হিরু ওনোদা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ‘ইম্পেরিয়াল জাপানিজ আর্মি’-র তিনি ছিলেন সেকেন্ড লেফ্টেন্যান্ট। আমেরিকার প্রবল আক্রমণের মুখে তিনি আর তাঁর তিন সঙ্গী আশ্রয় নেন ফিলিপিন্সের লুবং দ্বীপে জঙ্গলে ঘেরা পাহাড়ি অঞ্চলে। তাঁরা রাতে ঘুমোতে যেতেন আর সকালে উঠতেন মনের মধ্যে এই বিশ্বাস নিয়ে যে, যুদ্ধ এখনও চলছে! শেষ পর্যন্ত ফিরলেন যখন, ৩০ বছরের বদলে যাওয়া পৃথিবীর সঙ্গে আর কিছুতেই মানিয়ে নিতে পারেননি ওনোদা। লিখছেন ঋত্বিক মল্লিক।
তাঁরা হার মানতে জানেন না। যুদ্ধ ছাড়া তাঁদের জীবনে আর কিছু নেই। সাম্রাজ্যের অধীশ্বর বা প্রভুই তাঁদের কাছে সব– তাই প্রাণ থাকতে ধরা দেন না তাঁরা। এই ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অধিকাংশ জাপানি যোদ্ধার মনোভাব। যুদ্ধ করতে করতে প্রাণ দিয়েছেন, কিংবা বিপদ বুঝে নিজেরই তরোয়ালের তীক্ষ্ণ ফলার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছেন, কিন্তু পরাজিত হয়ে সমর্পণের সাদা পতাকা তাঁরা দেখাতে চাননি কিছুতেই।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে জাপান প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া জুড়ে আগ্রাসন চালাতে থাকে এবং ১৯৪০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ফরাসি অধিকৃত ইন্দোচিন দখল করে নেয়। ১৯৪১ সালের একেবারে শেষের দিকে আমেরিকার পার্ল হারবার এবং কয়েকটি ব্রিটিশ উপনিবেশ আক্রমণ করায় সরাসরি যুদ্ধ বেধে যায়। এই সময় ‘ইম্পেরিয়াল জাপানিজ আর্মি’-র কয়েকটি ডিভিশনকে পাঠানো হয় হংকং, ফিলিপিন্স, থাইল্যান্ড, বার্মা, মালয় এবং ডাচ ইস্ট ইন্ডিজে। স্থলভাগে জাপানি সেনাবাহিনী শক্তিশালী হলেও জলপথে এবং আকাশপথে ‘মিত্রশক্তি’ বা বলা ভাল আমেরিকা, অনেক বেশি শক্তিশালী ছিল এবং জাপানের অধিকারে থাকা প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপগুলিতে প্রবল আক্রমণ চালায় এবং সাফ করে দেয় জাপানি সৈন্যদের ঘাঁটিগুলি। অল্প কয়েকজন জাপানি সৈন্য লুকিয়ে পড়ে এসব দ্বীপের দুর্ভেদ্য অরণ্যের ভিতর। ইতিমধ্যে আগস্ট মাসের প্রথমে হিরোশিমা আর নাগাসাকি অ্যাটম বোমে ধ্বংস হয়ে গেলে জাপানের রাষ্ট্রপ্রধান হিরোহিতো ‘মিত্রশক্তি’-র কাছে পরাজয় স্বীকার করে নেন এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান ঘটে।
এই প্রেক্ষাপটে আসব বিশেষ এক ব্যক্তির কথায়। নাম তাঁর হিরু ওনোদা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ‘ইম্পেরিয়াল জাপানিজ আর্মি’-র তিনি ছিলেন সেকেন্ড লেফ্টেন্যান্ট। সেই সময় তিনি ছিলেন ফিলিপিন্সের দায়িত্বে। আমেরিকার প্রবল আক্রমণের মুখে তিনি আর তাঁর তিন সঙ্গী আশ্রয় নেন ফিলিপিন্সের লুবং দ্বীপে জঙ্গলে ঘেরা পাহাড়ি অঞ্চলে। ঠিক করেন, এখান থেকেই চালিয়ে যাবেন তাঁদের লড়াই, সেই অপেক্ষাতেই কাটতে থাকে দিনের-পর-দিন। তবে এই ঘটনা যে শুধু হিরু ওনোদা-র সঙ্গেই ঘটেছে এমন নয়, বেশ কয়েকটি দ্বীপে গভীর জঙ্গলে লুকিয়ে ছিলেন আরও অনেক জাপানি সৈনিক।
