shono
Advertisement

সম্পাদকীয়: খেলা শেষ, না খেলা শুরু?

বাংলায় বিরোধী দলের ভূমিকায় চরম দক্ষিণপন্থী দল। সচেতন হতে হবে মমতাকে।
Posted: 02:35 PM May 04, 2021Updated: 02:35 PM May 04, 2021

জয়ন্ত ঘোষাল: এর চেয়ে বড় ব্রেকিং নিউজ আর কী হতে পারে! পশ্চিমবঙ্গে পরিবর্তন, যাকে বিজেপি বলেছিল ‘আসল পরিবর্তন’- সেটা হল না, হল প্রত্যাবর্তন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার আবার ফিরে এল পশ্চিমবঙ্গের সিংহাসনে। কিন্তু এই ভোটের বিশ্লেষণ করতে গেলে প্রথম যে কথাটা বলতে হবে- বিজেপি পরাস্ত হয়েছে, ক্ষমতায় আসতে পারেনি, এটা যেমন সত্য, পাশাপাশি একথাও সত্য যে, বিজেপির ২০১৬-তে বিধানসভায় ছিল মাত্র ৩ জন বিধায়ক, সেই বিজেপির এখন ৭৬ জন বিধায়ক। বিজেপি আগেই প্রধান বিরোধী দল হয়ে গিয়েছে। বিধানসভায় এতগুলো আসন নিয়ে বিজেপি আসছে। বিজেপির রাজনীতিতে এই মুহূর্তে পূর্ণচ্ছেদ তো নেই-ই, বরং নতুন উদ্যমে বিজেপি মমতাবিরোধী রাজনীতিতে সক্রিয় হবে।

Advertisement

[আরও পড়ুন: সম্পাদকীয়: বঙ্গে বিজেপি বাড়ল কীভাবে?]

এখন প্রশ্ন হল বিজেপি হারল কেন? আসুন, আমরা এক এক করে আলোচনা করি।বিজেপির পরাজিত হওয়ার নেপথ্যে আমি দশটি কারণ তুলে ধরতে চাই। প্রথম কারণ, এই নির্বাচনে খুব বড় হয়ে উঠল বাঙালি জাতিসত্তার রাজনৈতিক তাস, যেটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় খুব সুচতুরভাবে ব্যবহার করলেন। তিনি মোদি-অমিত শাহকে ‘বহিরাগত’ বলে আখ্যা দিলেন। এটাতে খুব সূক্ষ্মভাবে বাঙালি এবং অবাঙালির প্রাদেশিকতার রাজনীতি আছে বলে অনেকে মনে করলেন। কিন্তু তারপর তৃণমূল কংগ্রেস ব্যাখ্যা দিল- বাঙালি-অবাঙালি নয়, বঙ্গসংস্কৃতির নিজস্বতাকে আক্রমণকারী মোদি-অমিত শাহরা অনেকটা নাদির শাহ-র মতো আক্রমণ করতে আসছে এবং বঙ্গসংস্কৃতিকে তছনছ করে দিতে চাইছে। শুধু রবীন্দ্রনাথের নাম বললে তো হবে না, বঙ্গ সংস্কৃতি জানতে হবে। এমনকী, বিজেপির সভাপতি জে.পি. নাড্ডা বলে বসলেন, জোড়াসাঁকোতে নয়, শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ জন্মেছেন। এত তুচ্ছ একটা ভুলও কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে গিয়েছিল। যারা রবীন্দ্রনাথের জন্মস্থানই জানে না, তারা কী বঙ্গসংস্কৃতি শেখাতে আসছে?

