হালের গালভরা শরতে ‘থিম বনাম সাবেক’ দ্বন্দ্বই হয়ে উঠেছে চিরন্তনী। জনসাধারণের ধারণা, দুর্গাপুজোয় ‘থিম’ এসে ‘সাবেকিয়ানা’-র নিকেষ ঘটাল। সত্যিই কি তাই? লিথছেন শোভন তরফদার।
আচমকা জানা গেল, এলসিনোর দুর্গে হ্যামলেটের প্রয়াত পিতাঠাকুরের ভৌতিক প্রতিচ্ছবি নাকি ঘোরাফেরা করে। দুর্গপ্রাকার থেকে দেখাও গেল, অঁাধার অম্বরে তাঁর বিচরণ। ডেনমার্কের যুবরাজ, স্বাভাবিকভাবেই, কৌতূহলী। ঠিক করলেন, লোকমুখে শুনে কী লাভ, বরং নিজেই দেখা করবেন সেই পিতৃপ্রেতের সঙ্গে। তারপর কী হয়েছিল, সকলেরই জানা। সুতরাং, সেই বৃত্তান্তে প্রবেশ নিরর্থক। তার চেয়ে বরং অন্য একটি সম্ভাবনায় উঁকি দেওয়া যাক। কীরকম?
ধরা যাক, পুজোর সময় এই বার্তা রটে গেল ক্রমে যে, দিগন্তে বারংবার নাকি সাবেকিয়ানার দেখা মিলছে। ফিরে আসছে ফেলে-আসা কাল। জ্যান্ত হয়ে উঠছে অতীত। এদিকে ‘থিম’-পুজোর লগ্ন সমুপস্থিত। বলতে গেলে, ‘থিম’-এরই তো বাজার। কিছু মণ্ডপে অমুক মন্দির বা তমুক ভবনের প্রতিলিপি এখনও তৈরি হয় বটে, কিন্তু অধুনা সেগুলি একটু পুরনো ধাঁচের ‘থিম’। তা হলে নবতন ধাঁচটি কীরকম? বিষয়-ভাবনা। বৃহদাকার পুজোগুলি যদি সরিয়েও রাখা যায়, এমনকী, হরিপদ কেরানির পাড়াতেও দেখা যাবে, দুর্গাপুজোর মণ্ডপে কোনও না কোনও বিষয়-ভাবনার প্রতিচ্ছবি। এমনই এক (বিচিত্র) পরিস্থিতিতে, ধরা যাক, গঙ্গার নির্জন কোনও ঘাটে সাবেকিয়ানার সঙ্গে থিম-এর দেখা হল। তখন? কীরকম কথা চালাচালি হতে পারে দু’জনের মধ্যে?
ইচ্ছা করলে পাঠক সেই কাল্পনিক সংলাপটুকু যে-যার মতো লিখে নিতে পারেন। তবে, এই দুয়ের মধ্যে ‘নারদ-নারদ’ বাধিয়ে দেওয়াটা কি সংগত হবে? বরং, তর্কটাকে কিঞ্চিৎ ঘুরিয়ে যদি বলা যায়, সাবেকিয়ানাই কি ঘুরপথে থিমাকারে ফেরত আসছে, সেই যুক্তি সহসা উড়িয়ে দেওয়া কঠিন।
২
সাদা চোখেই ধরা পড়ে, দুর্গাপুজোর সময় জনতারূপী কনজিউমারের (কিংবা, কনজিউমার-রূপী জনগণ) তথাকথিত শিকড়ের টান প্রবল। কুলো থেকে কুনকে গোছের বিচিত্র হরেকরকমবা যা একদা বঙ্গজীবনের অঙ্গ হলেও কালক্রমে (অন্তত মহানগর-পরিসরে) কার্যত ঝাপসা, তারাই যখন ফিরে আসে, কেউ ললিতে কেউ বিভাসে; স্পষ্ট ধরা যায়, যাত্রাপথ ক্রমেই আরও বেশি করে স্মৃতিলীন, নামান্তরে শিকড়-সন্ধানী হতে চাইছে। জনপ্রিয় এক গান যেমন বলেছিল, ‘গভীরে যাও, আরও গভীরে যাও’– অনেকটা সেরকমই যেন আহ্বান। যেন দু’হাত বাড়িয়ে বলছে– আসুন, ঐতিহ্যের এই তালাশটুকু উদ্যাপন করি। খুঁজে দেখি, ঠিক কোথায় হৃদয়েতে পথ কাটল স্মৃতি। আসুন, সবাই মিলে উদ্যাপন করা যাক এই বিধুর নস্টালজিয়া, কারণ এই উৎসবকালে স্মৃতিই তো সত্তা। একান্ত নিজস্ব সত্তা।
