১ ডলারের বিনিময়-মূল্য এখন ৯০-৯১ টাকার ঘরে। এর অর্থ– সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা ও দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে এর বহুমুখী প্রভাব, যা মূলত আমদানিকৃত মুদ্রাস্ফীতির মাধ্যমে সাধারণের পকেটে টান ফেলে। ‘আরবিআই’ কী ভাবছে? লিখছেন সুজনকুমার দাস।
মার্কিন ডলারের বিপরীতে ভারতীয় টাকার ‘মান’ ধারাবাহিকভাবে কমেছে, কমছে। ১ ডলারের বিনিময়-মূল্য এখন ৯০-৯১ টাকার ঘরে। সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন জাগে, আমাদের অর্থনীতি যদি বিশ্বের দ্রুততম বর্ধনশীল অর্থনীতি হয়, তবে আমাদের মুদ্রার এই দশা কেন? কেন ‘রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া’ এই পতন রুখতে পারছে না? এই গোলকধাঁধার উত্তর লুকিয়ে আছে অর্থনীতির একটি অত্যন্ত জটিল কিন্তু যৌক্তিক তত্ত্বে, যার নাম ‘ইমপসিব্ল ট্রিনিটি’ বা ‘অসম্ভব ত্রয়ী’।
‘ইমপসিব্ল ট্রিনিটি’ কী?
ছয়ের দশকের শুরুতে অর্থনীতিবিদ রবার্ট মুন্ডেল এবং মার্কাস ফ্লেমিং এই তত্ত্বটি প্রদান করেন। এই তত্ত্বানুযায়ী, একটি দেশ বা অর্থনীতি একই সঙ্গে তিনটি লক্ষ্য অর্জন করতে পারে না। ‘লক্ষ্য’ তিনটি হল– ক)স্থির বিনিময় হার: যখন একটি দেশ তার ‘মুদ্রার মান’ ডলার বা অন্য কোনও মুদ্রার বিপরীতে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় আটকে রাখে। খ) অবাধ মূলধন চলাচল: বিদেশি বিনিয়োগকারীরা কোনও বাধা ছাড়াই দেশে টাকা আনতে পারবে এবং লাভ-সহ নিয়ে যেতে পারবে। গ) স্বাধীন মুদ্রানীতি: কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক দেশের মুদ্রাস্ফীতি বা প্রবৃদ্ধির প্রয়োজনে সুদের হার স্বাধীনভাবে নির্ধারণ করবে। একটি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের কাছে এই তিনটি লক্ষ্যের মধ্যে মাত্র দু’টি বেছে নেওয়ার সুযোগ থাকে। যদি কেউ তিনটিই পাওয়ার চেষ্টা করে, তবে অর্থনীতিতে ভারসাম্যহীনতা তৈরি হবে এবং বিশাল সংকট দেখা দেবে।
ভারতের এখন ‘ট্রিনিটি’-র কোন প্রান্তে?
‘উন্নয়নশীল দেশ’ হিসাবে ভারত নিজ-অর্থনীতিকে বিশ্ববাজারের জন্য উন্মুক্ত রাখতে চায়। ভারত বর্তমানে বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ (FDI) এবং ‘ফরেন পোর্টফোলিও ইনভেস্টমেন্ট’-এর (FPI) উপর দারুণভাবে নির্ভরশীল। দেশের স্টার্টআপ ইকোনমি এবং শেয়ার বাজারের চাকা সচল রাখতে বিদেশি ডলারের প্রয়োজন। তাই ভারত মূলধন চলাচলের দরজা পুরোপুরি বন্ধ করতে পারে না।
আবার ভারতের বিশাল জনসংখ্যার কর্মসংস্থান ও মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য আরবিআই-কে স্বাধীন হতে হয়। যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সুদের হার বাড়ে, আর ভারতও বাধ্য হয়ে তাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সুদের হার বাড়ায়, তবে দেশের ছোট ব্যবসায়ী এবং সাধারণ মানুষের ঋণের বোঝা বেড়ে যাবে। এতে দেশের অভ্যন্তরীণ প্রবৃদ্ধি থমকে যাবে। তাই ভারত তার মুদ্রানীতির স্বাধীনতা ত্যাগ করতে রাজি নয়।তাই, ভারত ‘অবাধ মূলধন’ এবং ‘স্বাধীন মুদ্রানীতি’ বজায় রাখতে চায়, তাই ‘ইমপসিব্ল ট্রিনিটি’-র গাণিতিক নিয়ম অনুযায়ী তাকে ‘স্থির বিনিময় হার’ বিসর্জন দিতে হয়েছে। অর্থাৎ, টাকার ‘মান’ এখন বাজারের চাহিদা ও জোগানের উপর নির্ভরশীল।
কেন টাকার পতন ত্বরান্বিত হচ্ছে?
