বিশ্বদীপ দে: 'গল্পের সেরা হাত'। JIS গ্রুপ নিবেদিত সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটালের উদ্যোগে, সমসময়ের অক্ষরশিল্পের সেরা উদযাপন হয়ে গেল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায়। ইন্ডিয়ান সেন্টার ফর কালচারাল রিলেশন-এর (আইসিসিআর) সত্যজিৎ রায় অডিটোরিয়ামের এই অনুষ্ঠান হয়ে উঠেছিল চাঁদের হাট। আর সেই অনুষ্ঠানে কথা বলার সময় প্রধান অতিথি স্বপ্নময় চক্রবর্তী তাঁর স্বভাবসিদ্ধ রসস্নিগ্ধ উচ্চারণে জানিয়ে দিলেন, যতই গেল গেল রব উঠুক, সব কিছু হারিয়ে যায়নি এখনও।
এই আয়োজনের সহ-নিবেদনে ছিল 'ইনফিনিটি' ও 'শ্যামসুন্দর কোং জুয়েলার্স', সহযোগিতায় ছিল 'দে'জ পাবলিশিং', 'সাহিত্য সংসদ', 'তন্তুজ', 'গিটস', 'স্পাইসেস অ্যান্ড সসেজ' ও 'অরুণ সাইন'। পৃথ্বীদেব ভট্টাচার্যের সরোদবাদন দিয়ে শুরু হয়েছিল অনুষ্ঠান। এরপরই ছিল স্বপ্নময়ের বক্তব্য জ্ঞাপন। সরোদের সুরলহরীর প্রতি মুগ্ধতা প্রকাশ করে তাঁকে বলতে শোনা গেল, ''প্রায় ৪৫ মিনিট ধরে সরোদ হল। যখন আস্তে আস্তে তান বিস্তার করছিল, তখন মনে হচ্ছিল দশ-পনেরো সেকেন্ডের রিলের যুগে সরোদ হচ্ছে! তার মানে মিক্সি এসে গেলেও শিলনোড়া এখনও আমাদের রান্নাঘরে আছে। এই যে গল্প প্রতিযোগিতা, সেখানে চারশোর কাছাকাছি গল্প এন্ট্রি হয়েছে। তার মানে এখনও এগুলো আছে! রয়ে গিয়েছে...''
সংবাদ প্রতিদিনের প্রতি তাঁর নিজস্ব ঋণের কথাও এদিন শোনা গেল বর্ষীয়ান সাহিত্যিকের মুখে। 'হলদে গোলাপ'-এর স্রষ্টা বললেন, ''মনে পড়ে শিয়ালদা থেকে বেলেঘাটার দিকে যেতে যে রাস্তাটা পড়ত সেখানেই ছিল প্রতিদিনের অফিস। সেই সময় থেকেই প্রতিদিনের সঙ্গে যুক্ত রয়েছি। রবিশংকর বল, কমল চৌধুরীদের সঙ্গে কাজ করেছি। এখন আমি রোববার ডট ইনে একটা ধারাবাহিক লিখছি। 'ব্লটিং পেপার' নামে।''
স্বপ্নময় ছাড়াও এদিন বক্তব্য রাখেন প্রতিযোগিতার তিন প্রধান বিচারক সাহিত্যিক অমর মিত্র, বিনোদ ঘোষাল ও মৌমিতা। প্রসঙ্গত, আরও এক বিচারক প্রতিভা সরকার বিদেশে থাকায় এদিনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারেননি। প্রবীণ সাহিত্যিক অমর মিত্র জানালেন বিচারক হিসেবে তাঁর অভিজ্ঞতার কথা। বললেন, ''আমাকে যত পড়তে হয়েছে তার মধ্যে সাইজে বেশ ছোট এমন গল্প যেমন ছিল, আবার বড় গল্পও পেয়েছি। আমার মনে হয়েছে, যাঁরা গল্প লিখেছেন তাঁরা শব্দসংখ্যার কথা ভেবে গল্পকে ছোট বা বড় করতে চাননি। কোনও কোনও গল্পে বর্ণনা খুব সুন্দর। কোনও কোনও গল্পে অলৌকিকতা রয়েছে। আবার রাজনৈতিক গল্পও আছে। নানা রকম গল্প পেয়েছি। আমার আশা, এঁরা নিয়মিত লিখলে নিশ্চয়ই পরিণত লেখক হয়ে উঠবেন।''
গল্প কেমন করে লেখা যায় সেই বিষয়েই ভাবীকালের গল্পকারদের উদ্দেশে অমরের বার্তা, ''মনে রাখবেন গল্প নানা ভাবে লেখা যায়। কখনও কখনও লিখতে লিখতে আটকে গেলে কাউকে মুখে সেটা বলতে পারেন। বা লেখা হয়ে গেলে কাউকে পড়ে শোনালেও নিজের গল্পের ত্রুটি চোখে পড়ে যাবে। আমি এই বয়সেও টেলিফোনে গল্প বা উপন্যাসের বিষয় আলোচনা করি আমার তরুণ বন্ধুদের সঙ্গে।''
