ভোলানাথ ঘোষ: সিপিএমে (CPIM) প্রজন্মান্তর। রাজ্য সম্মেলনটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। এই প্রথম একসঙ্গে এতজন বর্ষীয়ানের সরে দাঁড়ানো।রাজ্য সম্পাদকও বদল। এবং এতজন নতুন মুখ, তার মধ্যে বেশ কয়েকজন নতুন প্রজন্মের, ছাত্রযুব শাখা থেকে উঠে আসা, অধুনা মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়ায় পরিচিত মুখ।
সিপিএম দেখাতে চাইছে তারা নড়ে বসছে। খোলনলচে বদলাচ্ছে। নতুনত্বের হাওয়ায় দলে মেদ কমিয়ে গতি আনতে চাইছে। নতুন সম্পাদক মহম্মদ সেলিম (Md Selim) এবং সুদীপ, শতরূপ, মীনাক্ষী-সহ নতুন মুখগুলিকে নিয়ে ফেসবুক-সহ নব প্রযুক্তির মঞ্চগুলিতে রোমাঞ্চকর সংলাপে উদ্দীপনা তৈরির যথাসম্ভব চেষ্টা করে যাচ্ছেন কমরেডকুল। কিন্তু, প্রশ্নটা হল, শূন্যপদ পূরণ আর শূন্যস্থান পূরণ যেহেতু এক নয়, সেক্ষেত্রে প্রজন্মান্তরের কার্যকারিতা আদপে কতখানি হবে?
[আরও পড়ুন: যুদ্ধের মর্মান্তিক ছবি কি যুদ্ধবাজের সিদ্ধান্ত বদলাতে সক্ষম হয়?]
বিমান বসু-সহ (Biman Basu) বেশ ক’জন বর্ষীয়ানের পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর দুটো দিক আছে। এক, বর্ষীয়ানরা পদ আঁকড়ে থাকছেন না এবং একটা সময়ের পর থামতে জানেন, ছাড়তে পারেন, এটা রাজনৈতিক মণ্ডলে সুস্থ বার্তা। জ্যোতি বসু, হাসিম আবদুল হালিম বা এরকম কিছু নাম ব্যতিক্রম হতেই পারত বা পারে। যতদিন শরীর দেবে, ততদিন তাঁদের যথাসম্ভব দায়িত্বে রাখা। কিন্তু এখন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে, পার্টি যখন ক্ষমতায় নেই, পার্টি যখন বিরোধী শিবিরে, তখন ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াইতে রক্ত সঞ্চালনে গতিবৃদ্ধি অগ্রাধিকার দিতে, এমন একটা বড়সড় ঝাঁকুনি দরকার ছিল। বর্ষীয়ানদের পদ ছাড়া সেদিক থেকে ইতিবাচক।
দুই, বর্ষীয়ানরা সরলেন, কিন্তু একটু দেরি হয়ে গেল না? বয়স যদি মাপকাঠি নাও ধরি, নির্বাচনী রাজনীতিতে লাগাতার ব্যর্থতা ও অবনমনের ধারাবাহিকতা চলতে দেওয়া কতটা জরুরি ছিল? পার্টি যদি খানিকটা সাফল্য পেত, শুধু বয়সের জন্য এঁরা কি সরে দাঁড়াতেন? লাগাতার পরাজয় ও ব্যর্থতা কার্যত খোলনলচে বদলের পরিস্থিতিটা অবধারিত করে তুলেছিল। এই পরিস্থিতিতে নতুনদের আসাটা যেমন অনিবার্য ও স্বাভাবিক, তেমনই তাঁদের সামনে চ্যালেঞ্জটাও জবরদস্ত।
এখানে একটি বিষয় স্পষ্টভাবে আলোচনা ভালো। যাঁরা সরে গেলেন, বিমান বসু, সূর্যকান্ত মিশ্র, রবীন দেব, মৃদুল দে-সহ প্রায় প্রত্যেকেই একটা সময়ে অসাধারণ দক্ষ। বিমান বসু এক বিরল প্রজাতির রাজনীতিবিদ। কমিউনিস্ট পার্টিতে নিজেই একটি যুগ। রবীন দেব এক সময় ‘রিগিং দেব’ নামে খ্যাত। মৃদুল দে গণশক্তি প্রতিষ্ঠায় অনিল বিশ্বাসের দক্ষিণহস্ত। পার্টিকে ক্ষমতায় আনতে বা দীর্ঘকাল ক্ষমতায় রাখতে এঁদের অবদান অপরিসীম। এঁদের নিশ্চয়ই কিছু ভুল ছিল, সমালোচনার অবকাশ ছিল, কিন্তু সিপিএমের সাফল্যের পিছনে এঁদের নামগুলি সুপ্রতিষ্ঠিত।
