বিশ্বদীপ দে: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (World War II) ও সুপারহিরো। মনে হতেই পারে আপাত সম্পর্কহীন দুটো নাম। এ যেন জোর করে গরুর রচনায় কুমিরের কাঁটাওয়ালা লেজের প্রসঙ্গ উত্থাপন। কিন্তু তা নয়। সত্যিই গত শতাব্দীর তিনের দশকের শেষ ভাগে শুরু হওয়া মহারণ যেভাবে গোটা দুনিয়ার ইতিহাস, সংস্কৃতি, জনজীবন সর্বত্র বিপুল প্রভাব বিস্তার করেছিল, কমিকস দুনিয়াও তার বাইরে ছিল না। কমিকসের প্রথম ‘ম্যান’ সুপারম্যানের (Superman) জন্মই তো আবেগজর্জর মার্কিন (US) দেশপ্রেমের প্রচারের হাতিয়ার হয়ে। এবং পরবর্তী সময়েও এই সুপারহিরোদের জন্ম ও কার্যকলাপে বারবার ছায়া ফেলেছে সেই প্রভাবই। এও এক ইতিহাস।
কমিকস জগৎ থেকে ধীরে ধীরে অন্যান্য মাধ্যমেও জোরকদমে ঢুকে পড়েছে সুপারহিরোরা। সেও বহুদিন হল। মুক্তি পেয়েছে ‘স্পাইডারম্যান (Spider-Man) নো ওয়ে হোম’। হইহই করে মানুষ ভিড় জমাচ্ছেন সিনেমা হলে। যদিও মাকড়সা মানুষের জন্ম ১৯৬২ সালে। কিন্তু একথা তো অস্বীকার করা যায় না দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ না হলে হয়তো মার্কিন মুলুকে এই ভাবে মুড়ি-মুড়কির মতো ছড়িয়ে পড়ত না ব্যাটম্যান, আয়রনম্যানরা।
[আরও পড়ুন: ভেঙে পড়ে বিমান, মেলে না খোঁজ! আজও রহস্যময় ওড়িশার ‘বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল’]
ব্যাপারটা খুলেই বলা যাক। আসলে ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলেও কার্যত তার দামামা বেজে গিয়েছিল কয়েক বছর আগে থেকেই। গোটা পৃথিবীর উপরে ছড়াতে শুরু করেছিল এক কালো ছায়া। আধুনিক পৃথিবীর অন্যতম খলনায়ক অ্যাডলফ হিটলারের জার্মানিতে তখন ইহুদিদের উপর নাৎসিদের নির্যাতন ততদিনে শুরু হয়ে গিয়েছে। দেশ ছেড়ে পালিয়ে আসছেন বহু শরণার্থী। অন্যান্য দেশের মতো তাঁরা ভিড় জমাচ্ছেন আমেরিকাতেও। গোটা ইউরোপ জুড়েই এক তীব্র অস্থিরতা। আর এই সময়ই জন্ম হয় নতুন ধরনের মার্কিন কমিকস ও জ্যাজের মতো সংগীতের। একই আর্থ-সামাজিক পটভূমিতে তাদের সৃষ্টি।
