shono
Advertisement

সর্বগ্রাসী আধিপত্যবাদে আচ্ছন্ন দেশের সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক কাঠামো

বহু স্বরের প্রসৃতি ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে।
Posted: 03:34 PM Dec 22, 2023Updated: 03:34 PM Dec 22, 2023

স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে এই প্রথম, নির্বাচন কমিশনার মনোনয়ন ও নিয়োগ-সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট বিধি প্রণয়ন হল– যেখানে নিয়োগ প্রক্রিয়া থেকে সরানো হল সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিকে। আশঙ্কা অমূলক নয় যে, প্রধানমন্ত্রী বা কেন্দ্রের শাসক পক্ষের বেছে নেওয়া সদস্যরাই যাতে নির্বাচন কমিশনের শীর্ষ পদে আসীন থাকেন, তা সুনিশ্চিত করার জন্যই এই বন্দোবস্ত। কলমে দেবাশিস পাঠক

Advertisement

 

ক সর্বগ্রাসী আধিপত্যবাদ আচ্ছন্ন করছে স্বদেশের সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক কাঠামোর আকাশ। বহু স্বরের প্রসৃতি ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে। এতদিন একটু গা বাঁচিয়ে টিকে ছিল নির্বাচন কমিশন। এবার রাজ্যসভায় একটি বিল পাশ হয়েছে। সেই বিল বা অধ্যাদেশটির নাম–‘চিফ ইলেকশন কমিশনার অ্যান্ড আদার ইলেকশন কমিশনারস’(অ্যাপয়েন্টমেন্ট, কন্ডিশন্‌স অফ সার্ভিসেস অ্যান্ড টার্মস অফ অফিস) বিল ২০২৩। লোকসভায় যদি বিলটি পাশ হয়, তবে নির্বাচন কমিশন নামক সংস্থাটি পুরোপুরি কেন্দ্রীয় সরকারের হাতের মুঠোয় চলে যাবে। কারণ, এই বিলে মুখ্য নির্বাচন কমিশনার ও অন্য দুজন নির্বাচন কমিশনারের নিয়োগ পদ্ধতি সুনির্দিষ্টভাবে আলোচিত হয়েছে। এবং সেই পদ্ধতিতে কেন্দ্রীয় সরকারের অবিসংবাদিত আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত। বলতে অসুবিধা নেই, সংবিধান-প্রণেতারা সাংবিধানিক নীতি থেকে যাতে ‘ভারত’ নামক রাষ্ট্র কোনওভাবে বিচ্যুত না হয়, সেজন্য যে লৌহবাসরটি নির্মাণ করেছিলেন, তাতে একটি ছিদ্র থেকে গিয়েছিল। সময়মতো সেটি ব্যবহার করে কালনাগিনীর অনুপ্রবেশের ব্যবস্থা করে দিল মোদি-শাহ পক্ষ। নির্বাচন কমিশন নামক সংস্থাটিকে সর্বতোভাবে কুক্ষিগত করার আয়োজন, এতদিনে সত্যিই সুচারুরূপে সম্পন্ন হল।

সংবিধানের ৩২৪ নম্বর ধারা। সেখানে সুস্পষ্টভাবে বলা আছে, ভারতের নির্বাচন কমিশন তিনজন সদস্য দ্বারা গঠিত হবে। একজন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার, এবং দুজন নির্বাচন কমিশনার থাকবেন। এই নির্বাচন কমিশনারগণ, তিনজনেই, সংসদে প্রণীত আইন-মোতাবেক রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হবেন। ব্যস, এইটুকুই। সংবিধানে নির্বাচন কমিশন গঠনের বিষয়ে তদতিরিক্ত কিছু বলা নেই। এই অনুক্ত, অনুচ্চারিত প্রতিবেশ-ই বর্তমান সরকার পক্ষের নিজস্ব অভিপ্রায় পূরণের সুযোগ করে দিল। এতদিন সংসদে প্রণীত আইন, নির্বাচন কমিশনার বর্গের কার্যকাল, কর্মবিধি ইত্যাদি বিষয়ে সুস্পষ্ট দিশা দেখাচ্ছিল। কিন্তু নির্বাচন কমিশনকে নিরপেক্ষ রাখার বন্দোবস্ত কী হবে, সে-বিষয়ে সরাসরি কিছু বলা ছিল না। ফলে, কেন্দ্রীয় সরকারের সুপারিশ মেনে রাষ্ট্রপতি কাদের নির্বাচন কমিশনার হিসাবে নিয়োগ করবেন, সে-সংক্রান্ত কোনও স্পষ্ট দিশা বা বিধিও ছিল না। ২০১৫-এ অনুপ বারানওয়াল একটি জনস্বার্থ মামলা রুজু করে শীর্ষ আদালতের কাছে আর্জি জানান, সুপ্রিম কোর্ট একটি নিরপেক্ষ, কলেজিয়াম ব্যবস্থা তৈরির নির্দেশিকা জারি করুক, যাতে নির্বাচন কমিশনারের নিরপেক্ষতা সম্পূর্ণভাবে রক্ষিত হয়। গত ৭৩ বছরে নির্বাচন কমিশন নিয়োগ-সংক্রান্ত কোনও আইন সংসদ প্রণয়ন করেনি।