রেনেসাঁ শহর কলকাতা, তা ঊনবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় সাংস্কৃতিক শহর। ১৯১১ সালে এখান থেকে রাজধানী স্থানান্তরিত হয়ে গেল। বাণিজ্যিক রাজধানী হয়ে গেল তৎকালীন বোম্বে, এখন যা মুম্বই। দিল্লি রাজনীতির মক্কা হয়ে গেল। আর পশ্চিমবঙ্গ পেল লবডঙ্কা। সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে। সিপিএম একটা সময় বঞ্চনার রাজনীতির কথা বলত, দাবি করত যে, পশ্চিমবঙ্গকে কিছু দেওয়া হচ্ছে না। ‘মাশুল সমীকরণ নীতি’ থেকে শুরু করে রাজস্ব পর্যন্ত সব ব্যাপারে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে অভিযোগের তর্জনী তুলত সিপিএম, কেন্দ্রকে অভিযুক্ত করত ‘বিমাতাসুলভ মনোভাব’-এর। সেই একই রাজনীতি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় করলেন এবং দেখিয়ে দিলেন যে, কীভাবে এই ‘বেঙ্গলি আইডেন্টিটি’-কে ব্যবহার করা যায়। হিন্দু ভোটকে বিজেপি ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি দিয়ে সুসংহত করতে চেয়েছিল। সেটা সম্ভব হল না, কেননা, বাঙালি মানে তো হিন্দু এবং মুসলমান- দু’পক্ষই। মুসলমান সমাজ এই ভোটে আরও বেশি করে মমতার পক্ষে এককাট্টা হয়েছে, সে আলোচনায় পরে আসছি। কিন্তু বাঙালি হিন্দু সমাজও বাঙালিত্বের কারণে বিজেপিকে ভোট না দিয়ে মমতার পক্ষে ভোট দিল। ২০১৯-এ বিজেপি ১৮টা আসন পেয়েছিল। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, অমিত শাহ যখন রোড শো করেছিলেন, তখন কলেজ স্ট্রিটে বিদ্যাসাগর কলেজে বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙা হয়েছিল। সেটার দরুন বিজেপি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। মূল কলকাতা শহরের প্রায় ৯টা আসন বিজেপি কিন্তু পায়নি, তৃণমূল পেয়েছিল। সেই সময় থেকেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বুঝতে পেরেছেন যে, বাঙালির জাতিসত্তার রাজনীতিটা এক্ষেত্রে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে।

দ্বিতীয় কারণ, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সমবেতভাবে আক্রমণ করা হচ্ছে, তার ফলে তিনি ভিক্টিমের অবস্থান নিতে পেরেছেন। এত শক্তিশালী একজন প্রধানমন্ত্রী, নরেন্দ্র মোদি, তিনি কিনা ঘনঘন কলকাতায় এসেছেন, জনসভা করেছেন। একটা বিধানসভা নির্বাচনের জন্য কোনও প্রধানমন্ত্রী আগে কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে এতবার কখনও আসেননি। এই যে প্রধানমন্ত্রীর আসা, অমিত শাহ-র আসা, নাড্ডা-র আসা, ডজন ডজন বিজেপি নেতা-সাংসদের আসা, এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট, সিবিআই-এর অভিষেকের বাড়িতে যাওয়া- এসবই বোধহয় কেন্দ্রের ‘অতি-হস্তক্ষেপ’ বলে মনে হয়েছে বাঙালির, যাকে বলে ‘ওভারডু’। রান্নার অনেক উপাদান ছিল, মশলাটশলা সবই ছিল, কিন্তু নুন অনেক বেশি পড়ে গেল।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কমিউনিকেশন স্কিলও মারাত্মক! তিনি তাঁর মতো করে মেঠো স্টাইলে সব আক্রমণের জবাব দিয়ে গিয়েছেন। একটা সময়, কংগ্রেস যখন গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রীকে নানারকমভাবে আক্রমণ করেছিল, ‘শয়তান’ পর্যন্ত বলেছিল, সে সবই কিন্তু মোদির পক্ষে গিয়েছিল। সুতরাং একইরকম ভিক্টিম স্ট্যাটাসের কার্ড মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও খেলতে সক্ষম হয়েছেন।

তৃতীয় কারণ, যে মেরুকরণ হবে বলে বিজেপি ভেবেছিল, তা হয়নি। অসমে শতকরা ৩০ ভাগ মুসলমান আছে, সেখানে এই মেরুকরণে ফল হয়েছিল। কিন্তু বিজেপি নেতৃত্ব বুঝতে পারল না, যে, অসম আর পশ্চিমবঙ্গ দুটো আলাদা রাজ্য। বাঙালি মানসিকতা আলাদা। ‘অখণ্ড ভারত’ আমরা বলি বটে, কিন্তু ভারতের মধ্যেও অনেক ভারত আছে, অনেক স্তর আছে। এক একটা রাজ্যের প্রকৃতি এক এক রকমের, তার মানসিকতা এক একরকমের। সেগুলোকে না বুঝতে পেরে, উত্তরপ্রদেশ বা বিহারের কায়দায় হিন্দু-মুসলমান রাজনীতির মেরুকরণ করার প্রয়াস ব্যর্থ হল। বাঙালি হিন্দুরা ঠিক উত্তরপ্রদেশ বা বিহারের মতো অত রিচুয়ালিস্টিক হিন্দু নয়। আমরা, বাঙালি হিন্দুরা মুসলমান রাঁধুনির হাতে খাবার খাই, বরং তাঁদের হাতের রান্না সুস্বাদু লাগে আমাদের। এমনকী, বাঙালি হিন্দুদের প্রায়শই মুসলিম দোকানে বিরিয়ানি খাওয়ার জন্য উইকএন্ডে যেতে দেখা যায়। এই বাঙালি হিন্দু কিন্তু তুলনায় অনেক কসমোপলিটান হিন্দু, বহুত্ববাদী হিন্দু। অমর্ত্য সেন বারবার বলেন যে, বৌদ্ধদের প্রভাব ছ’শো বছরের, মুসলমানদের প্রভাব চারশো বছরের, ব্রিটিশদের শাসন দু’শো বছরের- এইসব প্রভাব মিলে বাঙালি নামক যে মণ্ডটি তৈরি হয়েছে, তা বহুত্ববাদী মণ্ড। সেই মণ্ডকে কিন্তু স্টিমরোলার চালিয়ে হিন্দু-মুসলমানে বিভক্ত করা যায় না।
এর পাশাপাশি, আগে যা বলছিলাম, মুসলমান সমাজ কিন্তু আরও অনেক বেশি কনসোলিডেটেড হয়ে মমতার দিকে চলে গিয়েছে। বিজেপি যত আক্রমণকারী হয়েছে, ততই মুসলমান সমাজ ভীত-সন্ত্রস্ত হয়েছে। ওয়েইসির ‘মিম’ এবং আব্বাস সিদ্দিকির ‘ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্ট’ এক্ষেত্রে কার্যকর হতে পারেনি। কারণ মমতা কিন্তু সুনিপুণভাবে প্রচার করেছেন যে, ওরা বিজেপির বি-টিম, ওদেরকে ভোট দেওয়া মানে সেই ভোট বিজেপির বাক্সে পড়বে।

ভারতের স্বাধীনতার আগে, একসময় ‘মুসলিম লিগ’ বঙ্গদেশে (পশ্চিমবঙ্গ তখনও হয়নি) সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়েছিল। কিন্তু তারপরে কখনও মুসলমানদের জন্য আলাদা পার্টি হয়নি পশ্চিমবঙ্গে। এই প্রথম হল। তারা কিন্তু কিছু করে উঠতে পারল না। বাঙালি মুসলমান, উর্দুভাষী মুসলমানরা বুঝতে পেরেছিল যে, এরকম আলাদাভাবে যদি মুসলমান ভোট দেওয়া হয়, এবং মুসলমান ভোট যদি ভেঙে যায়, তাতে লাভ হবে বিজেপির। তার ফলে মেরুকরণের তত্ত্বের প্রভাবে হিন্দু সমাজ সুসংহত হয়ে বিজেপির পাশে এসে দাঁড়াল না।

চতুর্থ কারণ, আমি বলব, প্রশান্ত কিশোরের ম্যানেজমেন্টকে নিশ্চয়ই কৃতিত্ব দেওয়া উচিত। প্রশাসনিক ক্ষেত্রে অপশাসন ছিল, পশ্চিমবঙ্গে মমতার বিরুদ্ধে একটা প্রবণতা তৈরি হয়েছিল, জেলায় জেলায় তোলাবাজি, সিন্ডিকেটরাজের মতো অভিযোগ উঠেছিল, একটা পারসেপশন তৈরি করে বিজেপি প্রচার করছিল। তার উল্টোদিকে বছরখানেক ধরে ‘দিদিকে বলো’, কন্যাশ্রী-র প্রচার, স্বাস্থ্যসাথী কার্ড, ছোট ছেলেমেয়েদের জন্য বিনা পয়সায় বা অল্প পয়সায় খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা- ‘পপুলিস্ট মেজরস’ যাকে বলা হয়, তেমন নানা পদক্ষেপ মমতা নিয়েছিলেন। সেখানে পিকে-র বুদ্ধি কাজ করেছিল। সেটা এক্ষেত্রে মস্ত বড় ভূমিকা নিয়েছে।