তবে কিনা, খিটকেল তো কম নয়। কারণ, প্রশ্নও কম নয়। কোনটা নিজস্ব? কোনটা-ই বা পরস্ব? কেন তাদের নিজ-স্ব এবং পর-স্ব বলে ধরে নেওয়া হবে? যে-ঐতিহ্যের স্মৃতিতে জনতা আতুর, তলিয়ে দেখলে সেটি ঠিক কোন বাঙালির ঐতিহ্য? সেই ঐতিহ্যে হাসিম শেখ বা রামা কৈবর্ত আছে তো? থাকতে পারে তো? খুঁড়তে-খুঁড়তে গভীরে গেলে এই সকল জিজ্ঞাসা মাথাচাড়া দেবেই। তখন আবার ভাবতে হবে, কতটা গভীরে যাব? কেনই বা যাব? বাজার যেভাবে এই গভীর-চারণাকে প্ররোচনা দিয়ে (ভাষান্তরে ‘ট্রিবিউট’ জানিয়ে) চলেছে, সেই তরিকাগুলি একটু তলিয়ে দেখা প্রয়োজন নয় কি? এক লহমা থেমে এসব প্রশ্ন নিয়ে সামান্য নাড়াচাড়া করা তো দরকার।
অবশ্য এখন এই পুজোর সময় চতুর্দিকে যা পরিস্থিতি, ঢাকের তালে কোমর দোলে, খুশিতে নাচে মন, তাতে খুব একটা তলিয়ে ভাবার সময় পাওয়া মুশকিল। এমতাবস্থায় ওসব (ঈষৎ জটিল, এমনকী তিতকুটে) প্রশ্নমালা উত্তরের অপেক্ষায় থাকুক বরং। এটাও বেশ স্বচ্ছন্দেই ভুলে থাকা যাক যে, ওই যে বিশাল দুর্গাদালান, ভারী সোনার গয়না, দৈত্যাকার দীপাধার দেখে জনতা (মুখ্যত বঙ্গভাষী হিন্দু মধ্যবিত্তজন) আপ্লুত, সেসব বিশেষ একটি শ্রেণি-পরিচয় বহন করে। কৌমের অতীতবিলগ্ন হওয়ার প্রবল বাসনাবশত অঁাখি ছলোছলো হতেই পারে, কিন্তু এটা তো অস্বীকার করা মুশকিল যে, আকঁাড়া বাঙালি বলে তো কিছু হয় না। ওই জমিদারি দুগ্গাপুজো বাঙালির পরিচয়জ্ঞাপক, তাতে সন্দেহ নেই, তবে সেই বাঙালি কোন বাঙালি, তাদের প্রেক্ষাপটটুকু কী ছিল, সেগুলোও তো একটু-আধটু ভাবার বিষয়। বাজার এবং বিজ্ঞাপন একমাত্রিক ধঁাচে বঙ্গ-সত্তা নির্মাণ করতেই পারে, সেটা তাদের বাণিজ্যের সুবিধাগত প্রশ্ন, কিন্তু তাতে তো আর এই কথাটা ফিকে হতে পারে না যে, ‘বাঙালি’ শব্দের ভিতরেই বহুবিধ স্তর বিদ্যমান, দুম করে একঢালা কোনও ছঁাচে তাদের বন্দি করা অসম্ভব এবং অসংগত।
