shono
Advertisement
Lok Sabha Polls 2024

অমাবস্যার চাঁদ!

সুষ্ঠু ও অবাধ ভোটে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা।
Posted: 02:38 PM Apr 17, 2024Updated: 02:40 PM Apr 17, 2024

ভোটের মুখে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরির কথা বলেও গ্রেপ্তার হলেন সোরেন-কেজরিওয়াল। অগুনতি তদন্ত নোটিস পাঠানো হল বিরোধীদের। এহেন নির্বাচন কমিশনের আচরণ পোষা সারমেয়সুলভ মনে হলেও নরেন্দ্র মোদির মতে, সব সিদ্ধান্তই ‘দেশের স্বার্থে’– ‘কাউকে ভয় দেখানোর জন্য নয়’। তাঁর কথায়, দশ বছরে যা হয়েছে তা স্রেফ ‘ট্রেলার’। পিকচার আভি বাকি হ্যায়। লিখছেন সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় 

Advertisement

ভারতের নির্বাচন নিয়ে যে কোনও আলোচনায় দু’জনের নাম সবার আগে মনে পড়বেই। টি. এন. শেষন ও অশোক লাভাসা। দু’জনেই প্রমাণ করেছিলেন তঁারা সাহসী ও ব্যতিক্রমী। মেরুদণ্ড সোজা ছিল তঁাদের। শেষন ভাগ্যবান। গণতন্ত্রর চূড়ান্ত অধঃপতন ও আমলাশাহির গণ-সরীসৃপে রূপান্তরিত হওয়া তঁাকে দেখে যেতে হয়নি। অশোক লাভাসার ভাগ্য তঁার পূর্বসুরির মতো সুপ্রসন্ন নয়। অপমানিত ও নির্যাতিত হয়ে তঁাকে সরে যেতে হয়েছিল। সেই কাহিনিও ইদানীং কালের নির্বাচন কমিশনের রকমসকম দেখলে মনে পড়ে যায়।

মনে পড়ারই কথা। কারণ, নির্বাচন কমিশনার হিসাবে তিনি সাদাকে সাদা, কালোকে কালো বলার হিম্মত রেখেছিলেন। ২০১৯ সালের ভোটের প্রাক্কালে নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহ অন্তত পঁাচটি ক্ষেত্রে ‘আদর্শ আচরণবিধি’ ভেঙেছিলেন বলে তিনি মনে করেছিলেন। কিন্তু কমিশনের বাকি দুই সদস্য তা মনে করেননি। লাভাসা ‘ডিসেন্ট নোট’ দিয়েছিলেন। কিন্তু সেটাও প্রাতিষ্ঠানিক গোপনীয়তার যুক্তিতে প্রকাশ করা হয়নি। তথ্য জানার অধিকার আইন প্রয়োগ করেও নয়। অশোক লাভাসার কী হাল হয়েছিল তা-ও সবার জানা। টিকে থাকলে সুনীল অরোরার পর তিনিই হতেন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার।

লাভাসার স্ত্রী নভেল লাভাসাকে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে আয়কর নোটিস পাঠানো হয়েছিল। অভিযোগ, আয়ে অসংগতি। নভেম্বরে ‘এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট’ (ইডি) অশোকের পুত্র আবিরের সংস্থায় বিদেশি মুদ্রা আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে তদন্ত শুরু করে। আবির ছিলেন ওই সংস্থার ডিরেক্টর। ডিসেম্বর মাসে অশোকের ডাক্তার বোন শকুন্তলাকে পাঠানো হয়েছিল কর-ফঁাকির নোটিস। সেই মাসেই অশোক লাভাসা ইংরেজি দৈনিকে এক নিবন্ধে লিখেছিলেন, ‘এমন প্রত্যাশা ঠিক নয় যে, যাদের বিরোধিতা করা হচ্ছে তারা নম্রভাবে বিনম্রতার উত্থান মেনে নেবে। তারাও প্রত্যাঘাত করবে। সততার মূল্য দিয়ে পেতে হয় একাকিত্বের যন্ত্রণাবোধ। প্রকাশ্য বিচ্ছিন্নতাও। বন্ধু বা শত্রু উভয়ের কাছেই সততা ত্যাজ্য।’

[আরও পড়ুন: মমতার উত্তরসূরি কি অভিষেক? মুখ খুললেন তৃণমূল সুপ্রিমো]

এবারের ভোট আবহে সেই অশোক লাভাসা আবারও একটি নিবন্ধ লিখেছেন। তাতে তিনি নির্বাচন কমিশনকে মনে করিয়ে দিয়েছেন, আদর্শ নির্বাচনী আচরণবিধি বা ‘মডেল কোড অফ কনডাক্ট’ (এমসিসি) অটল-অনড় কিছু নয়। ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ বা সবার জন্য সমান সুযোগ করে দেওয়ার জন্য কমিশনের উচিত সময়-সময় আচরণবিধির সংস্কার। তিনি লিখেছেন, ‘এমসিসি যখন তৈরি হয়েছিল তখন তার রূপকারেরা রাষ্ট্রযন্ত্রের অপব্যবহার হবে ভাবেননি। এনফোর্সমেন্ট এজেন্সিদের অতিসক্রিয়তা সুস্থ গণতান্ত্রিক আচরণ লঙ্ঘন করছে কি না, তা ভেবে দেখা দরকার।’