পঞ্চম কারণ, তৃণমূলের দল ভাঙানোর রণকৌশলও মমতার পক্ষে গিয়েছে। সেই দল বদল করা প্রার্থীরা কিন্তু কেউ জিততে পারেননি, যাঁরা বিশেষ বিমানে অমিত শাহ-র বাড়িতে গিয়ে পৌঁছেছিল। বাঙালি বোধহয় এইভাবে দলবদল ভাল চোখে দেখেনি। তাঁদের বিশ্বাসঘাতক মনে করেছিল। তৃণমূল ভেঙেও বিজেপি খুব একটা লাভ পেল না। বিজেপি যত বেশি করে বলেছে, আমরা দু’শো পার করব, ‘মাইন্ডগেম’ খেলার চেষ্টা করেছে- তত হাওয়া তাদের বিরুদ্ধে গিয়েছে।

ষষ্ঠ কারণ, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মাইক্রো-ম্যানেজমেন্টটাও চুপিসারে করেছেন। রাজবংশীদের একজন স্বঘোষিত মহারাজা অনন্ত মহারাজ। একটা সময় তাঁর বিরুদ্ধে তৃণমূল মামলাপত্র রুজু করেছিল, তিনি পালিয়ে গিয়েছিলেন অসমের জঙ্গলে। অমিত শাহ তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। রাজবংশীদের উপর তাঁর প্রভাব-প্রতিপত্তি ছিল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘এমিসারি’ বা দূত পাঠিয়ে তাঁকে টেনে নিয়ে এলেন তৃণমূল কংগ্রেসে। যেরকম গুরুং-এর ব্যাপারটা। অমিত শাহ-র ‘সাম-দাম-দণ্ড-ভেদ’-এর চাণক্য নীতি যদি ন্যায়নীতির ঊর্ধ্বে প্রশংসনীয় হয়, তাহলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রেও তা হবে না কেন? সুতরাং ঝাড়গ্রামে কোথায় মাওবাদীদের প্রভাব আছে, কোথায় নকশালদের প্রভাব আছে- সেসব বুঝে যাকে যেভাবে ব্যবহার করা যায়, তিনি করেছেন, এবং সফল হয়েছেন। এমনকী, অতিবামপন্থীরা, যাঁরা ‘নো ভোট টু বিজেপি’ ঘোষণা করেছিলেন, তাঁদের প্রশংসা করা, দীপঙ্কর ভট্টাচার্যর মতো নকশাল নেতার প্রশংসা করা- এসবই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অত্যন্ত সুনিপুণভাবে করেছেন।

সপ্তম কারণ, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে ‘ভাইপো’, ‘ভাইপো’ বলে ‘ভাইপো’ শব্দটাকে অবাঙালিদের কাছেও পরিচিত করে তুলল বিজেপি। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে যখন সিআইবি বা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট পাঠানো হল, তখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আক্রমণাত্মক ভূমিকা নিলেন। তিনি রক্ষণাত্মক ব্যাটে খেললেন না, সোজা অভিষেকের বাড়িতে চলে গেলেন। তার শিশুকন্যাকে কোলে তুলে নিলেন। বিভিন্ন ইন্টারভিউতে এ নিয়ে কথা বললেন, অভিষেককে ভয় পেতে বারণ করলেন। উল্টে অভিষেককে ‘স্টার ক্যাম্পেনার’ করে দিলেন। বিজেপি-ই তাঁকে ‘নেতা’ বানিয়ে ফেলল। এই আক্রমণাত্মক রণকৌশল মমতার পক্ষে গিয়েছে। সেখানে তিনি কোনও রেয়াত করেননি।

