সাত সর্বদলীয় সাংসদদের একটি সফরেই কি একসঙ্গে এতগুলি দেশকে পাকিস্তানের সন্ত্রাসবাদের বিপদ সম্পর্কে সচেতন করা সম্ভব? অাইএমএফের সিংহভাগ ভোট যে দেশগুলির হাতে, তারা কেউ-ই পাকিস্তানের বিপদ সম্পর্কে সচেতন নয়। পাকিস্তানকে কোণঠাসা করার একমাত্র উপায় কি সমরাস্ত্র-ভাণ্ডারের বৈচিত্রে ভাঙন? লিখছেন সুতীর্থ চক্রবর্তী।
৩২টি দেশ ঘুরে সাত সর্বদলীয় সাংসদদের কমিটি কি লক্ষ্য অর্জনে সফল হল?
এর উত্তর হয়তো সহজে মিলবে না। অাপাতত ঠিক অাছে প্রতিনিধিরা সকলে দেশে ফিরলে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সবাইকে নিয়ে একটি মূল্যায়ন বৈঠকে বসবেন। ওই বৈঠকে প্রতিনিধিরা তঁাদের অভিজ্ঞতার কথা জানাবেন। পাকিস্তান কেন শুধুমাত্র ভারতের জন্য নয়, সারা বিশ্বের জন্যই একটি বিপদ, সেই বার্তাটা তঁারা কতটা সফর করা দেশগুলির রাষ্ট্রকর্তা ও বাসিন্দাদের কাছে পৌঁছতে পারলেন, সেকথাও নিশ্চিতভাবে জানাবেন। একটি সফরেই একসঙ্গে এতগুলি দেশকে পাকিস্তানের বিপদ সম্পর্কে সচেতন করা সম্ভব নয়। কিন্তু এই সচেতনতা বাড়ানোর কাজটি শুরু করার দরকার ছিল। দেরিতে হলেও শেষ পর্যন্ত কাজটি শুরু হল।
এটা মাথায় রাখতে হবে যে, ভারতের ‘অপারেশন সিঁদুর’ শুরু হওয়ার পরও পাকিস্তান ‘অান্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডার’ তথা ‘অাইএমএফ’ থেকে ১০০ কোটি ডলার তথা ৮,৫০০ কোটি টাকা ঋণ পেয়েছে। অাইএমএফের ‘এক্সটেন্ডেড ফান্ড ফেসিলিটি’ তথা বর্ধিত তহবিল সুবিধা থেকে গত ৯ মে এই ঋণ দেওয়া হয়েছে। কাঠামোগত অর্থনৈতিক দুর্বলতার কারণে যখন একটি সদস্য দেশ তার অামদানি করা পণ্য ও পরিষেবার দাম মেটাতে পারে না, তখন অাইএমএফের এই তহবিল থেকে তাকে ঋণ দেওয়া হয়। গত কয়েক বছর ধরে পাকিস্তান দেউলিয়া হয়ে গিয়েছে। তাদের অার্থিক বৃদ্ধির হার শূনে্য পৌঁছে গিয়েছে। অাইএমএফের থেকে টাকা ধার করে করে তারা কোনওক্রমে অামদানির খরচ মেটাচ্ছে। গত সেপ্টেম্বরে অাইএমএফের বর্ধিত তহবিল সুবিধা থেকে তাদের ৭০০ কোটি ডলার ঋণ মঞ্জুর হয়। এই ঋণের একটি কিস্তি হিসাবে তারা ৯ মে অর্থাৎ ‘অপারেশন সিঁদুর’ শুরু হওয়ার ৪৮ ঘণ্টার মধে্য ১০০ কোটি ডলার পেয়েছে। এই ঋণের টাকা থেকে যে পাকিস্তানের শাহবাজ শরিফের সরকার অস্ত্রশস্ত্র অামদানির খরচ মিটিয়েছে, তা বলা বাহুল্য।
সেসব অস্ত্র শুধু পাক সেনাবাহিনীর কাজেই ব্যবহৃত হয়নি। এর একটি অংশ পৌঁছবে লস্কর-ই-তইবা, জামাত-উদ-দোয়ার মতো জঙ্গি সংগঠনগুলির কাছেও। যার প্রয়োগ হবে পহেলগঁাওয়ের মতো অারও কোনও সন্ত্রাসবাদী হামলায়। ভারত চেষ্টা করেও অাইএমএফের এই ঋণের কিস্তি অাটকাতে পারেনি। অাটকানো যায়নি এই কারণে যে, ১৯১ দেশের সংগঠন অাইএমএফে ভারতের ভোটের পরিমাণ সামান্য। অাইএমএফের সিংহভাগ ভোট যে দেশগুলির হাতে, তারা কেউই পাকিস্তানের বিপদ সম্পর্কে সচেতন নয়। অাইএমএফে শুধু অামেরিকার একটি ভোটের শক্তি ১৬.৪৯ শতাংশ। জাপানের একটি ভোটের শক্তি ৬.১৪ শতাংশ। চিনের একটি ভোটের শক্তি ৬.০৮ শতাংশ। জার্মানি, ফ্রান্স ও ব্রিটেনের ভোটের শক্তি যথাক্রমে ৫.৩১, ৪.০৩ ও ৪.০৩ শতাংশ। সৌদি অারবের ভোটের শক্তিও ২.০১ শতাংশ। সেখানে ভারত, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ ও ভুটানের মিলিতভাবে ভোটের শক্তি ৩.০৫ শতাংশ। অাইএমএফের বোর্ডের সিদ্ধান্তে ভেটো দিতে ৮৫ শতাংশ ভোটের প্রয়োজন। ভারত তা জোগাড় করার ধারেকাছে নেই। পাকিস্তান কিন্তু খুব সহজেই অাইএমএফ থেকে শুরু করে সব অান্তর্জাতিক মঞ্চগুলিতে তার সমর্থন জুটিয়ে নেয়।
‘অপারেশন সিঁদুর’ চলার মধে্য অাইএমএফের তহবিল থেকে সাড়ে অাট হাজার কোটি টাকা বের করে যে পাকিস্তান বিশ্বমঞ্চে ভারতকে একটা গোল দিয়েছিল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ভারতের সর্বদলীয় সাংসদ প্রতিনিধিদের দল ৩২টি দেশ ঘুরে-ঘুরে পাকিস্তানকে বিশ্বমঞ্চে পালটা গোল দেওয়ার চেষ্টা চালিয়েছে। এর অারও সুস্পষ্ট ও অারও সুনির্দিষ্ট ফল পেতে সময় লাগবে।
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্কের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ও ওয়াশিংটনের পেন্টাগনে ওসামা বিন লাদেনের অাল কায়েদার হামলার পর অামেরিকা রাতারাতি বুঝেছিল পাকিস্তানের জঙ্গি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলিতে শুধু ভারতে সন্ত্রাসবাদ রফতানির কাজই হয় না। অ্যাবোটাবাদে ঢুকে লাদেনকে খতম করার পর অামেরিকা সম্ভবত পাকিস্তানের জঙ্গি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলি নিয়ে কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়ে গিয়েছে। ইউরোপ-সহ উন্নত বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলি সম্পর্কেও একই কথা সত্য। মধ্যপ্রাচ্য বা অাফ্রিকার জিহাদি গোষ্ঠীগুলি নিয়ে যেন তাদের বেশি চিন্তা।
তাদের ভৌগোলিক অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে পাকিস্তান বরাবর উন্নত বিশ্বের সমর্থন অাদায় করে চলেছে। পঁাচের দশক থেকে পাকিস্তান অামেরিকা ও তার মিত্র দেশগুলিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের জুজু দেখাত। তখন তারা বলত সোভিয়েতের হাত ধরে কমিউনিজম মধ্য এশিয়ায় পৌঁছে গিয়েছে। অন্যদিকে দক্ষিণ এশিয়ায় ঢুকছে চিনও। ভারতও ঝুঁকে রয়েছে কমিউনিজমের দিকে। একমাত্র দেওয়ালের মতো তারা অাটকে রেখেছে কমিউনিজমকে। ১৯৫৪ সালে পাকিস্তানের সঙ্গে হাত ধরে অামেরিকা, ফ্রান্স, ব্রিটেন, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ফিলিপিন্স ও থাইল্যান্ড গঠন করেছিল কমিউনিস্ট বিরোধী জোট সাউথ ইস্ট এশিয়া ট্রিটি অর্গানাইজেশন (সিয়াটো)। অাফগানিস্তানে কমিউনিস্ট সরকারকে রক্ষা করতে সেখানে সোভিয়েত বাহিনী ঢোকার পর পাকিস্তানের সঙ্গে অামেরিকার ঘনিষ্ঠতা তুঙ্গে উঠেছিল।
‘অপারেশন সিঁদুর’ চলাকালীন সে-কথা অামেরিকাকে স্মরণ করিয়ে দিতেই পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা অাসিফ বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “অামেরিকার মদতেই অাফগানিস্তানে সোভিয়েতকে লড়ার জন্য পাকিস্তানের মাটিতে জঙ্গি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র তৈরি হয়েছিল। সেসব জিহাদি তথা ‘মুজাহিদ’দের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়েছিল অামেরিকা। যে বোঝা এখনও বয়ে চলেছে পাকিস্তান।” সোভিয়েত ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় অামেরিকা ও পশ্চিমি দুনিয়ার কাছে পাকিস্তানের গুরুত্ব কিছুটা কমেছিল। কিন্তু ভারত-চিন যুদ্ধ ও ইরানে ইসলামি বিপ্লবের মধে্য দিয়ে শিয়া শাসকদের উত্থানকে কাজে লাগিয়ে পাকিস্তান চিন ও অারব দেশগুলির সঙ্গে বন্ধুত্ব নিবিড় করে ফেলেছিল। ’৬২-র যুদ্ধের পর চিনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। পাকিস্তান ‘শত্রুর শত্রু অামার মিত্র’ নীতিকে কাজে লাগায়। অন্যদিকে ১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লবের মধে্য দিয়ে ক্ষমতায় এসে ইরানের শিয়া শাসকরা অারবের সুন্নি পরিবারতন্ত্রগুলিকে ধ্বংস করার সংকল্প নেয়। সৌদি-সহ আরবের সুন্নি দেশগুলিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয় পাকিস্তান। কারণ ইরানের ঘাড়ের উপর বসে থাকা তারাই একমাত্র পারমাণবিক শক্তিধর দেশ।
অামেরিকা ও ‘ন্যাটো’-ভুক্ত দেশগুলির বাইরে বন্ধুত্ব বিস্তারের পাক কৌশলের সুফলও ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর সময় দেখা গিয়েছে। কারণ ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তান ব্যবহার করেছে চিনের ক্ষেপণাস্ত্র ও তুরস্কের ড্রোন। অর্থাৎ, পাকিস্তান তার সমরাস্ত্রের ভাণ্ডারের বৈচিত্র বাড়াতে সক্ষম হয়েছে। পাকিস্তানকে কোণঠাসা করতে গেলে তার এই বৈচিত্রকে ভাঙতে হবে। পাকিস্তানকে নির্বান্ধব করতে হবে। তার জন্য পাকিস্তানের সন্ত্রাসবাদের বিপদ নিয়ে অারও বেশি-বেশি করে সারা বিশ্বকে সতর্ক ও সচেতন করতে হবে।
কয়েক দিন অাগে উরাল পর্বতমালা ঘেঁষা পার্ম শহরে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে রাশিয়ার বিদেশমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ ঘোষণা করেছেন অাবার পঁাচের দশকের মতো ‘রাশিয়া-ভারত-চিন’ অক্ষ তৈরির সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। ইতিমধ্যে যার নাম রাখা হয়েছে ‘অারঅাইসি’। এই অক্ষ বাস্তবায়িত হলে পাকিস্তানের অনেক সমীকরণ বেসামাল হয়ে যাবে। তবে এই অক্ষ নিয়ে অারএসএস ও মোদি সরকারের কী অবস্থান, তা স্পষ্ট নয়। পাকিস্তানের নানারকম অক্ষগুলি ভাঙতে গেলে যে ভারতকেও নয়া-নয়া অক্ষ তৈরির খেলায় যেতে হবে, তা নিয়ে সংশয় নেই।