এদিকে যে অ্যাটম বোম পড়েছে তাঁদেরই দু’টি শহরে, যুদ্ধ যে থেমে গিয়েছে জাপানের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে– এসব কোনও খবরই পৌঁছল না সেই গহন অরণ্যে। তাঁরা রাতে ঘুমোতে যান আর সকালে ওঠেন মনের মধ্যে এই বিশ্বাস নিয়ে যে, যুদ্ধ এখনও চলছে! মাঝে মাঝে হঠাৎই গুজব ছড়িয়ে পড়ে এসব দ্বীপের স্থানীয় মানুষের মধ্যে– জংলি পশুর মতো হিংস্র কয়েকটি মানুষ জঙ্গলের মধ্যে ঘুরে বেড়ায়। যারা জঙ্গলে শিকার করতে যায়, তাদের মধ্যে কেউ কেউ দেখেছে এই মূর্তিমান অশুভ লোকগুলিকে। এই কথা একদিন পৌঁছল পশ্চিমের দেশগুলিতে, কিন্তু যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে তখন তারা ব্যস্ত নতুন করে দেশ গড়ে তোলার কাজে। এই গুজবে কান দিল না কোনও দেশ, বরং স্থানীয় লোকেদের বোকামি ভেবেই তারা উপেক্ষা করল।
প্রথম যিনি এই গোপন ঘাঁটি থেকে বেরিয়ে এলেন, তাঁর নাম ইতো মাসাশি, যুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও ১৬ বছর ধরে তিনি ছিলেন পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরের গুয়াম দ্বীপে। রাজার ডাক আসবে তাঁর কাছে, এই অপেক্ষায় ছিলেন ১৯৬১ সাল পর্যন্ত, তারপর যখন ফিরে এলেন, দেখলেন গোটা পৃথিবীটাই গিয়েছে বদলে। এভাবে একদিন দেখা মিলল শোইচি ইয়োকোই-এর। তখন ১৯৭২ সাল, গুয়াম দ্বীপেরই একদল শিকারি ধরে ফেলল ৫৮ বছরের ইয়োকোই-কে। এই শিকারির দল তাঁকে বোঝাল যে, তাঁর এই আত্মগোপন করে থাকার আর কোনও অর্থই হয় না। তাদের মুখে জাপানের অবস্থা শুনে কান্নায় ভেঙে পড়লেন ইয়োকোই। হাসপাতালে কিছু দিন চিকিৎসার পর যখন তঁাকে বলা হল, জাপানে ফিরে যাওয়ার জন্য আসছে জেট, তখন অবাক হয়ে তিনি জানতে চান, জেট কী পদার্থ? তত দিনে জাপানে সাধারণ জনমতের চাপে সরকার বাধ্য হল এই পুরনো যোদ্ধাদের দেশে ফিরিয়ে আনতে। এই প্রচেষ্টারই পোশাকি নাম ‘অপারেশন চেরি ব্লসম’। টন টন লিফলেট ফেলা হল ফিলিপিন্স দ্বীপগুলিতে এবং অন্যান্য জায়গায়, একসময় যেসব দ্বীপে দাপিয়ে বেড়াত জাপানি সৈনিকরা। কিন্তু এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হল, একজনও সাড়া দিল না। তাঁরা তখনও ভাবছিলেন যে, এই লিফলেট আসলে আমেরিকান আর ব্রিটিশদের পাতা একটা ফাঁদ। যুদ্ধ এখনও চলছে, তাই কোনও প্ররোচনায় পা দেওয়া যাবে না।
আবার ফিরি হিরু ওনোদা-র কথায়। পাহাড়ি জঙ্গলে তিনজনে মিলে চালিয়ে যেতে থাকলেন গেরিলা লড়াই। কলা, নারকেল, চুরি করে আনা চাল, বিভিন্ন গাছের শিকড়বাকড় চিবিয়ে খাওয়া আর মাঝে মাঝেই সাপের মাংস– এই দিয়েই চলছিল তাঁদের দিন। প্রথম দিকে শত্রুপক্ষ স্থানীয় লোকেদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কুকুর নিয়ে খুঁজতে আসত। মাটিতে গর্ত খুঁড়ে জঙ্গলের পশুদের মতো তাঁরা থাকতেন আর গর্তের মুখ ঢেকে দিতেন ডালপালা দিয়ে। কয়েক দিন অন্তর পাল্টে যেত তাঁদের এই আস্তানা। কখনও জিভ দিয়ে অদ্ভুত আওয়াজ করে, কখনও-বা হাতের বিভিন্ন মুদ্রা দিয়ে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের এক নতুন ভাষার উদ্ভাবন করেছিলেন তাঁরা; আর মাঝেমধ্যেই গুলির লড়াই চলত স্থানীয় লোকেদের আর পুলিশের সঙ্গে। এটা ঠিক যে, তাঁরা আমেরিকান আর ফিলিপিনো সার্চ পার্টির চোখে ধুলো দিয়ে জায়গা বদল করে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছিলেন, কিন্তু ভুল করে সাধারণ গ্রামের লোককে শত্রু ভেবে আক্রমণ করে মেরেও ফেলেছিলেন প্রায় ৩০ জন মানুষকে। যে তিনজন তঁার সঙ্গে ছিলেন, তার মধ্যে একজন ১৯৫০ সালে আত্মসমর্পণ করলেন আর ১৯৫৪ সালে মারা গেলেন আর-একজন।