সাহিত্যিক বিনোদ ঘোষালের বক্তব্য শুরু হল সংবাদ প্রতিদিনে প্রথম লেখার স্মৃতিচারণার মধ্যে দিয়ে। তিনি বললেন, ''মনে পড়ে ২০০৯ সালে 'রোববার'-এ আমি প্রথম লিখি। সেটা আমার কাছে একটা পরম আনন্দের দিন ছিল। এই কুড়ি-বাইশ বছরে আমি সবথেকে বেশি লেখা লিখেছি 'সংবাদ প্রতিদিন'-এই। ফিচার তো বটেই গল্প-উপন্যাসও লিখেছি। 'কে বাজায় বাঁশি' আমার প্রথম ধারাবাহিক উপন্যাস। সেটাও ছেপেছিল রোববার।''
আর সেই কথা বলতে গিয়েই বিনোদ জানান, ''বরাবর দেখেছি নতুন প্রজন্মের জন্য লেখালেখির একটা পরিসর তৈরি করে দিয়েছে সংবাদ প্রতিদিন। সব সময়ই নতুনদের উৎসাহ দেওয়ার একটা প্রতিফলন আজকের অনুষ্ঠান।''
বিচারক হিসেবে গল্প পড়ার অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে তাঁকে বলতে শোনা যায়, ''গল্পগুলো কেমন লেগেছে সেটা বড় কথা নয়। আসলে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি, বাংলা ভাষা যে ক্রমাগতই কোণঠাসা হয়ে যাচ্ছে তার বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে আপনারা যাঁরা কলম ধরলেন এবং সংবাদ প্রতিদিনের মতো সংস্থা যারা সেই কলমগুলিকে সামনে নিয়ে আসছেন সেটাই আমাদের পরস্পরের প্রতি পুরস্কার প্রদান। যাঁরা নতুন লেখালেখি করছেন মনে রাখবেন, বিচারক বলে কিছু হয় না। আপনার লেখার চূড়ান্ত বিচারক কিন্তু আপনি নিজে। যত সময় যাবে তত এটা বুঝতে পারবেন।''
ছোটদের গল্পের বিচারের ভার ছিল সাহিত্যিক মৌমিতার উপরে। তিনি বলেন, ''লেখাগুলো পড়তে গিয়ে তাদের কল্পনাপ্রবণতার পরিচয় যেমন পেয়েছি, একই সঙ্গে তাদের লেখা মধ্যে সৃজনশীলতার ছাপও দেখেছি। আমার মনে হয়েছে প্রত্যেকটা লেখাই প্রবল সম্ভাবনাময়। হয়তো এরাই একদিন বাংলা সাহিত্যকে উজ্জ্বল করবে। তবে মনে রাখতে হবে পরিশ্রমের কোনও বিকল্প নেই। কাজেই সেটা করে যেতে হবে।'' সেই সঙ্গেই তিনি মনে করিয়ে দিলেন, ''লেখকের আগেও আমরা সকলেই পাঠক। আর সেখান থেকেই লেখার ইচ্ছে হওয়া। আসলে আমি যে অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি তা আমারই। তাই আমার কথা তো আমাকেই বলতে হবে।''
প্রসঙ্গত, এদিন মঞ্চে ছিলেন দেজ পাবলিশার্সের দুই কর্ণধার সুধাংশুশেখর দে এবং শুভঙ্কর দে, শিশুসাহিত্য সংসদের কর্ণধার দেবজ্যোতি দত্ত, সঙ্গীতশিল্পী, পরিচালক ও সংবাদ প্রতিদিনের রোববারের সম্পাদক অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়, সাহিত্যিক ও সংবাদ প্রতিদিনের কনসালটেন্ট এডিটর কুণাল ঘোষ এবং সংবাদ প্রতিদিনের প্রধান সম্পাদক সৃঞ্জয় বোস। সব মিলিয়ে মঞ্চ ছিল তারকাখচিত। গুণীজন সমাগমে এই অসাধারণ সন্ধ্যা বুঝিয়ে দিয়ে গেল বাঙালি আজও গল্পতরু।