পুজোর প্রবল আলোকচ্ছটায় এসব কথা অবশ্য চোখে পড়বে কি না, বলা মুশকিল। তবে, ভাবা যদি প্র্যাকটিস করতেই হয়, পুজো থেকেই শুরু করা ভাল। তখন ধরা যাবে, কীভাবে আধুনিকতার ক্রমিক ঝলমলানি এবং ঐতিহ্য-বিলগ্ন টান নির্বিবাদে একে অন্যের হাত ধরছে, কীভাবে ‘থিম’-এর রূপায়ণে দুগ্গাঠাকুরের হাত ধরছে টেকনো-ম্যানিয়া, বঁাশের শরীর ছুঁয়ে শোভা পাচ্ছে এলইডি বোর্ড, কীভাবে এগিয়ে চলেছে সাবেকিয়ানার প্রবল সেলিব্রেশন– কোথাও সত্যিকার জমিদারবাড়িতে, কোথাও বঁাশ-কাপড়-বাটামে বানানো নাটমন্দিরে। গভীরে তো এদের মধ্যে কোনও বিরোধ নেই। সব পথ এসে মিলে গেল শেষে তোমার
দু’খানি নয়নে।
৩
‘সাবেকিয়ানা’-র সঙ্গে যখন ‘থিম’-এর দেখা হল, তখন অচিরেই জমে গেল আড্ডা। কথাবার্তা কী কী হয়েছিল, সেগুলি বিভিন্ন পাঠক বিভিন্ন ভাবে কল্পনা করে নিতে পারেন। আপাতত, এই লেখার শেষ পর্বে সেই কথা-চালাচালির একটা কাঠামো দেওয়া থাক। এটি অবশ্য একটি কাঠামো, মোটেই একমাত্র নয় (তাছাড়া শেষ কথা বলবেই বা কে!)
সাবেকিয়ানা: ওহে থিম, তোমার তো অসাধ্য সাধন হে! শূন্যতা, বিচ্ছেদ, প্রতীক্ষা এমন সব ভাব তো নিরাকার। তোমার মণ্ডপ, আলো, ধ্বনি, সবকিছুই দর্শকের মনে সেই বিমূর্ত অনুভূতি জাগাতে চায়। শুধু তাই না, সেটাও আবার করতে হয় সরাসরি কিছু মূর্তির আকার মাথায় রেখে। দুগ্গাঠাকুর, তঁার চারটি সন্তান, ওদিকে অসুর, তাছাড়া বাহন-টাহন এসবের কথা মাথায় রেখে! এ তো অসম্ভব কাজ হে!
থিম: আজ্ঞে, ঠিকই বলেছেন। আপনাকে আর কী ধন্যবাদ দেব? তবে, সেভাবে দেখলে আপনিও তো বিমূর্তের কারবারি, তাই না?
সাবেকিয়ানা: কীরকম?
থিম: মানে, আপনিও তো লোকের মনে জাগিয়ে তুলতে চান স্মৃতি। সোনালি কোনও অতীতের স্মৃতি। সেই স্মৃতি যার কিছু আদল আছে বটে, তবে অনেকটাই তো বিমূর্ত। মানে, যাকে লোকজন কখনও ‘বাঙালিয়ানা’ বলে, কখনও ঐতিহ্য বলে, কখনও ‘গৌরব’ বলে...
সাবেকিয়ানা: (হাস্য) পাস্ট পারফেক্ট টেন্স বলে!
থিম: (হাস্য) যা বলেছেন! তবে, লোকজনের ধারণাটা কী জানেন? আমি এসে নাকি আপনাকে হটিয়ে দিয়েছি! কী করে বোঝাব, হটিয়ে দেওয়া দূরস্থান, সত্যি বললে আমি তো আপনাকে আপন করে নিয়েছি।
সাবেকিয়ানা: আমরা একে-অন্যের ভিতরে ঢুকে পড়েছি বললেও ভুল
হবে না। আমি যে কে তোমার, তুমি তা বুঝে নাও।
থিম: থিমে সাবেকিয়ানা এবং সাবেকিয়ানাও থিম।
সাবেকিয়ানা: শুনহ বাঙালি ভাই, সবার উপর বাজার সত্য, তাহার উপর নাই। (উভয়ের হাস্য)
তারপর এই দু’জনের মধ্যে আরও কিছু কথা হয়েছিল। সেগুলি নদীস্রোতে, জলের আখরে লেখা। উৎসাহীরা খুঁজে দেখতে পারেন।
(মতামত নিজস্ব)
লেখক সাংবাদিক
sovan.eisamay@gmail.com