[আরও পড়ুন: মোদিকে রুখতে কোন টোটকা? ইন্ডিয়া জোটের ‘বিজয়মন্ত্র’ কী?]

সুস্থ গণতন্ত্রের স্বার্থে, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য, নির্বাচন কমিশনারের নিরপেক্ষতা একটি অত্যন্ত জরুরি ও আবশ্যিক শর্ত। সেজন্যই এই আরজি এত গুরুত্বপূর্ণ। জাতীয় ও রাজ্য মানবাধিকার কমিশন, সিবিআই, তথ্য কমিশন, লোকপাল– এসব সংস্থার গঠনবিধি পর্যবেক্ষণ করে সুপ্রিম কোর্ট নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক স্বাধীনতা রক্ষা করার উদ্দেশে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের ব্যাপারে একটি বিধি প্রণয়ন করে ফেলে। অতীতে ১৯৯০-এ নির্বাচনী সংস্কার বিষয়ক দীনেশ গোস্বামী কমিটি একটি সুপারিশ করেছিল। ২০১৫-এ আইন কমিশন তাদের ২৫৫তম প্রতিবেদনে সেই সুপারিশকে মান্যতা দেয়। সেই সুপারিশে প্রদত্ত নিয়োগসূত্রকে মান্যতা দিয়ে সুপ্রিম কোর্ট বলে, নির্বাচন কমিশনারদের বাছাই করার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হবে। তাতে থাকবেন দেশের প্রধানমন্ত্রী, লোকসভার বিরোধী দলনেতা অথবা বৃহত্তম সরকার-বিরোধী দলের নেতা, আর শীর্ষ আদালতের প্রধান বিচারপতি।

সংবিধানের ১৪২ ধারা অনুসারে সুপ্রিম কোর্ট এই নির্দেশিকা জারি করে আরও বলে, যতদিন সংসদ এবিষয়ে নতুন কোনও আইন প্রণয়ন করছে না, ততদিন অবধি এরকম একটি কমিটির মাধ্যমেই নির্বাচন কমিশনার ত্রয়ীকে বেছে নেওয়া হবে। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের সেই নির্দেশ নস্যাৎ করে দিয়ে নতুন একটা ব্যবস্থা আনল মোদি-পক্ষ। এই নয়া সুপারিশে বলা হল, মুখ্য নির্বাচন কমিশনার ও অপর দুজন নির্বাচন কমিশনার হওয়ার আবশ্যিক শর্ত হল, তাঁদের ভারত সরকারের সচিব বা সম-পর্যায়ের আধিকারিক হতে হবে। আইনমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি সার্চ কমিটি থাকবে– যারা ওই পদগুলির উপযুক্ত পাঁচজন আধিকারিককে বাছাই করে একটি প্যানেল বানাবে। সেই প্যানেল থেকে কোন তিনজন শেষ পর্যন্ত পদ তিনটিতে আসীন হবেন, সেটা ঠিক করবে একটি কমিটি। সেই কমিটিতে থাকবেন দেশের প্রধানমন্ত্রী, লোকসভার বিরোধী পক্ষের নেতা এবং ক্যাবিনেট পর্যায়ের একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী যিনি অন্য কারও নন, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর দ্বারা মনোনীত হবেন।

[আরও পড়ুন: নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ, দায় কার?]

