুয়ান রাখে, এই উপমহাদেশে ভারতের পরে দ্বিতীয় কোনও দেশ যদি সেই দৃষ্টান্ত মেলে ধরে থাকে তা হলে তা বাংলাদেশ। কূটনীতি ও অর্থনীতিতে ভারসাম্য বজায় রেখে নিম্ন আয়ের এক দেশকে কীভাবে ধীরে ধীরে মধ্য আয়ের পঙ্ক্তিভুক্ত করে বিশ্বের সমীহ আদায় করা যায় বাংলাদেশ তা দেখিয়েছে।
দুর্ভাগ্য এই যে, পাকিস্তানের মতো শ্রীলঙ্কাও তার দুই নিকটতম প্রতিবেশী ভারত ও বাংলাদেশের অভিজ্ঞতার আলোয় নিজেকে আলোকিত করতে পারেনি। ক্রমশ তারা তলিয়ে যাচ্ছে অতলে। অথচ এই দেশ গত দশকে নিম্ন-মধ্যম থেকে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছিল। মাথাপিছু জিডিপি ছিল চার হাজার ডলারের বেশি। শিক্ষাব্যবস্থা গণমুখী, ৯৫ শতাংশ মানুষ শিক্ষিত। কিন্তু ক’-বছরের মধ্যেই বিশ্ব ব্যাংক তাদের ফের নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে ফিরিয়ে আনে। আজ গোটা দেশ বিক্ষোভে উত্তাল। চারিদিকে হাহাকার। পেট্রোল পাম্পে অন্তহীন লাইন। ১৫ থেকে ১৮ ঘণ্টা নিত্য লোডশেডিং। হাসপাতালে জরুরি সার্জারি ব্যাহত। মূল্যবৃদ্ধি গগনচুম্বী। খাদ্য সংকটে জন-অসন্তোষ তীব্রতর হচ্ছে দিন দিন। বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় তলানিতে। এক সপ্তাহের আমদানিও দুষ্কর। আকণ্ঠ ঋণে জর্জরিত দেশ আজ বিশ্বের কৃপাপ্রার্থী। ভারত হাত বাড়িয়েছে। জ্বালানি, খাদ্য, ওষুধ ও অত্যাবশকীয় পণ্য-জাহাজ পাঠিয়েছে। এক বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে। শ্রীলঙ্কা আরও দেড় বিলিয়নের প্রত্যাশী।
ক্ষমতায় টিকে থাকার অদম্য তাগিদে পরিবারতন্ত্রের প্রাধান্য পাওয়া, মাত্রাছাড়া দুর্নীতির বহর, ঋণের অপব্যবহার, ভূরি ভূরি অবিবেচক সিদ্ধান্ত এবং আইনের শাসনের চূড়ান্ত অপব্যবহার দেশটাকে তলিয়ে দিচ্ছে। ঋণের ফাঁদে আটকে পড়া এই দেশকে রাজাপক্ষ পরিবার বাঁচাতে পারলে সেটা হতে পারে পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য! সে সুযোগ দেশবাসী এই পরিবারকে দেবে কি না বড় প্রশ্ন সেটাই।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভারতীয় রাজনীতিতে যে-পরিবারতন্ত্রকে অহরহ আক্রমণ করেন, রাজাপক্ষ পরিবারের সঙ্গে তার তুলনাই হয় না। দেশের রাষ্ট্রপতি গোতাবায়া রাজাপক্ষ ও প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষ দুই সহোদর। এই যুগলবন্দির প্রধান সঙ্গতকারী তৃতীয় ভ্রাতা বেসিল রাজাপক্ষ, সদ্য বরখাস্ত হওয়া অর্থমন্ত্রী। ‘বিবিসি’-র সাক্ষাৎকারে তাঁকে ‘মিস্টার টেন’ বলা হয়েছে। সরকারি প্রকল্পের ১০ শতাংশ ‘কমিশন’ গ্রহণের এই জাতীয় অভিযোগ পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী বেনজির আলি ভুট্টোর স্বামী আসিফ আলি জারদারির বিরুদ্ধেও ছিল। প্রমাণ হোক না-হোক, উপমহাদেশের রাজনীতিতে এই বিশেষণে ভূষিত অনেকেই। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে এ এক দুরারোগ্য ব্যাধি। বেসিলের বিরুদ্ধে অভিযোগও ‘প্রমাণিত’ নয়। তবে যে-হারে টাকা নয়ছয় হয়েছে, তাতে অভিযোগ অসত্য বলাও কঠিন।