অষ্টম কারণ, দেবাংশু ভট্টাচার্যর ‘খেলা হবে’ গান জনসমাজে তরঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। মমতা ও পিকে গানটাকে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারের হাতিয়ার করেছেন। বিভিন্ন জনসভায় তা গাওয়া হয়েছে, এটা প্রায় একটা ‘কমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক’। সোশ্যাল মিডিয়া, বিভিন্ন ইভেন্ট, সোপ অপেরায় পর্যন্ত ‘খেলা হবে’ ব্যবহৃত হল। বিজেপি এর বিরোধিতা করেছে, নরেন্দ্র মোদি বললেন, ‘খেলা হবে না, বিকাশ হবে’ ইত্যাদি- এতে কিন্তু পরিস্থিতির কোনও তফাত হল না। ‘খেলা হবে’ তো কোনও নেতিবাচক শব্দ নয়। রবীন্দ্রনাথও গানে বলেছেন ‘খেলা ভাঙার খেলা’। বাঙালির বোধহয় অবচেতন মনে ‘খেলা’ শব্দটার প্রতি প্রেম আছে। কেননা ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান, ক্রিকেট- সব খেলার সঙ্গেই বাঙালির কোথাও একটা সংযোগ আছে। নতুন প্রজন্মেরও তাই ভাল লাগল এই প্রচার।

নবম কারণ, জাতিগত ভোট, অর্থাৎ তফসিলি ভোট, ওবিসি ভোট ইত্যাদি সিপিএম কখনওই করত না। শ্রেণির ভিত্তিতে ভোট করত তারা। মতুয়া ভোট মমতার নিজের হাতে লালিতপালিত। মতুয়া ‘মা’-কে যত্ন করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে সবকিছু মমতা করেছিলেন। বিজেপি সেখানে হাত দিতে চেয়েছিল। শান্তনু ঠাকুর বিজেপির হয়ে লোকসভায় জিতেছিলেন। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জাতপাতের ভোটব্যাংককে সুসংহত রাখতে সক্ষম হলেন।

দশম কারণ, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটা মুখ। শুধু তাঁর ছবিই সামনে এসেছে। এমনকী, অভিষেককেও একটা লক্ষ্মণরেখার মধ্যে রাখা হয়েছিল। তিনি হয়তো দ্বিতীয় ‘স্টার ক্যাম্পেনার’ হয়েছিলেন। সব জায়গায় যেতেন, লোকজনও হত। কিন্তু মমতাই প্রধান ক্যাম্পেনার। আহত অবস্থায় হুইলচেয়ারেও কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটা সেন্টিমেন্ট উসকে দিয়েছেন। সবটা মমতাকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে। তাঁর বিরুদ্ধে সমবেতভাবে লড়াই হচ্ছে, তিনি একমাত্র মহিলা মুখ্যমন্ত্রী, জনকে এইভাবে আক্রমণ করা হচ্ছে। তার ফলে মহিলা ভোটব্যাংককে মমতা আরও সুসংহত করতে পেরেছিলেন। আমার মনে আছে, তিনি যখন রেলমন্ত্রী ছিলেন, তখন দূর থেকে যে পরিচারিকারা শিয়ালদহ রেল স্টেশন বা অন্যান্য জায়গায় আসতেন, তাঁদের ফ্রি মান্থলি পাসের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। সেই ভোটব্যাংকটা কিন্তু এখনও মফস্‌সলে খুব শক্তিশালী। তা মমতার পক্ষে কাজ করেছে।

সব মিলিয়ে বিজেপির প্লট বানচাল করে দিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আবার ফিরে এলেন। এখানে একটা জিনিস মনে রাখতে হবে, তৃণমূলের বিরুদ্ধে বিরোধী দল হিসাবে একটা চরম দক্ষিণপন্থী শক্তি বিরোধী দলের ভূমিকায় এসে গেল। সুতরাং, আগামী দিনে মমতাকে অনেক সচেতনভাবে এগতে হবে। লড়াইটা আরও জমবে। মমতা এখন নতুন সরকার গঠন করবেন, নতুন মুখ নিয়ে আসবেন। কিন্তু ‘খেলা’ শেষ হল না। এখনও নব নব রূপে ‘খেলা হবে’।