কমিক বুক গবেষক ও ইতিহাসবিদ টি অ্যান্ড্রু ওয়াহল একটি বই লিখেছেন ‘সুপারহিরো আমেরিকা: দ্য কমিক বুক ক্যারেক্টার অ্যাজ হিস্টোরিক্যাল লেন্স’ নামে। সেখানেই তিনি লিখেছেন সুপারহিরোদের প্রথম পুরুষ সুপারম্যানের জন্মকথা। তিনি পরিষ্কার জানাচ্ছেন, সুপারম্যানের গল্প আসলে শরণার্থীর গল্প। লোকটা পৃথিবীতে এসেছিল বিধ্বস্ত ক্রিপটন গ্রহ থেকে। বিজ্ঞানী বাবার মহাকাশযানে চেপে। স্মলভিল শহরের জোনাথন ও মার্থা কেন্ট তাকে নাম দেয় ক্লার্ক কেন্ট। ক্রমে আবিষ্কৃত হয় তার অতিমানবিক ক্ষমতা। বড় হয়ে সেই বালক হয় একজন রিপোর্টার। কিন্তু মানুষের মঙ্গল কামনায় সেই হয়ে ওঠে অতিমানব। এই যে উন্নত জীবনের খোঁজে আমেরিকায় আসা, এ আসলে সেই সময়ের চেনা ছবি। সেই কমিকসের স্রষ্টা ১৭ বছরের জেরম সিগাল ও তার বন্ধু জো শাসটার, তারাও ছিল ইহুদি শরণার্থী পরিবারেরই দুই কিশোর। তারাই ১৯৩৮ সালে সৃষ্টি করল সুপারম্যানকে।
[আরও পড়ুন: ৫০ বছরেও অধরা! বিমান অপহরণ করে অন্ধকারে মিলিয়ে যাওয়া সেই ‘যাত্রী’ আজও নিখোঁজ]
এপ্রসঙ্গে বলা যেতেই পারে সুপারহিরোদের আরও কয়েকজন বিখ্যাত স্রষ্টার কথা। স্ট্যান লি, জ্যাক কিরবি, জো কুবার্ট, উইল এইসনারের মতো মানুষরাও কিন্তু সকলেই নির্যাতিত ইহুদি পরিবারের সন্তান। আর সেই কারণেই কমিকসের ডিএনএ হয়ে দাঁড়িয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও নাৎসি অত্যাচারের জলছাপ।
সুপারম্যানে শুরু। প্লাস্টিকম্যানে শেষ। ১৯৩৮ থেকে ১৯৪১। এই কয়েক বছরে সৃষ্টি হয়েছে এক ডজন ম্যান। সুপারম্যান, ব্যাটম্যান, স্যান্ডম্যান, অ্যামেজিংম্যান, আলট্রাম্যান, ডলম্যান, বুলেটম্যান, হকম্যান, অ্যাকুয়াম্যান, হ্যাংম্যান ও প্লাস্টিকম্যান। সংখ্যাটা হয়তো আরও বাড়ত। কিন্তু ১৯৪২ সালে কমিকস জগতে আবির্ভূত হয় সুপারস্নাইপ। আসলে বিশ্বযুদ্ধ তখন চরমে। আর সেই সঙ্গে লাফিয়ে লাফিয়ে চাহিদা বাড়ছে সুপারহিরোদের। কিন্তু সবাই সুপারম্যান কিংবা ব্য়াটম্যান নয়। সেই সব অক্ষম অনুকরণকে খোঁচা মেরেই সৃষ্টি করা হয় আট বছরের কুপি ম্যাকফ্যাডকে। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি কমিকস বইয়ের মালিক সেই বালক। তার অলীক অ্যাডভেঞ্চারের তীব্র কষাঘাতে থমকাতে একপ্রকার বাধ্য হন কমিকস শিল্পীরা।
যে কথা আগেই বলা হয়েছে, সুপারম্যান ছিল মার্কিন জাতীয়তাবাদের প্রতীক। তার পরনের পোশাকে নীল ও লাল রঙের আধিক্যই তার প্রমাণ। এবং এই প্রভাব অন্যান্য কমিকসেও পড়েছিল। ১৯৪০ সালের ‘লুক’ পত্রিকায় একটি স্পেশাল কমিকস পাওয়া গিয়েছিল। সেখানে অ্যাডলফ হিটলার ও জোসেফ স্ট্যালিনের দেখা মিলেছিল। এদিকে ক্যাপ্টেন মার্ভেল ও অন্যান্য সুপারহিরোদের সঙ্গে নাৎসি ও জাপানি সেনাদের লড়াইয়ের ছবি রীতিমতো প্রচ্ছদ আলো করে থাকত। সেই সময়ের কিছু জবরদস্ত ভিলেনের নাম ক্যাপ্টেন নাৎসি, দ্য রেড স্কাল, ব্য়ারন গেস্টাপো, ক্যাপ্টেন নিপ্পো ও ক্যাপ্টেন স্বস্তিকা। নামগুলোর আড়ালে কারা রয়েছে ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন। ১৯৪১ সালে পার্ল হারবারে জাপানের বোমা ফেলার ঘটনার আগে থেকেই এই প্রবণতা দেখা গিয়েছিল। ততদিনে কমিকসের সেন্সর কোড তৈরি হয়নি। ফলে ইচ্ছেমতো খুন-জখম, রক্তারক্তি অ্যাকশনের ছবিও ব্যবহার করা যেত।
সেই যে শুরু থেকেই একটা ঘরানা তৈরি হল, সেটাই কমিকসের এই সব সুপারহিরোদের গল্পতে প্রভাব রেখে গেল। উদাহরণ দেওয়া যাক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে রুশ-আমেরিকা ঠান্ডা যুদ্ধের আবহে ক্যাপ্টেন আমেরিকার গল্পে ঢুকে পড়ে সোভিয়েত-বিরোধী প্রপাগান্ডা। আবার সাতের দশকে দেখা যায় মার্ভেল ইউনিভার্সের গোপন এক সংস্থায় রয়েছেন রিচার্ড নিক্সন ও হেনরি কিসিঞ্জার। প্রথমজন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ও দ্বিতীয় জন তৎকালীন মার্কিন মুখ্য় নিরাপত্তা উপদেষ্টা!
৯/১১ পরবর্তী সময়ে ক্যাপ্টেন আমেরিকা চলে যায় মধ্যপ্রাচ্যে সন্ত্রাসবাদীদের মোকাবিলা করতে। যুদ্ধ জিনিসটার জনপ্রিয়তা কমতে শুরু করায় অন্যান্য দিকে গল্পের অভিমুখ বদলে গিয়েছে। স্ট্যান লি যখন এক্স মেন সৃষ্টি করেছেন, তখন তার মধ্যে তৎকালীন মার্কিন নাগরিক অধিকার আন্দোলনকে মাথায় রেখেই গল্পের কাঠামো তৈরি করেছিলেন। সব মিলিয়ে কমিকসের শরীর থেকে প্রচ্ছন্ন রাজনৈতিক ছায়াকে সরানো যায়নি। বহু সময়ই শিল্পী ও প্রকাশকের মধ্যে মতান্তরও হয়েছে নিজস্ব রাজনৈতিক মতামত কমিকসে প্রচার করা নিয়ে।
সময় বদলেছে। আর যুগধর্ম মেনে জটিল হয়েছে কমিকসের কাহিনি কাঠামো। আসলে সুপারম্যান কিংবা ব্যাটম্যানদের চরিত্রই এমন জটিল যে সেখানে আরও জটিল রূপকের আশ্রয় নেওয়া যায়। আসলে এভাবেই সমসময়ের নাড়ির স্পন্দন বারবার কমিকসকে প্রভাবিত করেছে। করে চলেছে। কিন্তু সেটা অন্য প্রসঙ্গ। মোদ্দা কথা হল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ না হলে কি সত্য়িই এই সুপারহিরোদের পেতাম আমরা? নাকি একেবারেই ভিন্ন দিকে গড়াত কমিকস নামের শিল্পমাধ্যমটি? হয়তো সুপারহিরোরা আসতই। কিন্তু তাদের চরিত্র হত আলাদা। ঘটনা এগোত অন্যভাবে। বিশ্বযুদ্ধ বহু কিছুই তো চিরতরে বদলে দিয়েছিল। কমিকস তার মধ্যেই অন্যতম।