বামফ্রন্ট সরকার পড়েছে যেসব ভুল নীতির জন্য, ভুল পদক্ষেপে, এঁরা তার দায় অস্বীকার করতে পারেন না। আবার তার মানে এই নয় যে, ব্যক্তিগত দক্ষতার চুলচেরা বিচার হলে এঁরা পিছনের সারির। পার্টি ডুবেছে সময়োপযোগী দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মসূচির অভাবে। ডুবেছে দীর্ঘকাল ক্ষমতায় থাকার মেদজনিত প্রতিষ্ঠান বিরোধিতায়। ডুবেছে ক্ষমতার ঔদ্ধত্যে মানুষের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে নিজস্ব শ্রেণিসত্তাকেই চ্যালেঞ্জ করায়।
[আরও পড়ুন: পুতিনকে সরাসরি মেরে ফেলার হুমকি ফেসবুকে! তবু উদাসীন জুকারবার্গের সংস্থা]
বামফ্রন্ট (Left Front) সরকার ডুবেছে। কিন্তু বাম আন্দোলনে ব্যক্তি বিমান বসুর অভিজ্ঞতা, জনসংযোগ, ভূমিকা, অবদান অস্বীকার কে করবে, কেন করবে? অর্থাৎ, বাম সরকার ডোবার সঙ্গে যেমন কিছু নেতার ব্যক্তিগত ভালোমন্দ মূল্যায়নের সম্পর্ক না রাখাই ভালো, একই যুক্তিতে আজকের নতুনরা কে কতটা ভালো বা মিডিয়ায় সক্রিয়, তার উপর পার্টির উত্থান নির্ভর করবে কি? বলা কঠিন। কিছু নতুন ছেলেমেয়ে ভালো, ঝকঝকে। ফেসবুকের বিপ্লবী শব্দচয়নে আকর্ষণীয়। কিন্তু তারা কি বামেদের হারানো ভোটব্যাংক ফেরাতে পারবেন? তিনি কতটা ভালো, সেই ব্যক্তি পরিচিতি বড় কথা নয়। পার্টিকে তাঁরা তুলে ধরতে পারছেন কি না, সেটাই আসল কৌতূহল।
ক্ষমতা থেকে যাওয়ার পর থেকেই সিপিএম দিশাহীন। তারা দীর্ঘকাল সঙ্গে পুলিশ, প্রশাসন নিয়ে রাজনীতি করেছে। অবিভক্ত কংগ্রেস বা পরে তৃণমূল কর্মীরা কিন্তু নিজেদের জোরে রাজনীতি করেছেন। তখনই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়রা (Mamata Banerjee) যে ঝড় তুলেছিলেন, সিপিএম গত দশবছরে নিষ্প্রভ। তাদের কর্মীরা, ছাত্রযুবরা নিজেদের জোরে সেভাবে এখনও আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেননি। উলটে বিরোধী পরিসরটাও বিজেপি দখল করে বসে আছে। বামেরা বা সিপিএম তাদের থেকেও পিছিয়ে। সিপিএমের নীতিগুলি মানুষ নেয়নি। যেমন, প্রাথমিক শিক্ষায় ইংরেজি তুলে দেওয়া। কম্পিউটারের বিরোধিতা করা। কখনও রাজীব গান্ধীকে সরাতে বিজেপির সঙ্গে একমঞ্চে, আবার কখনও তৃণমূলের বিরোধিতায় সেই আজন্ম শত্রু কংগ্রেসের সঙ্গেই জোট। জ্যোতি বসুকে প্রধানমন্ত্রী হতে না দেওয়ার কূপমণ্ডুকতা। কথায় কথায় মিছিল, ঘেরাও, ধর্মঘটের নেতিবাচক রাজনীতি। এ ছাড়া কাজ করেছে বহু অপকর্ম ও ব্যর্থতা। শিল্পহীনতা, লোডশেডিং, পরের পর গণহত্যা, অনুন্নয়ন, দলবাজি ইত্যাদি। এমনকী পাহাড় আর জঙ্গলমহলেও পর্যটকদের যাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বাম আমলে।
[আরও পড়ুন: গান্ধীরা নেতৃত্ব ছাড়লেও কংগ্রেসের ভাঙা মাজা সোজা হবে কি?]