স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে এই প্রথম, সংসদ নির্বাচন কমিশনার মনোনয়ন ও নিয়োগ সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট বিধি প্রণয়ন করল এবং সেই বিধিতে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ সংক্রান্ত প্রক্রিয়া থেকে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিকে সরিয়ে দেওয়া হল। অথচ, অনুপ বারানওয়ালের মামলার প্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া নির্দেশে দেশের শীর্ষ আদালতের প্রধান বিচারপতির উজ্জ্বল উপস্থিতি লক্ষিত হয়েছিল নির্বাচন কমিশনার বাছাই-সংক্রান্ত কমিটিতে। আশঙ্কা অমূলক নয় যে, প্রধানমন্ত্রী বা কেন্দ্রীয় শাসক পক্ষর বেছে নেওয়া সদস্যরাই যাতে নির্বাচন কমিশনের শীর্ষ পদগুলোতে বসতে পারেন, তা সুনিশ্চিত করার জন্যই এই বন্দোবস্ত। তিনজনের কমিটিতে দুজন, প্রধানমন্ত্রী নিজে ও তাঁর মন্ত্রিসভার একজন সদস্য, যাঁকে বাছবেন তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের সচিব পর্যায়ের একজন আমলা। তিনি বিরোধী পক্ষের অপছন্দের ব্যক্তি হলেও কিছু যায় আসে না। ২:১ অনুপাতে তাঁর নামটি তো অনুমোদিত হবেই! আর নির্বাচন কমিশনার হিসাবে মনোনীত হওয়ার পর তিনি যে কেন্দ্রীয় সরকারের অঙ্গুলিহেলনেই চলবেন, সেটাও মোটামুটি নিশ্চিত। কারণ, নিয়োগকর্তাকে কে আর অসন্তুষ্ট করে তাঁর বিরাগভাজন হতে চায়?

এরকম একটা সম্ভাবনার বৃত্তে দাঁড়িয়ে দেখে নেওয়া যেতে পারে, অন্যান্য দেশে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ-সংক্রান্ত বিধি কীরকম? দক্ষিণ আফ্রিকায় নির্বাচন কমিশনার বাছাইয়ের পদ্ধতিতে অংশ নেন সাংবিধানিক আদালত বা কনস্টিটিউশনাল কোর্টের প্রেসিডেন্ট ও মানবাধিকার ও লিঙ্গসাম্য রক্ষাকারী কোর্টের প্রতিনিধিবর্গ। যুক্তরাজ্যে হাউস অফ কমন্‌স (সে-দেশের লোকসভা) নির্বাচন কমিশনের সদস্য কারা হবেন তার অনুমোদন প্রদান করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচন কমিশনের সদস্যদের নিয়োগ করেন সে-দেশের প্রেসিডেন্ট, তবে সেই নিয়োগে সিলমোহর দেয় সেখানকার সেনেট। আমাদের দেশে রাজ্যসভায় সম্প্রতি পাশ হওয়া বিলটি যদি লোকসভাতেও পাশ হয়ে যায় তবে নির্বাচন কমিশনারের নিয়োগ প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের বদলে একটি কমিটির সিদ্ধান্তে পরিণত হবে এবং সেই সিদ্ধান্ত ক্ষমতাসীন সরকার পক্ষের অনুকূলে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা।

সিবিআইয়ের মতো কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার শীর্ষপদে কর্মকর্তা বাছাইয়ের ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির ভূমিকা থাকা সত্ত্বেও সংস্থাটির নিরপেক্ষতা নিয়ে সবসময়ই সংশয় সন্দেহ রয়ে গিয়েছে। আর, এবার নির্বাচন কমিশনার বাছাইয়ের ক্ষেত্রে তো সেই বালাইটুকুও রইল না। নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে জনগণ আর নিঃসংশয় থাকতে পারবে কি? বোধ হয় না। সেই সম্ভাবনা মোদি জমানার সৌজন্যে অবশেষে অস্তমিত হল। বিরোধীরা, নিন্দুকরা, আশঙ্কিত ভারতীয় নাগরিকরা, প্রত্যেকে সম্ভবত ঠিকই বলছেন। একে-একে নিভেছে দেউটি। এক বিরাট দৈত্য যেন ফুঁ দিতে দিতে একটা-একটা করে প্রজ্জ্বলিত শিখা নেভাতে নেভাতে এগিয়ে চলেছে।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement