নির্মল ধর: তুরস্কের নাট্যকার টুঙ্গের তুসেঙ্গলুর লেখা “দ্য আভালঞ্চ” নাটকের বঙ্গীকরন হচ্ছে “ধস”! কৌশিক বসু এবং সোহাগ সেন দুজনে হাত লাগিয়ে তুরস্কের পাহাড়ে ঘেরা আনাতোলিয়া অঞ্চলের এক গ্রামের গল্পকে এনে ফেলেছেন অনামী কোনও এক দেশের আরও অনামী কোনও এক গ্রামের প্রেক্ষিতে। সেটা এই বাংলাদেশ হতেও পারে, আবার আফগানিস্তান বা কাজাখস্তানেরও হতে পারে! আসলে যে কোনো দেশের একনায়কতান্ত্রিক শাসক চায় সব্বাইকে “চুপ” করিয়ে রাখতে, ভয় দেখিয়ে যে কোনও প্রতিবাদের স্বরকে চাপা দিতে!
“ধস” নাটকের বিষয়টাও তাই। সেখানকার সামরিক শাসক নির্দেশ জারি করেছে বছরের নয় মাস সারা গ্রামে কোনওরকম শব্দ করা যাবে না। জোরে হাঁচি কাশি, কান্না – চিৎকার সব বন্ধ। উচ্চকিত যে কোনও শব্দই নাকি পাশের পাহাড়ে জমে থাকা বরফের চাই ভেঙে নেমে এসে পুরো গ্রামটাকেই চাপা দেবে, সবার মৃত্যু অবধারিত। এই ভয়টাই শাসকগোষ্ঠী চায় জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে রাখতে। যার ফলে কেউ কোথাও কোনও ভাবেই শাসনের বিরুদ্ধে কোনও স্বর তুলতে না পারে! এমন একটা পরিবেশে একটি ছোট্ট পরিবারে এক সন্তানের আবির্ভাব সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। সন্তানসম্ভবা সেই নারী গর্ভযন্ত্রানায় চিৎকার করে উঠলে বাড়িতে ঢুকে পড়ে মিলিটারি কায়দায় এক নার্স।
[আরও পড়ুন: বিবেকানন্দকে নিজের স্কুলের চাকরি থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন বিদ্যাসাগর! কেন রুষ্ট হয়েছিলেন তিনি? ]
গ্রামের শাসক প্রেসিডেন্ট নিদান দেয় ওই নারীকে জ্যান্ত অবস্থায় কফিনে ঢুকিয়ে কবর দেওয়া হোক। যেমন এক ঘটনার সাক্ষী ছিল পরিবারের বয়স্ক দাদু(অসিত বসু) ও ঠাকুমমা(সোহাগ সেন) বেশ কিছু বছর আগে। তাঁর ছেলে(কজ্জ্বল ঘোষ), বৌমা(সুতপা ঘোষ), নাতি (সুনয়ন খোটেল), নাতবৌ(মধুঋতু দাশগুপ্ত)দের নিয়েই এখনকার সংসার। নাতবৌ এরই সন্তান নাকি হবে সরকারি ভাষায় “অসময়ে”! অর্থাৎ সরকারি নিয়ম ভঙ্গ করে স্বামী স্ত্রী মিলিত হয়েছে অসময়ে, সুতরাং শাস্তি অপরিহার্য! শাস্তি কার্যকর করার মুহূর্তে বন্দুক হতে তুলে নেয় প্রথমে নাতি এবং পরে ছেলে। সন্তান ভূমিষ্ঠ হয় চিৎকৃত কান্না নিয়ে, বন্দুকের ফাঁকা আওয়াজও হয়, কিন্তু পাহাড়ের বরফ ভেঙে পড়েনা। ভীতিমুক্ত হয় সব্বাই। এতদিনের ধারণা, বিশ্বাস ধূলিসাৎ হয়ে যায়। শাসকদলের সাজানো ভয়ের পরিবেশ আর থাকবে না, এমন ইঙ্গিত রেখেই শেষ হয় নাটক।
বঙ্গিকরন হয়েছে সুষম ভাবেই, কিন্তু প্রযোজনায় বাঙ্গলিপনা ব্যাপারটি প্রতিটি চরিত্রের সঙ্গে তেল জলের মতো রয়েছে, মিশ্রণ ঘটেনি। বোঝা যায়, নাটকটি বিদেশি! পরিচালনার কাজটি সোহাগ সেন তাঁর নিজস্ব কৃতকৌশলে ঘটনা ও চরিত্রগুলোকে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক করতে প্রয়াসী, কিন্তু বাদ সেধেছে অনুবাদ। যেনো তেলের মতো ভাসছে প্রযোজনার গায়ে, প্রযোজনা জলের মতো সাবলীল গতিতে এগিয়েছে। বাবুল সরকারের আলো, কৌশিক বসুর আবহ নিশ্চয়ই নাটকীয় পরিস্থিতি তৈরি করায় সহযোগীর ভূমিকা নির্বাহ করেছে।
সবচাইতে নজর কেড়েছেন শিল্পীরা। সোহাগ সেন নিজে যেখানে অভিনয় শিক্ষক, সেখানে অভিনয়ে কোনো খামতি থাকবেনা সেটাই স্বাভাবিক। সোহাগের ঠাকুমা, অসিত বসুর দাদু এক কথায় অনবদ্য। বিশেষকরে অসিতবাবু বয়সের ভার এবং স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর তেতো-মিষ্টি সম্পর্কের ব্যাপারটা সুন্দর প্রকাশ করেছেন। দুই বৌমার চরিত্রে সুতপা এবং মধুঋতুও স্বাভাবিক, বাড়তি নম্বর পাবেন সুতপা! “অনসম্বল” প্রযোজিত এই নাটক জানিয়ে দিল, সোহাগ সেন এই সময়ের দাবিকে অস্বীকার করেননি, প্রতীকের আড়ালে হলেও সত্যটাকেই প্রকাশ করেছেন।