সেখানে এখন সরকারি কাজে গতি, সরকারি পরিষেবা ঘরে ঘরে, গণহত্যার জমানা অতীত, বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কর্মসূচি। ফলে এত বড় রাজ্যে কোনও বিচ্ছিন্ন দু’-একটি ঘটনা বা ইস্যুতে বিরোধীরা সরব হওয়ার সুযোগ পেলেও সামগ্রিকভাবে বামেদের নেতিবাচক ভাবমূর্তি কাটিয়ে ইতিবাচক চেহারায় পুরোপুরি ফেরা সময়সাপেক্ষ ও কঠিন।
সিপিএম মুখে যা-ই বলুক, তারাও চেষ্টা করছে ব্যক্তিমুখ ভিত্তিক রাজনীতি করে একটু উঠে আসার। মীনাক্ষীকে মুখ করার চেষ্টা, শতরূপদের ফেসবুক, ইউটিউবের সক্রিয়তা চোখে পড়ছে। কিন্তু তাতে মাটির গন্ধ থাকছে কি? প্রথমত, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো পোড় খাওয়া জননেত্রীর বিরুদ্ধে জায়গা তৈরি কঠিন। দ্বিতীয়ত, বিজেপি কেন্দ্রের সরকারে থাকার সুযোগ আর উগ্র সাম্প্রদায়িকতার মেরুকরণে খেলছে। যেখানে মানুষ মনে করছে, তৃণমূলই পারে বিজেপিকে রুখতে। তৃতীয়ত, নিজস্বতা হারিয়ে সিপিএমের কংগ্রেস (Congress) বা ভাইজানের সঙ্গে জোটের ভুলভুলাইয়া চলছেই। চতুর্থত, বাম জমানা সম্পর্কে নেগেটিভ ন্যারেটিভের পরিবর্তন বেশ জটিল কাজ। আজও বাংলায় তৃণমূল কথায় কথায় বাম জমানার অপশাসনের কথা বলে। তুলনা করে। সিপিএম ভাবতে পারে পুরনো মুখ সরিয়ে একঝাঁক নতুন মুখ দিলে পুরনো ইস্যুগুলি থেকে মানুষের নজর ঘুরে যাবে।
বিমান বসু, সূর্যকান্ত মিশ্র, রবীন দেবরা একদিনে তৈরি হননি। তাই তাঁদের শূন্যপদ একটা সম্মেলনে পূর্ণ হলেও শূন্যস্থান পূরণ করা কঠিন। নিশ্চয়ই সুদীপ সেনগুপ্তরা সারাবছর কাজ করেন। নিশ্চয়ই মীনাক্ষীদের পরিচিতি বাড়ছে। কিন্তু মনে রাখুন, কেন সিপিএমকে ‘রেড ভলান্টিয়ার’ ব্র্যান্ড আনতে হল? করোনায় তৃণমূল কাজ করেনি? অন্য দল করেনি? তা হলে ডিওয়াইএফ বা এসএফআইকে সামনে না এনে ‘রেড ভলান্টিয়ার’ নামকরণের রোমাঞ্চ আনা হল কেন? তৃণমূল যেখানে ছাত্র-যুব শাখার নামে পরের পর কাজ করছে, এমনকী লুপ্তপ্রায় কংগ্রেসের ছাত্র-যুব শাখা সাধ্যমতো কাজ করছে, সেখানে সিপিএম কেন নিজেদের ছাত্র-যুব শাখার নাম পিছনে ঠেলে দিয়ে ‘রেড ভলান্টিয়ার্স’ সামনে রাখল? একই তো কমরেড। তা হলে নাম বদল কেন?
কারণ, সিপিএমও জানে তাদের পুরনো নাম, পুরনো মঞ্চ মানুষ নিচ্ছে না। এখান থেকেই ভাবনা, তা হলে নতুন মুখ যাঁরা এলেন রাজ্য কমিটিতে, তাঁরা যতই এসএফআই, ডিওয়াইএফ থেকে আসুন, মূল পার্টিটাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করবেন কী করে? এই কাজ তো সহজ নয়। ফলে শূন্যপদ পূরণ আর শূন্যস্থান পূরণের ফারাকটা সিপিএমে আপাতত থাকবেই। একঝাঁক নতুন মুখ এই কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড়িয়ে কী করেন, সেটা অবশ্যই দেখার।