সবশেষে বলা যায়, কংগ্রেস এবং সিপিএমের ভোটব্যাংক ফেরত পাওয়ার একটা আশা ছিল, সেটাও হল না। সেটা বিজেপির দিকে গেল কিছুটা, তা যেমন মমতার জন্য খারাপ হয়েছে, তেমনই সিপিএমের যে মুসলমান ভোট ছিল, তাও কিন্তু ফিরল না। সিদ্দিকির সঙ্গে জোট বাঁধায় হিতে বিপরীত হল। সিপিএম নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। মুসলিম ভোট যদি সিপিএম কিছুটা কাটত, নবীন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা যাঁরা দাঁড়িয়েছেন, তাঁরা যদি ভোট কাটতেন, তাহলেও মমতার বিপদ হত। সুতরাং না কংগ্রেস না সিপিএম- কারও সঙ্গেই বোঝাপড়ায় মমতা যাননি। সুযোগ ছিল, ভয় পেয়ে গিয়ে কোয়ালিশনের কথা ভেবে কংগ্রেস বা সিপিএমের সঙ্গে বোঝাপড়া করতেই পারতেন। তিনি কিন্তু সেটা করেননি। ঝুঁকি নিয়েছেন। সেজন্য কংগ্রেসের অসুবিধা হয়েছিল। তবে অধীর চৌধুরি, আব্দুল মান্নানরা ভুল প্রমাণিত হলেন। সেখানে সোনিয়া গান্ধী-রাহুল গান্ধী উভয় সংকটে পড়ে গেলেন।

২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচন আরও ইন্টারেস্টিং হয়ে উঠল, কেননা, তৃণমূল যদি হেরে যেত, বিজেপি যদি জিতত, তাহলে ২০২৪-এ নরেন্দ্র মোদির পথনির্দেশিকা আরও স্পষ্ট হত। মমতা তথা বিরোধীদের ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে আর্থিক সংকটের মধ্যেও, করোনার এই মিস-ম্যানেজমেন্টের মধ্যেও নরেন্দ্র মোদি হইহই করে পশ্চিমবঙ্গের বিজয়টাকে মূলধন করে এগিয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু সেটা যখন হল না, তার উল্টোটা কী হবে? হতে পারে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিরোধী ঐক্যের একটা ফালক্রামে পরিণত হবেন। তাঁকে এখন শরদ পাওয়ার ফোন করছেন, স্ট্যালিন ফোন করছেন, কেজরিওয়াল-সহ বিরোধী সমস্ত নেতা ফোন করছেন। মমতার নেতৃত্বে আগামী দিনে বিরোধী ঐক্যের প্রতিষ্ঠা হতেই পারে, ইউপিএ আবার পুনরুজ্জীবিত হতে পারে। সোনিয়া গান্ধী বর্তমানে ইউপিএ-র চেয়ারপার্সন, এখন সেই চেয়ারপার্সনের পদে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আসবেন, না শরদ পাওয়ার আসবেন, কে কনভেনার হবেন- এসব এক্ষুনি বোঝা যাবে না।

এখন করোনা মোকাবিলা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম কাজ। দ্বিতীয় কাজ, নতুন সরকার গড়ে খোলনলচে বদলানো, নন্দীগ্রামের বিপর্যয়ের কারণ খুঁজে বের করা। আমার মনে হয় করোনার এই পর্ব অতিবাহিত হলে, ছ’মাস পর বিরোধী নেতৃত্বের কাজকর্ম শুরু হবে। উত্তরপ্রদেশের নির্বাচন ততদিনে এসে যাবে। উত্তরপ্রদেশ নির্বাচনে অখিলেশ কী করে, সেটাও দেখার। উত্তরপ্রদেশ নির্বাচনে বিজেপির যদি বিপর্যয় হয়, তাহলে বিরোধীরা আরও বেশি ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সুযোগ নেবে। তবে বিজেপি উত্তরপ্রদেশে কী রণকৌশল নেবে- সেটাও এখন দেখার বিষয়। সুতরাং, এখনও জাতীয় রাজনীতিতে সলতে পাকানোর সময় আসেনি, এখনই কিছুই চূড়ান্ত হচ্ছে না। তবে এখন আরম্ভের আগের আরম্ভ হয়ে গিয়েছে। সুতরাং ‘খেলা’ শেষ নয়, ‘খেলা’ শুরু।

[আরও পড়ুন: সম্পাদকীয়: মমতার হ্যাট্রিক, বাংলার নব জাগরণ]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement