shono
Advertisement

Breaking News

Trade Agreement

জলের দরে বিলিতি স্কচ, ব্রিটেনের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তিতে চাপে ট্রাম্প

চাপের মুখে ভারতের অবস্থান কি বদল হবে?
Published By: Kishore GhoshPosted: 04:55 PM Aug 05, 2025Updated: 04:55 PM Aug 05, 2025

ব্রিটেনের সঙ্গে ভারতের মুক্ত বাণিজ‌্য চুক্তিতে স্কচ হুইস্কি ও বিলাসবহুল ব্রিটিশ গাড়ির দাম কমতে চলেছে। স্বভাতই এ চুক্তির ফলে অস্বস্তিতে ট্রাম্প প্রশাসন। শুল্ক ও জরিমানা ছাড়াও ভারতকে উত্ত‌্যক্ত করতে পাকিস্তান প্রসঙ্গ টেনে ভারতকে চাপে রাখতে চাইছেন। চাপের মুখে ভারতের অবস্থান কি বদল হবে? লিখছেন সুতীর্থ চক্রবর্তী

Advertisement

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারতের ঘাড়ে ২৫ শতাংশ শুল্ক চাপিয়ে নিন্দা শুরু করার পরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মুখে ফের স্বদেশির কথা। অথচ কয়েক দিন আগেই ভারত-ব্রিটেন মুক্ত বাণিজ‌্য চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে। মোদি সরকার আরও বেশ কিছু এই ধরনের চুক্তি সম্পাদনের রাস্তায় রয়েছে। ‘ইউরোপীয় ইউনিয়ন’-এর সঙ্গেও ভারতের ‘মুক্ত বাণিজ‌্য চুক্তি’ নিয়ে আলোচনা চলছে। আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা ও একাধিক অারব দেশের সঙ্গেও ভারত অচিরে মুক্ত বাণিজ‌্য চুক্তিতে যেতে পারে। সব মিলিয়ে ১৩টি দেশের সঙ্গে ভারতের বাণিজ‌্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা চলছে।

মুক্ত বাণিজ‌্য চুক্তিতে দু’টি দেশের মধ্যে পণ‌্য ও পরিষেবা বাণিজ্যে শুল্ক, কোটা-সহ অন‌্যান‌্য সমস্ত প্রশাসনিক বাধা দূর করা হয়। যেমন– ভারত ও ব্রিটেনের মধ্যে বাণিজ‌্য চুক্তির ফলে ভারত যেসব পণ‌্য ব্রিটেনে রফতানি করে, তার গড় শুল্কের হার ১৫ শতাংশ থেকে কমে ৩ শতাংশ হয়ে যাবে। ভারতও আগামী এক দশকের মধ্যে ব্রিটেন থেকে আমদানি করা ৮৫ শতাংশ পণ্যের উপর থেকে শুল্ক তুলে নেবে। যে-দু’টি ব্রিটিশ পণ্যের উপর থেকে এখনই শুল্ক কমে যাওয়া নিয়ে সোশ‌্যাল মিডিয়ায় খুব আলোচনা চলছে, সেগুলি হল– স্কচ হুইস্কি ও বিলাসবহুল ব্রিটিশ গাড়ি। স্কচ হুইস্কির উপর ভারত এখন ১৫০ শতাংশ শুল্ক চাপায়। চুক্তির পর সেটা কমে অর্ধেক, মানে ৭৫ শতাংশ হয়ে যাচ্ছে। এক দশকের মধে‌্য এটা অারও কমে ৪০ শতাংশ হয়ে যাবে। মানে, ৩ হাজার টাকার স্কচ হুইস্কির বোতল ১২০০-১৩০০ টাকার হয়ে যাবে। নিশ্চিত বিপদ বাড়বে দেশি হুইস্কির। খুব সস্তা হয়ে যাবে রোল্‌স রয়েস, জাগুয়ারের মতো ব্রিটিশ বিলাসবহুল গাড়ি। কারণ ব্রিটিশ গাড়িতে শুল্ক ১০০ শতাংশ থেকে কমে ১০ শতাংশ হতে চলেছে। অাবার শুল্ক কমে যাওয়ায় ভারতীয় পোশাক, জুতো, গয়না, মশলা, সামুদ্রিক মাছ, ইঞ্জিনিয়ারিং সামগ্রী ইত‌্যাদি বহু পণ‌্য ব্রিটেনের বাজারে সস্তা হয়ে যাবে।

চুক্তিতে ভারতীয় কোলাপুরি চপ্পল থেকে সম্পূর্ণ শুল্ক প্রত‌্যাহারের কথা বলা হয়েছে। ফলে ব্রিটিশ বাজারে বাড়তে পারে ভারতে হাতে তৈরি কোলাপুরি চপ্পলের চাহিদা।
মুক্ত বাণিজ‌্য চুক্তিতে দু’-দেশের মধ্যে বাণিজ‌্য বাড়ে। যেমন, চুক্তির ফলে ভারত-ব্রিটেন দ্বিপাক্ষিক বাণিজ‌্যও বিপুল বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে। এখন ভারত ও ব্রিটেনের মধ্যে বছরে পাঁচ হাজার ৬০০ কোটি মার্কিন ডলারের ব‌্যবসা হয়। ২০৩০ সালের মধ্যে সেটা দ্বিগুণ হতে পারে। কিন্তু এতে ভারত কতটা উপকৃত হতে পারে, সে প্রশ্ন অনিবার্যভাবে সামনে আসছে।