মন্ত্রিসভায় চতুর্থ রাজাপক্ষ ছিলেন ৭৯ বছরের চামাল। মাহিন্দা যখন প্রেসিডেন্ট, চামাল তখন ছিলেন পার্লামেন্টের স্পিকার। পদত্যাগী মন্ত্রিসভায় সেচ বিভাগের দায়িত্ব ছিল তাঁর। পাশাপাশি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়েরও নাম্বার টু, যে-মন্ত্রকের দায়িত্ব আবার গোতাবায়ার হাতে। মন্ত্রিসভায় পঞ্চম রাজাপক্ষের বয়স মাত্র ৩৫। নমল রাজাপক্ষ মাহিন্দার বড় পুত্র। মাত্র ২৪ বছর বয়সে সাংসদ হওয়া নমলের হাতেই ছিল দেশের খেলাধুলোর ভার। দেশজোড়া রাজনৈতিক ফিসফাস, রাজাপক্ষ পরিবার নমলকেই বেছে নিয়েছে ভবিষ্যৎ প্রেসিডেন্ট হিসাবে। আপাতত চলছে তাঁর ঘষামাজা পর্ব। সব মিলিয়ে মন্ত্রিসভায় রাজাপক্ষ পরিবারের মোট সদস্য সংখ্যা ৯। দেশের মোট বাজেটের ৭৫ শতাংশই ছিল তাঁদের তালুবন্দি। আর কোনও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এই দৃষ্টান্ত সম্ভবত নেই।
রাজাপক্ষদের অর্থ অপচয়ের বহরে নেত্র বিস্ফারিত হবেই। চিনের ঋণে তৈরি হামবানটোটা বন্দর তৈরির পর দেখা গেল যথেষ্ট চাহিদাই নেই। ঋণ শোধে অপারগ শ্রীলঙ্কা বাধ্য হয়েছে হামবানটোটা ৯৯ বছরের জন্য চিনকে লিজ দিতে। একই অবস্থা ‘চাইনিজ সিটি’-সহ কয়েকটি বিমানবন্দর সম্প্রসারণ প্রকল্পেরও। কোনওটাই আয়বর্ধক হয়ে ওঠেনি। কলম্বোর স্কাইলাইনের আকর্ষণ ‘লোটাস টাওয়ার’। দর্শনীয়, কিন্তু অর্থনীতিতে তার কোনও অবদান নেই। ঋণ নিয়ে জমকালো কিছু করার প্রবণতায় অর্থনীতির অন্তর্জলি যাত্রার পথ যে প্রশস্ত হচ্ছে, রাজাপক্ষদের দৃষ্টিতে তা ধরা পড়েনি। টনক যখন নড়েছে, জল তখন বইছে নাকের উপর দিয়ে। ঋণের ফাঁদে আটকে পড়েছে দেশ। এক বছরের মধ্যে সুদে-আসলে শ্রীলঙ্কাকে শোধ দিতে হবে ৭.৩ বিলিয়ন ডলারের ঋণ। ঢাক ও মনসা একসঙ্গে বেচে দিলেও কুলোবে না। অবস্থা এমনই করুণ!
অদূরদর্শী কর্তৃত্ববাদী শাসনের মুশকিল হল আগু-পিছু বিবেচনা না করে হঠকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ। গোতাবায়া-র এমনই এক সিদ্ধান্ত ‘অরগ্যানিক ফার্মিং’। কোনও পরামর্শ ছাড়া রাতারাতি তিনি সারা দেশে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার বন্ধ করে দেন। ফলে ঘটে গেল ফলন বিপর্যয়। এক বছরে খাদ্য উৎপাদন কমে গেল তিনভাগ। এটা যদি অর্থনীতির বিষফোড়া হয়, গোদ কোভিড। পর্যটন শিল্প তলানিতে পৌঁছনোর ফলে বিদেশি মুদ্রা আয়ের সিংহভাগ ধসে গেল। কোভিডের কারণে ব্যাপক মার খেল এলাচ ও দারুচিনির রপ্তানি। কথায় বলে, বিপদ যখন আসে চারদিক দিয়ে আসে। ‘সভারেন বন্ড’ বেচে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে শ্রীলঙ্কা যে-পুঁজি সংগ্রহ করেছিল, চলতি বছর থেকে সেই অর্থ তাদের ফেরত দিতে হবে। কী করবে রাজাপক্ষ পরিবার, সে দিকে তাকিয়ে সারা বিশ্ব।
রাষ্ট্র পরিচালনায় বেহিসেবি রাজনীতির লাগাম টেনে ধরার গুরুদায়িত্ব আমলাশাহির। সংবিধান প্রণেতারা সেই ক্ষমতা ও অধিকার তাঁদের দিয়েছেন। গ্রিস ও শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক দুর্দশার উদাহরণ দেখিয়ে ভারতের শীর্ষ আমলারা সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীকে সতর্ক করে জানিয়েছেন, ভোটে জেতার অদম্য তাগিদে ‘ডোল’ বা দান-খয়রাতির যে-প্রবণতা সাম্প্রতিক কালে লাগামহীন হয়ে উঠেছে, শাসক বিজেপিও যে দোষে দুষ্ট, তাতে রাশ টানা না গেলে ভবিষ্যৎ করুণ হয়ে উঠবে। ভারতকে দেখে পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কা শিখুক না শিখুক তাদের ব্যাপার। কিন্তু প্রতিবেশীদের দেখে ভারতের শেখার রয়েছে অনেক কিছুই।