৩৬৫ দিনের কিছু বেশি অতিক্রান্ত, যুদ্ধে গাজায় মৃতের সংখ্যা ৪২ হাজার ছাড়িয়েছে। ইজরায়েলের লক্ষ্য– প্যালেস্তিনীয়দের ঘেটোয় বন্দি করে, ইরানকে দুর্বল বানিয়ে, লেবানন-ইয়েমেন-ইরাক-সিরিয়ার প্রতিরোধের অক্ষটিকে ধ্বংস করা। হয়ে ওঠা পশ্চিম এশিয়ার অপ্রতিরোধ্য শক্তি। লিখছেন সুতীর্থ চক্রবর্তী।
মনুষ্যসমাজ নির্মাণে শব্দের গুরুত্ব অাদৌ কি রয়েছে? গত এক বছর ধরে চলতে থাকা ইজরায়েল-হামাস ‘যুদ্ধ’-র প্রেক্ষিতে সমাজতাত্ত্বিকরা এই প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন। ছবি, লিখিত ভাষা বা যোগাযোগের অন্য সমস্ত মাধ্যম তৈরির অাগে প্রকৃতি ও মনুষ্য সমাজে শব্দের অাবির্ভাব ঘটেছে। প্রকৃতি ও মানুষের মিথষ্ক্রিয়াতেও শব্দই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। পাখির ডাক মানুষ শুনেছিল বলেই তো সুরের সৃষ্টি হয়েছে। শব্দ যদি মানুষ শুনতে না-পায়, তাহলে সেই শব্দের ভূমিকা থাকে না। শব্দ না শোনা গেলে বিপন্ন জীবজগৎও। মানুষ বিপদে পড়লে চিৎকার করে, কিন্তু সেই চিৎকার যদি অন্য কারও কানে না পৌঁছয়, কেউ যদি সেটা শুনতে না চায়, তাহলে সমাজ বলে কিছু থাকে না। সমাজ ও জীবজগৎকে টিকে থাকার জন্য, এগিয়ে যাওয়ার জন্য শব্দ সৃষ্টি ও সেই শব্দ শুনতে পাওয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ।
অথচ দেখা যাচ্ছে, গত এক বছর ধরে গাজার বাসিন্দাদের অার্ত চিৎকার কারও কানেই পৌঁছচ্ছে না। সেখানে রোজ টন-টন বোমা বর্ষিত হচ্ছে, কিন্তু তার অাওয়াজ কারও কানে যাচ্ছে না। গত বছরের ৭ অক্টোবর, ইজরায়েলের ভূখণ্ডে, হামাসের হামলার পর থেকে গাজায় ইজরায়েল সেনাবাহিনীর হামলা শুরু হয়েছে। ৩৬৫ দিনের কিছু বেশি অতিক্রান্ত, গাজায় ইতিমধে্য মৃতের সংখ্যা সাড়ে ৪২ হাজার ছাড়িয়েছে। গোড়া থেকেই মৃতের দলে বিরাট সংখ্যায় রয়েছে শিশুরা। এককথায়, এক বছর ধরে গাজায় যা ঘটছে, তা ‘গণহত্যা’। কিন্তু সেই কথাটা বলার মতো সুযোগও কোথাও নেই। সংবাদমাধ্যম একতরফা ইজরায়েলের হামলাকে ‘যুদ্ধ’ বলে গত এক বছর ধরে দেখিয়ে অাসছে। অাসলে, গাজা থেকে উঠে অাসা শব্দ যদি কেউ শুনতে না-পায়, তাহলে যা ঘটার তাই ঘটছে। গাজায় জনপদের পর জনপদ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। ইজরায়েলি বোমায় রোজ স্রেফ ধুলোয় মিশে যাচ্ছে বাড়িঘর, বাজার-দোকান, হাসপাতাল, স্কুল। বোমায় রোজ জীবন্ত দগ্ধ হচ্ছে শত-শত শিশু, মহিলা, বৃদ্ধ, যুবক। তাদের অার্তনাদ মনুষ্যসমাজের কানে ঢুকছে না। যখন গাজা থেকে শব্দের রোল উঠছে তখন যেন বধির হয়ে যাচ্ছে সবার শ্রবণ যন্ত্র। এ এক অদ্ভুত পরিস্থিতি! তাত্ত্বিক প্রশ্ন উঠছে শব্দের গুরুত্ব নিয়ে।
ইয়াহিয়া সিনওয়ারের হত্যার পর গাজায় ইজরায়েলের হামলা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছতে চলেছে বলে কোনও-কোনও মহল থেকে বলা হচ্ছে। গত বছরের ৭ অক্টোবর, হামাসের হামলায় নেতৃত্বে ছিলেন এই সিনওয়ার। সিনওয়ারের হত্যা নিশ্চিত হওয়ার পরেই লেবানন থেকে ড্রোন উড়ে এসেছে ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু-র ব্যক্তিগত বাসভবনের দিকে। এ-যাত্রায় রক্ষা পেয়েছেন ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ও তঁার পরিবার। কিন্তু সংঘর্ষে যে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে, তা নিয়ে সংশয় নেই। পশ্চিম এশিয়ায় যুদ্ধ অারও ছড়িয়ে পড়া সুনিশ্চিত হচ্ছে। ইজরায়েল, ইরান, লেবানন, ইয়েমেন, সিরিয়া এবং ইরাক– যুদ্ধক্ষেত্রের বৃত্তটা অারও বড় হচ্ছে। ইজরায়েলের কৌশলগত লক্ষ্য বজায় রাখতে মার্কিন সাহায্য, অস্ত্র ও গোয়েন্দা তথ্য অব্যাহত রয়েছে। গাজা থেকে উদ্ভূত অাওয়াজের মুখে বধির হলেও মার্কিন প্রশাসনের কর্তাদের কানে ইহুদিদের দাবি পৌঁছচ্ছে। অাঞ্চলিক যুদ্ধে হামাস ছাড়াও জড়িয়ে পড়েছে লেবাননের হিজবুল্লা, ইয়েমেনের হুথি এবং হাশাদ আল-শাবি।
১ এপ্রিল সিরিয়ায় ইজরায়েলি হামলায় ইরানি কনস্যুলেটে ইরানি জেনারেলদের হত্যা পশ্চিম এশিয়ার এই সংঘর্ষকে ছড়িয়ে দেয়। এরপর ৩১ জুলাই ইজরায়েল হত্যা করে হামাসের প্রধান রাজনৈতিক নেতা ইসমাইল হানিয়া-কে। তিনি রাষ্ট্রীয় অতিথি হয়ে ইরানে গিয়েছিলেন। সেখানে ইজরায়েলের হামলা হয়। ইরান তখনই প্রতিশোধের হুমকি দেয়। ২৭ সেপ্টেম্বর লেবাননে একটি বিল্ডিং কমপ্লেক্সে বোমা হামলা করে শত-শত বেসামরিক নাগরিকের সঙ্গে হিজবুল্লার প্রধান নেতা সৈয়দ হাসান নাসরুল্লাহকে হত্যা করে ইজরায়েল। এর আগে ঘটে পেজারে বিস্ফোরণ করে কয়েকশো হিজবুল্লা কর্মীকে খুনের ঘটনা। এরপরই নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতিতে প্রতিশোধ নেয় ইরান। যেখানে কোনও হতাহতের ঘটনা নেই।
১ অক্টোবর ইজরায়েলের উপর দ্বিতীয় হামলায় ২০০ ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছিল ইরান। ইজরায়েলের ‘অায়রন ডোম’ তথা লোহার গম্বুজ প্রযুক্তি ইরানের সব ক্ষেপণাস্ত্রকে হেলায় প্রতিহত করে। অাসলে, ইরানের তরফে এটাই বার্তা ছিল যে, তাদের ইজরায়েলের ভূখণ্ডে অনুপ্রবেশ করার পর্যাপ্ত ক্ষমতা রয়েছে। এখন শোনা যাচ্ছে– ইরানের উপর প্রতিশোধ নেওয়ার সমস্ত প্রস্তুতি শেষ ইজরায়েলের। যে কোনও দিন শুরু হবে এই হামলা। এই হামলায় ইরানে কত প্রাণহানি ঘটে, এখন হয়তো সেটাও দেখে যেতে হবে গাজার মতোই।
বোমাবর্ষণ ও ড্রোন হামলা ছাড়াও ইজরায়েল হিজবুল্লাকে খতম করার নামে লেবাননের ১৫০ মাইল সীমান্ত ধরে স্থল অভিযান শুরু করেছে। ইজরায়েলের লক্ষ্য– এই অঞ্চলে একটি ‘বাফার জোন’ তৈরি করা এবং গত বছরের অক্টোবরে হামাস হামলার পর উত্তর ইজরায়েলে লেবানন থেকে অাসা হিজবুল্লার লাগাতার রকেট হামলায় অাশ্রয়চু্যত ৬০ হাজার ইহুদিকে ঘরে ফিরিয়ে দেওয়া। ইজরায়েলি হানায় গত এক মাসে লেবাননে লক্ষাধিক মানুষ বাস্তুচু্যত হয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে ঠঁাই নিয়েছে।
পশ্চিম এশিয়ায় সংঘর্ষ ছড়িয়ে দিয়ে ইজরায়েল যে চূড়ান্ত ‘লক্ষ্য’ এখন হাসিল করতে চায়, তার রূপরেখা ২৭ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রসংঘে দিয়ে এসেছেন নেতানিয়াহু। মানচিত্র থেকে প্যালেস্তাইনকে মুছে দিয়ে বৃহত্তর ইজরায়েলের ছবি তিনি রাষ্ট্র সংঘে দেখিয়ে এসেছেন। ইজরায়েলের লক্ষ্য: প্যালেস্তিনীয়দের ঘেটোর মধে্য বন্দি করা এবং ইরানকে দুর্বল করা ও লেবানন-ইয়েমেন-ইরাক-সিরিয়ার প্রতিরোধের অক্ষটিকে ধ্বংস করা। হামাসের মতো হিজবুল্লা, হুথি, হাশাদ অাল-শাবি ইত্যাদি সংগঠনকে ধ্বংস করা ও অারব দেশগুলির রাজতন্ত্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনও ইজরায়েলের কৌশলের অঙ্গ। ইজরায়েল এটা বিশ্বাস করে যে, এই যুদ্ধের সাফল্য তাদের চ্যালেঞ্জহীন আঞ্চলিক শক্তি করে তুলবে। ইজরায়েল যদি এই অঞ্চলের চ্যালেঞ্জহীন শক্তি হয়, তাহলে তেলসমৃদ্ধ এই অঞ্চলে সুরক্ষিত থাকবে মার্কিন স্বার্থ। নার্ভাস অারব রাজতন্ত্রগুলি অনুগত থাকবে মার্কিন শক্তির। সেই কারণেই গাজার ‘গণহত্যা’-র শব্দ শোনার কেউ নেই মার্কিন মুলুকে।