চিনের স্থবির অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে সে-দেশের সরকার বিশাল অঙ্কের একটি ‘স্টিমুলাস প্যাকেজ’ ঘোষণা করেছে। আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীরা মনে করছেন যে, ভারতীয় শেয়ার বাজারের তুলনায় চিনের বাজার বর্তমানে অনেক বেশি সস্তা এবং মুনাফা অর্জনের জন্য লাভজনক। এ ধারণার বশবর্তী হয়ে অনেক বিদেশি বিনিয়োগকারী ভারত থেকে তাদের বিপুল পরিমাণ পুঁজি তুলে নিয়ে চিনের বাজারে সরিয়ে নিচ্ছেন, যার ফলে ভারতে ডলারের অভাব দেখা দিচ্ছে।
এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির প্রভাব। ট্রাম্প প্রশাসনের অধীনে ভারত-সহ বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানিকৃত পণ্যের উপর উচ্চহারে শুল্ক চেপেছে, যা ভারতের রফতানি বাণিজ্যে এক ধরনের অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছে। বিনিয়োগকারীরা আশঙ্কা করছেন যে, এ সম্ভাব্য বাণিজ্য-যুদ্ধের ফলে বিশ্ববাজারে মার্কিন ডলারের চাহিদা আরও বাড়বে, যা পরোক্ষভাবে টাকাকে ক্রমাগত দুর্বল করে দিচ্ছে। অন্যদিকে, মধ্যপ্রাচ্যের ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার ফলে লোহিত সাগরে জাহাজ চলাচল বিঘ্নিত হওয়ায় পণ্য পরিবহণ খরচ, বা ‘ফ্রেট কস্ট’ বহু গুণ বেড়ে গিয়েছে। ভারত যেহেতু তার প্রয়োজনীয় খনিজ তেলের প্রায় ৮০ শতাংশই বিদেশ থেকে আমদানি করে, তাই তেলের দাম ও পরিবহণ খরচ বাড়লে ভারতকে আগের চেয়ে অনেক বেশি ডলার খরচ করতে হচ্ছে। এই বিশাল পরিমাণ ডলারের ঘাটতি ভারতীয় মুদ্রাকে আরও দুর্বল করে দিচ্ছে।
অনেকে বলেন, ভারতের কাছে তো প্রায় ৭০০ বিলিয়ন ডলারের বিশাল রিজার্ভ আছে। তবে কেন সেই ডলার বাজারে ছেড়ে, টাকার ‘মান’ ৮৪ বা ৮৫ টাকায় ধরে রাখা হচ্ছে না? এখানেই নীতিনির্ধারকদের দূরদর্শিতা কাজ করে। যদি ‘আরবিআই’ জোর করে টাকার মান ধরে রাখতে চায়, তবে তা হবে প্রকৃতির বিরুদ্ধে যাওয়ার মতো। এতে দু’টি বড় বিপদ হতে পারে। আমাদের কষ্টার্জিত ডলারের রিজার্ভ দ্রুত শেষ হয়ে যাবে, যা দেশের আর্থিক নিরাপত্তাকে ঝুঁকিতে ফেলবে। অন্যদিকে, টাকার মান কৃত্রিমভাবে চড়া থাকলে ভারতীয় পণ্য বিদেশের বাজারে দামি হয়ে যাবে, ফলে আমাদের রফতানি মারাত্মকভাবে কমে যাবে এবং অন্যান্য দেশ বাজার দখল করে নেবে।তাই ‘আরবিআই’ বর্তমানে ‘Managed Float’ পদ্ধতি অনুসরণ করছে। অর্থাৎ, তারা টাকার পতন পুরোপুরি আটকাবে না, কিন্তু পতন যেন খুব দ্রুত বা বিধ্বংসী না হয়, তার দিকে নজর রাখবে।
আমাদের সাধারণ জীবনে এর প্রভাব কী?