আচরণবিধি চলাকালীন মুখে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরির কথা বলেও সোরেন-কেজরিওয়ালদের গ্রেফতার, বিরোধীদের অগুনতি তদন্ত নোটিস পাঠিয়ে হয়রান করায় সম্ভবত তিনি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। তাই কমিশনকে এসব মনে করিয়ে দিয়েছেন যাতে তারা শোধরায়। নিজেদের দায়িত্ব ও কর্তব্য বুঝতে পারে। যদিও এই চাহিদা কাকস্য পরিবেদনা। অভিষেক-রাহুলদের হেলিকপ্টারে তল্লাশি অন্তত তাই বোঝায়। ওই যে কথায় আছে না, ‘কানে দিয়েছি তুলো আর পিঠে বেঁধেছি কুলো’, নতুন ভারতের নির্বাচন কমিশন ঠিক তাই।

এখনকার সরকারি ভাষ্যে যিনি ‘গণতন্ত্রের কলঙ্ক’, সেই ইন্দিরা গান্ধীর দশার কথাও মনে করুন। এলাহাবাদ হাই কোর্টের বিচারপতি জগমোহন সিন্‌হা ’৭১ সালের নির্বাচন ঘিরে ইন্দিরার বিরুদ্ধে করা মামলার রায় দিয়েছিলেন ’৭৫ সালের জুনে। দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন ইন্দিরা। তঁার নির্বাচন খারিজ করে দেওয়া হয়েছিল যে-যে কারণে, সাম্প্রতিক পটভূমিতে সেগুলো একবার বিচার করে দেখুন। প্রথম কারণ, এমসিসি অনুযায়ী উত্তরপ্রদেশে ইন্দিরার জনসভার মঞ্চের উচ্চতা বেশি ছিল। দ্বিতীয় কারণ, সেই মঞ্চ তৈরি করেছিল উত্তরপ্রদেশ সরকার। সেখানে তারা জল ও বিদ্যুতের জোগান দিয়েছিল। অতএব, প্রশাসনকে কাজে লাগানো ও সরকারি অর্থ খরচের অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছিল।

 

[আরও পড়ুন: গোয়া নির্বাচনে ছিলেন আপের আর্থিক দায়িত্বে, লোকসভা ভোটের আগে ইডির হাতে গ্রেপ্তার সেই চনপ্রীত]

তৃতীয় কারণ, সরকারি আধিকারিককে ইন্দিরা দলীয় কাজে ব্যবহার করেছিলেন।এই তৃতীয় কারণের নায়ক ছিলেন যশপাল কাপুর। যশপাল কর্মরত ছিলেন পিএমও-তে। ইন্দিরার নির্বাচনী এজেন্ট হিসাবে নিযুক্ত হওয়ার আগে তিনি সেই পদে ইস্তফাও দিয়েছিলেন। কিন্তু নির্বাচনী জনসভায় ইন্দিরার ভাষণের আগে তঁার সেই ইস্তফাপত্র আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয়নি। ইন্দিরার ‘অপরাধী’ ঘোষিত হওয়ার অর্থ ছ’-বছরের জন্য নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে নির্বাসিত হওয়া। ১৯৭৫ সালের ১৯ মার্চ ইন্দিরাকে পঁাচ ঘণ্টা আদালতে কাটাতে হয়েছিল। জবাবদিহি করতে হয়েছিল। সেই বছর ১২ জুন ইন্দিরার নির্বাচন অবৈধ ঘোষিত হয় ‘আদর্শ নির্বাচনী আচরণবিধি’ লঙ্ঘনের অপরাধে। সুপ্রিম কোর্টে আবেদনের জন্য ইন্দিরাকে ২০ দিন
সময় দেওয়া হয়েছিল।

ইন্দিরা কালক্ষেপ না করে সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছিলেন। বিচারপতি ভি. কে. কৃষ্ণ আইয়ার (১৯৫৭ সালে কেরলের নাম্বুদ্রিপাদ সরকারের সেচমন্ত্রী) হাই কোর্টের রায়ে স্থগিতাদেশ দিয়েছিলেন। ২৫ জুন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা ‘জরুরি অবস্থা’ জারি করে দেন। একটু ভেবে দেখুন, আইন কিন্তু সেই একই আছে। একটুও বদলায়নি। ‘আদর্শ আচরণবিধি’-ও কঠোরতর হয়েছে। বাড়তি অনেক কিছু নিষিদ্ধ। যে-যে কারণে ‘একনায়ক ও স্বৈরতন্ত্রী’ ইন্দিরাকে আদালত দোষী সাব্যস্ত করেছিল, এখনকার কোনও আদালতের সেই হিম্মত আছে কি ‘লোকনায়ক ও গণতন্ত্রী’ নরেন্দ্র মোদিকে দোষী ঠাওড়ানোর? অশোক লাভাসা স্রেফ একটু
বেসুরো গেয়েছিলেন। পরিণতি সকলের জানা।

উদাহরণ আরও দেওয়া যায়। ১৯৮৭ সালে বাল ঠাকরেকে নির্বাচন কমিশন ছ’-বছরের সাজা দিয়েছিল। কারণ, তিনি হিন্দুদের বলেছিলেন, হিন্দুত্ববাদ প্রতিষ্ঠায় হিন্দু প্রার্থীকে ভোট দিতে। নরেন্দ্র মোদি ২০১৯ সালে ওয়ারধার জনসভায় ওয়ানাড়ে দঁাড়ানো রাহুল গান্ধীকে কটাক্ষ করে বলেছিলেন, কংগ্রেস সেই জায়গায় আশ্রয় নিতে চাইছে, যেখানে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠরাই সংখ্যালঘু। যেখানে শোভাযাত্রা দেখে বোঝা যায় না ভারতে আছি, না পাকিস্তানে! নির্বাচন কমিশন তঁার কেশাগ্রও স্পর্শ করেনি! বদলে যাওয়া এই নতুন ভারতে হ্যাটট্রিকের পর কী কী ঘটতে চলেছে, তার লম্বা ফিরিস্তি ‘মোদি কি গ্যারান্টি’-তে লিপিবদ্ধ। নতুন করে তা মনে করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। মোদি নিজেই বলেছেন, ‘এক দেশ এক ভোট’, ‘অভিন্ন দেওয়ানি বিধি’, ‘নাগরিকত্ব আইন’ এসব চালু হবেই। মুখ ফুটে বলেননি, তবে বোধগম্য এই সত্যি যে, অযোধ্যার পর কাশী ও মথুরার ‘মুক্তি’ না ঘটিয়ে তিনি ক্ষান্ত হবেন না। কিছু কিছু বিষয় থাকে হাতির অদৃশ্য দঁাতের মতো। দেখা যায় না। যদিও কাজ যে সাঙ্গ, বোঝা যায়।

 

[আরও পড়ুন: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ঘুম ছুটিয়েছিলেন শত্রুপক্ষের, ১০৩ বছরে প্রয়াত বায়ুসেনার প্রাক্তন কম্যান্ডার]

বাঘের আগমন বার্তা দেয় ফেউ। বিজেপিতে এমন ফেউয়ের অভাব নেই। ‘চারশো পার’ স্লোগানের অন্তর্নিহিত অর্থ কী এবং কেন তা প্রয়োজনীয়, সেই বার্তা ফেউ হয়ে প্রথম দিয়েছিলেন কর্নাটকের প্রাক্তন মন্ত্রী অনন্ত কুমার হেগড়ে। তারপর একে-একে একই কথা বলছেন রাজস্থানে বিজেপি প্রার্থী জ্যোতি মির্ধা, মিরাটের প্রার্থী অরুণ গোভিল, অযোধ্যার সাংসদ লাল্লু সিং-রা। চারশো পেরলেই সংবিধান সংশোধন। মোদি নিজে ‘বড় কিছু পরিকল্পনা’-র কথা শুনিয়েছেন যা ‘দেশের স্বার্থে’ তিনি নিতে চান, ‘কাউকে ভয় দেখানোর জন্য নয়’। তঁার কথায়, দশ বছরে যা হয়েছে তা স্রেফ ‘ট্রেলার’। মানে, পিকচার আভি বাকি হ্যায়।
বিজেপি ও সংঘ পরিবারের ‘হোয়াটসঅ্যাপ ফ্যাক্টরি’ গমগম করছে সেই বাকি থাকা পিকচার নিয়ে। তাদের কাছে চারশো পারের অর্থ– ওয়াক্‌ফ বোর্ড ও সংখ্যালঘু কমিশন তুলে দেওয়া, ধর্মস্থান আইন বাতিল, অভিন্ন শিক্ষা আইনের প্রবর্তন যাতে মাদ্রাসা শিক্ষা নিষিদ্ধ হয়, দুই সন্তান আইন প্রণয়ন, এনআরসি প্রয়োগের মাধ্যমে অবাঞ্ছিতদের পগারপার করা ইত্যাদি। তাদের কাছে সংবিধান সংশোধনের লক্ষ্য ‘সংখ্যাগরিষ্ঠের গণতান্ত্রিকতা’। সর্পাঘাত শিরে হলে শুধু নির্বাচন কমিশনে তাগা বেঁধে কী লাভ?

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

হাইলাইটস

Highlights Heading
  • লাভাসার স্ত্রী নভেল লাভাসাকে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে আয়কর নোটিস পাঠানো হয়েছিল।
  • বাঘের আগমন বার্তা দেয় ফেউ। বিজেপিতে এমন ফেউয়ের অভাব নেই।
  • ১৯৮৭ সালে বাল ঠাকরেকে নির্বাচন কমিশন ছ’-বছরের সাজা দিয়েছিল।
Advertisement