ব্রিটেন তার মোট আমদানির মাত্র ১.৮ শতাংশ ভারত থেকে আমদানি করে। ভারতের বাজারেও এখনও পর্যন্ত ব্রিটিশ পণ্যের চাহিদা নগণ‌্য। ব্রিটেন সারা বছর গোটা দুনিয়ায় যা রফতানি করে, তার ১.৯ শতাংশ মাত্র ভারতে। তবে ভারতের বাজারের দখল নিতে যে ব্রিটেন প্রবল আগ্রহী, তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। চুক্তির পর ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ২০৫০ সালের মধ্যে ভারতে আমদানির চাহিদা বিশাল বাড়বে। তখন ভারত তাদের তৃতীয় বৃহত্তম আমদানিকারক দেশে পরিণত হবে। সেই বাজারটির দিকেই নজর রাখছে তারা। মাথায় রাখতে হবে প্রায় ৩০০ বছর আগে বণিকের মানদণ্ড নিয়েই ভারতে এসেছিল ব্রিটিশরা। তারপর ২০০ বছরের ব্রিটিশ শাসনের পত্তন ঘটেছিল। নয়া উপনিবেশবাদও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মোড়কেই তৃতীয় বিশ্বের দেশে অনুপ্রবেশ করে।

ভারতের বাজারের একইরকম দখল চাইছেন ট্রাম্প। ব্রিটেনের সঙ্গে ভারত মুক্ত বাণিজ‌্য চুক্তি সেরে ফেলায় সম্ভবত ট্রাম্প একটু বেশি উত্তেজিত বোধ করছেন। ১ আগস্টের মধ্যে চুক্তিটি না-হওয়ায় তাই তিনি ভারতকে চারদিক দিয়ে আক্রমণের রাস্তায় গেলেন। একদিকে মার্কিন বাজারে সমস্ত ভারতীয় পণ্যের উপর ২৫ শতাংশ শুল্ক চাপালেন। উপরন্তু রাশিয়ার থেকে জ্বালানি তেল কেনার জন‌্য জরিমানা। ২৫ শতাংশ শুল্ক চাপতে শুরু করবে ৭ আগস্ট থেকে।

কিন্তু জরিমানা কবে থেকে এবং কত শতাংশ চাপবে, তা স্পষ্ট নয়। মার্কিন আইনে এই জরিমানার পরিমাণ ৫০০ শতাংশ পর্ষন্ত হতে পারে। শুল্ক ও জরিমানা যে আপাতত বেশ কিছু ভারতীয় শিল্পকে জোর ধাক্কা দেবে, তা নিয়ে সংশয় নেই। বিশষত অলংকার, ওষুধ, পোশাক, গাড়ির যন্ত্রাংশ ও চর্মশিল্প আঘাত পাবে। ‘ব‌্যাঙ্ক অফ বরোদা’-র একটি গবেষণা বলছে– অামেরিকার এই অতিরিক্ত শুল্কের জেরে ভারতের জিডিপি বৃদ্ধির হার ০.২ শতাংশ কমে যেতে পারে। জিডিপি বৃদ্ধির হার এতটা কমে যাওয়া মানে, তার প্রভাব দেশে কর্মসংস্থানের উপর পড়া।

ট্রাম্প তাঁর চিরাচরিত কায়দায় কিছুটা ‘বিলো দ‌্য বেল্ট’ আক্রমণ করেছেন ভারতকে। ভারতের অর্থনীতি ‘প্রায় মৃত’ বলেছেন। একইসঙ্গে পাকিস্তানের সঙ্গে বাণিজ‌্যচুক্তি সেরে ফেলেছেন। পাকিস্তানের উপর ট্রাম্প মাত্র ১৯ শতাংশ শুল্ক চাপিয়েছেন। মার্কিন কোম্পানি পাকিস্তানের সঙ্গে যৌথভাবে বিপুল পরিমাণে তেল উৎপাদন করবে বলে ঘোষণা করেছেন। ভারতকে খেঁাচা মারতে বলেছেন, ‘এমন দিন আসবে যখন পাকিস্তান ভারতকে তেল বেচবে।’ যদিও সেদিন যে কখনও আসা সম্ভব নয়, তা ট্রাম্পও ভাল জানেন। কারণ ভারতের মতো পাকিস্তানকেও তাদের জ্বালানির ৮০ শতাংশ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়।

পাকিস্তানে বিশাল কোনও তৈলভাণ্ডারের অস্তিত্ব গত ৭৫ বছরে মেলেনি। আগামী দিনে মিলতে পারে এমন কোনও ইঙ্গিতও নেই। ভারতকে উত্ত‌্যক্ত করতেই যে ট্রাম্প পাকিস্তানের প্রসঙ্গ টেনেছেন, তা বলা বাহুল‌্য। এটাই ট্রাম্পের কৌশল। পাকিস্তানের অর্থনীতির হাল খুবই খারাপ। ভারত-আমেরিকা যে বার্ষিক ব‌্যবসা হয়, তার ১০ শতাংশ ব‌্যবসাও আমেরিকা পাকিস্তানের সঙ্গে করে না। তবুও ভারতের সঙ্গে এক বন্ধনীতে পাকিস্তানকে রাখা ট্রাম্পের চাপের রাজনীতি ছাড়া কিছুই নয়।

ভারতের অর্থনীতিকে ‘প্রায় মৃত’ বলে দাগিয়ে দেওয়া, রাশিয়ার সঙ্গে ভারতও ডুবে যাক বা পাকিস্তান থেকে ভবিষ‌্যতে ভারতকে তেল কিনতে হবে, ইত‌্যাদি ট্রাম্পের মন্তব্যে কোনও প্রতিক্রিয়া দেয়নি ভারত। নিশ্চিত করেই ভারতের দিক থেকে এটি একটি সঠিক পদক্ষপ। ট্রাম্প জানেন, পাকিস্তানকে টেনে গালাগালি করলেই একমাত্র ভারত একটু নড়েচড়ে বসবে। সেদিক থেকে ট্রাম্পের যাবতীয় মন্তব‌্য উপেক্ষা করার যে নীতি নিয়ে ভারত চলছে, তা কার্যকরী হতে পারে। ভারত-পাকিস্তান সংঘাত তিনি থামিয়েছেন বলে ট্রাম্প বারবার যে দাবি করে যাচ্ছেন, সেটাও তাঁর চাপ সৃষ্টির একটি কৌশলের মধ্যে পড়ে। এক্ষেত্রেও ট্রাম্পের দাবি লাগাতার উড়িয়ে দিয়ে ভারত সঠিক পথেই রয়েছে বলে মনে করা যায়।

বস্তুত, ট্রাম্পের লক্ষ‌্য হল– যে কোনও মূল্যে ভারতের সঙ্গে বাণিজ‌্য চুক্তির পরিসরে কৃষি, ডেয়ারি ইত‌্যাদিকে নিয়ে আসা। এই ক্ষেত্রগুলিকে বিদেশি সংস্থার জন‌্য খুলে দেওয়ার বিষয়ে কিছুটা নরম মনোভাব দেখাচ্ছিল মোদি সরকার। এ-ব‌্যাপারে নীতি আয়োগের দু’টি গবেষণাপত্রও প্রকাশ্যে এসেছিল। যেখানে কৃষি ও ডেয়ারিতে কিছুটা শুল্ক কমানোর পক্ষে সওয়াল করা হয়েছিল। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে নীতি আয়োগের ওই দু’টি গবেষণাপত্র তাদের ওয়েবসাইট থেকে গায়েব হয়ে গিয়েছে। ট্রাম্পের হুমকির পর মোদি প্রকাশ্যে স্বদেশি দ্রব‌্য কেনার বিষয়ে গুরুত্ব প্রদান করছেন দেখেও বোঝা যাচ্ছে যে, মুক্ত বাণিজ‌্য নিয়ে কিছুটা ধীর পদক্ষেপে হঁাটতে চাইছে ভারত। মোদি সরকারে আসার পর এশিয়ান দেশগুলির মুক্ত বাণিজ‌্যর ব্লক ‘অারসেপ’ চুক্তি থেকে সরে আসে ভারত। তখন বলা হচ্ছিল, মুক্ত বাণিজে‌্য সুবিধা হচ্ছে না ভারতের সংস্থাগুলির। ভারত কারও বাজার পাচ্ছে না। অন‌্যরা ভারতের বাজারের দখল নিচ্ছে। কোভিডের পর আবার মুক্ত বাণিজ্যের দিকে হাঁটা শুরু হয় ভারতের। প্রথমে অস্ট্রেলিয়া ও আরব আমিরশাহির সঙ্গে মুক্ত বাণিজ‌্য চুক্তি করে ভারত। তারপর ব্রিটেন। লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আরও কয়েকটি দেশ। এবার ট্রাম্পের চাপের মুখে দাঁড়িয়ে কি আবার অবস্থান বদল হবে ভারতের?

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

হাইলাইটস

Highlights Heading
  • কিন্তু জরিমানা কবে থেকে এবং কত শতাংশ চাপবে, তা স্পষ্ট নয়।
  • বস্তুত, ট্রাম্পের লক্ষ‌্য হল– যে কোনও মূল্যে ভারতের সঙ্গে বাণিজ‌্য চুক্তির পরিসরে কৃষি, ডেয়ারি ইত‌্যাদিকে নিয়ে আসা।
Advertisement