টাকার মান ‘৯০’ বা ‘৯১’ ছাড়িয়ে যাওয়ার অর্থ হল– সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা ও দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে এর বহুমুখী প্রভাব পড়া, যা মূলত আমদানিকৃত মুদ্রাস্ফীতির মাধ্যমে সাধারনের পকেটে টান ফেলে। যেহেতু আমরা বিদেশ থেকে মোবাইল, ল্যাপটপ এবং বিভিন্ন উন্নত ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতির মতো প্রয়োজনীয় সামগ্রী আমদানি করি, তাই ডলারের দাম বাড়ার ফলে এসব জিনিসের বাজারমূল্য স্বাভাবিকভাবেই বৃদ্ধি পায়। এর চেয়েও উদ্বেগের বিষয়, খনিজ তেলের চড়া দাম; কারণ আমদানিকৃত তেলের মূল্য ডলারে পরিশোধ করতে গিয়ে পরিবহন খরচ বেড়ে যায়, যার চূড়ান্ত প্রভাব পড়ে সাধারণ মানুষের আলু-পটলের মতো নিত্যপণ্যের উপর।
শুধু তাই নয়, মুদ্রার এই অবমূল্যায়ন উচ্চশিক্ষা ও পর্যটন খাতের উপরও বড় আঘাত হানে। বিশেষ করে যারা বিদেশে পড়াশোনা করতে যাচ্ছে, তাদের ‘সেমিস্টার ফি’ বা ‘টিউশন ফি’ পরিশোধ করতে এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি টাকা খরচ করতে হচ্ছে এবং বিদেশ ভ্রমণেচ্ছুদের বাজেটও অনেকটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।
তবে, এই মুদ্রাস্ফীতির মধ্যেও রফতানি খাতের জন্য একটি ইতিবাচক দিক রয়েছে। ভারতের তথ্যপ্রযুক্তি, টেক্সটাইল এবং ওষুধ শিল্পের মতো খাত ডলারে আয় করে বলে মুদ্রার মান কমলে তাদের ‘নিট’ আয়ের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। এ বাড়তি মুনাফা দেশের শিল্পায়ন ও নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বড় ভূমিকা রাখে, যা দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতির ভারসাম্য রক্ষা করতে সাহায্য করে।
দেউলিয়া হওয়ার পথে?
একদমই নয়। ‘টাকার অবমূল্যায়ন’ মানেই অর্থনীতির পতন নয়। বরং এটি বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার একটি প্রক্রিয়া। ভারতের অর্থনীতি বর্তমানে মজবুত ভিতের উপর দঁাড়িয়ে আছে। আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধি এখনও বিশ্বের অন্যতম সেরা। অনেক অর্থনীতিবিদের মতে, ভারতের ‘রিয়েল এফেক্টিভ এক্সচেঞ্জ রেট’ (REER) অনুযায়ী, টাকার মান আগে থেকেই কিছুটা বেশি (Overvalued) ছিল। বর্তমানের এই পতন আসলে টাকাকে তার প্রকৃত মূল্যে ফিরিয়ে আনছে, যা দীর্ঘমেয়াদে বাজারের জন্য স্বাস্থ্যকর।
টাকার দাম কমছে– কারণ, বিশ্ববাজারের সমীকরণ বদলে গিয়েছে। ‘ইমপসিব্ল ট্রিনিটি’-র জটিল জালে ভারত তার অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে রক্ষা করার জন্য বিনিময় হারের সঙ্গে আপস করছে। এটি একটি সচেতন সিদ্ধান্ত। নাগরিক রূপে আমাদের বুঝতে হবে যে, মুদ্রার মান কমে যাওয়া মানেই দেশের মান কমে যাওয়া নয়; বরং এটি একটি কৌশলী অর্থনৈতিক পদক্ষেপ– যা ভবিষ্যতে আমাদের রফতানি বাণিজ্যকে আরও শক্তিশালী করবে। আর, ‘আরবিআই’ বারবার করে ভারতের অভ্যন্তরীণ বাজারের শক্তির উপর ভরসা রাখতে বলছে। বাজারই ভারতীয় মুদ্রাকে আবার স্থিতিশীল করে দেবে বলেই নীতিনির্ধারকদের বিশ্বাস।
(মতামত নিজস্ব)