হিরু ওনোদা-র হাতে পড়েছিল জাপান সরকারের লিফলেট, কিন্তু কোনও ভাবান্তর ঘটেনি তাঁর। এর অনেক আগে ১৯৫২ সালে তাঁদের পরিবারের পক্ষ থেকে চিঠি লেখা হয় এবং ফোটোগ্রাফসুদ্ধ সেই চিঠি আসে তাঁদের হাতে। কিন্তু এটাও শত্রুপক্ষের একটা চালাকি হিসাবেই দেখেছিলেন তাঁরা। যাই হোক, ১৯৭৪ সালে জাপানি অ্যাডভেঞ্চারার নোরিও সুজুকি সারা পৃথিবী ঘুরতে ঘুরতে আসেন লুবং দ্বীপে এবং এখানে আসার লক্ষ্যই ছিল হিরু ওনোদা-র খোঁজ। দেখা হল শেষ পর্যন্ত আর অনেক পরে ওনোদা স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, ‘This hippie boy, Suzuki, came to the island to listen to the feelings of a Japaese soldier.’ মুহূর্তেই বন্ধু হয়ে যান দু’জনে, তবু এই সুজুকি-র কথাতেও রাজি হননি বেরিয়ে আসতে তাঁর গোপন ঘাঁটি ছেড়ে। সুজুকি-কে বলেছিলেন, একমাত্র মেজর ইয়োসিমি তানিগুচি-র আদেশেই তিনি বেরিয়ে আসতে পারেন, কারণ তিনিই ছিলেন তাঁর ইমিডিয়েট বস।
সুজুকি জাপানে ফিরলেন ওনোদা-র ছবি নিয়ে এবং সরকারকে জানালেন ওনোদা-র ইচ্ছের কথা। এদিকে যুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পর তানিগুচি বইয়ের ব্যবসা শুরু করেছিলেন এবং সেই ব্যবসায় তিনি তখন বেশ প্রতিষ্ঠিত। সুজুকি যোগাযোগ করেন তানিগুচি-র সঙ্গে, সবকিছু শুনে তানিগুচি আর সুজুকি রওনা হন লবং দ্বীপে। শেষ পর্যন্ত ১৯৭৪ সালের ৯ মার্চ তাঁরা দেখা করেন ওনোদা-র সঙ্গে। তানিগুচি-র কথায় এবং আদেশে আশ্বস্ত হন ওনোদা। তারপর তিনি ফিরে গেলেন জঙ্গলের মধ্যে চিহ্নিত করা এক বিশেষ জায়গায়, মাটি খুঁড়ে তুলে আনলেন তাঁর পবিত্র সামুরাই তরোয়াল, ১৯৪৫ সালে যেটি মাটিতে পুঁতে লুকিয়ে রেখেছিলেন। অনুমতি চাইলেন এই তরোয়ালটি সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার। জাপানে ফিরে এলে তাঁকে জাতীয় বীরের সম্মানে বরণ করে দেশবাসী, তিনিও আত্মসমর্পণের প্রতীক হিসাবে তৎকালীন প্রেসিডেন্টের হাতে আনুষ্ঠানিকভাবে তুলে দেন তাঁর সেই পবিত্র সামুরাই তরোয়াল।
যদিও, এই ৩০ বছরের বদলে যাওয়া পৃথিবীর সঙ্গে কিছুতেই আর মানিয়ে নিতে পারেননি ওনোদা। বাধ্য হয়ে তঁাকে পরামর্শ নিতে হল মনোবিদের। চার মাস ধরে চলল তাঁর চিকিৎসা। সেই সময় চিকিৎসকদের কাছে ঘুরে-ফিরে একটাই কথা বলতেন তিনি, ‘আমি জানি এখনও আমার বেশ কয়েকজন সহযোদ্ধা লুকিয়ে আছেন পাহাড়ে, জঙ্গলে। আমি জানি কোথায় তাঁরা আছেন, এবং তাঁদের যোগাযোগের গোপন ডাকগুলোও জানি। কিন্তু আমার ডাকে বা আমার কথায় তাঁরা বেরিয়ে আসবে না। তাঁদের এখনও মনে হবে আমি বোধহয় মানসিকভাবে ক্লান্ত হয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছি।’ বয়স বেড়েছে তাঁদের, জঙ্গলের ভয়াবহ কষ্টের জীবন আর প্রাত্যহিক লড়াইয়ে একদিন তারা হার মানবেন। দিন-রাত তাঁর মনে হত, ‘They will unfortunately die in those hills.’ এই সত্যিকারের শান্তির দিনগুলো তাঁদের মিথ্যে যুদ্ধের ভয়ের আড়ালেই রয়ে গেল, চিরতরে।
নো সারেন্ডার: মাই থার্টি-ইয়ার ওয়ার
হিরু ওনোদা
অনুবাদ: চার্লস টেরি
কোদান্শা ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড
টোকিও, নিউ ইয়র্ক অ্যান্ড
সান ফ্রান্সিসকো, ১৯৭৪
