৫০ বছর আগেও রাস্তার ধারে গ্রামেগঞ্জে কত সারি সারি বড় বড় বট, অশ্বত্থ, আম, জাম, তেঁতুল, নিম, মহুয়া, কুসুম প্রভৃতি গাছ দেখা যেত। ওইসব গাছ ছিল বহু পাখির নিরাপদ আশ্রয়। শুধু তাই নয়, ওইসব গাছের ফল পাখিরা খেত। বিভিন্ন কারণে আজ ওইসব গাছগুলি নিশ্চিহ্ন। বড় বড় গাছ থাকায় ফলে বৃষ্টির পরিমাণ বেশি হত, প্রকৃতি অনেক ঠান্ডা থাকত, জল ও মাটি সংরক্ষণ হত। এইসব গাছের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে লিখেছেন বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. তাপসকুমার চৌধুরী।
আমাদের ছোটবেলার কথা এখন মনে পড়ে, ১৯৭১ সাল। আজ থেকে ৫০ বছর আগেকার কথা। তখন রাস্তার ধারে গ্রামেগঞ্জে কত সারি সারি বড় বড় গাছ দেখতে পাওয়া যেত। যেমন বট, অশ্বত্থ, আম (Mango), জাম, তেঁতুল, নিম, মহুয়া, কুসুম প্রভৃতি। ওই গাছগুলো এমন বড় ছিল যে, যার পাশ থেকে হেঁটে যেতেও ভয় করত। ওইসব গাছ ছিল বহু পাখির নিরাপদ আশ্রয়। শুধু তাই নয়, ওইসব গাছের ফল (Fruit) পাখিরা খেত। রাস্তার শ্রীবৃদ্ধির ফলে, বারবার প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে, কাঠ ব্যবসায়ীদের নজরে আসার ফলে ও বয়সের ভারে, আজ ওইসব গাছগুলি নিশ্চিহ্ন। বিকেলবেলায় পাখিরা যখন বাসায় ফিরত, তখন অনেক দূর-দূরান্ত থেকে তাঁদের কলরব শোনা যেত, আজ বহু পাখিকে আর দেখতে পাওয়া যায় না এবং তাঁদের ডাকও শুনতে পাওয়া যায় না, কারণ তাঁদের বাসস্থান ও খাদ্যের অভাবে তারা বিপন্ন। এই গাছগুলি যে পাখিদের আশ্রয় দিত তা নয়, গ্রামের বহু কচিকাঁচা ঢিল ছুঁড়ে ফল পেড়ে খেত এবং এক ধরনের পুষ্টির জোগান হত। শুধু তাই নয়, বড় বড় গাছ থাকায় ফলে বৃষ্টির পরিমাণ বেশি হত, প্রকৃতি অনেক ঠান্ডা থাকত, জল ও মাটি সংরক্ষণ হত। পাতা ও ডালপালা পশুদের খাদ্য হিসাবে ব্যবহার হত। অবশেষে বলি তখন অত যানবাহন ছিল না, মানুষ পায়ে হেঁটে মাইলের পর মাইল যেত এবং এইসব গাছের তলায় বিশ্রাম নিত। যদি আমরা রাস্তার ধারে ফল গাছ লাগানোর প্রয়োজনীয়তা মনে করি তাহলে এটাই সঠিক সময় সিদ্ধান্ত নেওয়ার, সেজন্য সরকারি প্রতিষ্ঠান, গ্রামবাসী ও প্রযুক্তিবিদদের একসঙ্গে বসে পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে।
[আরও পড়ুন:ভরা বর্ষাতেও শুকনো খটখটে ধানের জমি, মাথায় হাত ঘাটালের চাষিদের ]
আজ থেকে প্রায় ৮-৯ বছর আগে একটি পরিকল্পনার কথা আমার মাথায় এসেছিল এবং কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্র, সোনামুখী, বাঁকুড়া জেলায় তা আমি রূপায়ণ করেছিলাম ২৫টি SHG-কে নিয়ে এবং জেলার আর্থিক সহায়তায়। এখান ২৫টি SHG তৈরি করেছিল প্রায় ২৫ লক্ষ চারা এবং প্রতিটি চারার পিছনে খরচ হয়েছিল মাত্র ২ টাকা। কীভাবে চারা তৈরি করা হয়েছিল এবং তা রাস্তার ধারে লাগানো হয়েছিল সে বিষয়ে আলোকপাত করা হল। প্রথমে রাস্তার ধারগুলি বেছে নেওয়া দরকার এবং ওইসব রাস্তার ধারে কোন কোন গাছ আছে তা জেনে নেওয়া দরকার। ওইসব গ্রামে কোন কোন SHG গুলি ভাল কাজ করছে এবং তাদের আর্থিক ক্ষমতা জেনে নেওয়া দরকার। ওই SHG সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেওয়া দরকার কীভাবে চারা তৈরি করতে হয় এবং পরিচর্যা করতে হয়। এই কাজটি শীতকাল নাগাদ করে ফেলতে হবে। তারপর তাঁদের জায়গায় নার্সারি বানানোর জন্য ভাল করে বেড়া দিতে হবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে, পাশে যেন কোনও পুকুর বা জলের উৎস থাকে। বসন্তকালে ৬x৬ ইঞ্চি কালো পলিথিন প্যাকেটের মধ্যে মাটি ও গোবরসার (৩:১ অনুপাতে) ভরে দিতে হবে। এখানে কিন্তু সব চারাবীজ ও আঁটি থেকে তৈরি করা হবে, যেমন যেমন বীজ ও আঁটি পাওয়া যাবে তেমনিভাবে ওই প্যাকেটের মধ্যে দিয়ে খড় চাপা দিয়ে জল দিতে হবে। রোজ সকালে। জৈষ্ঠ্য মাসের মধ্যে চারা তৈরি হয়ে যাবে। বর্তমানে এই সব চারা তৈরি করতে চারা পিছু ১০ টাকা খরচ পড়বে। এক-একটি ১০ জনের SHG সদস্য এক লক্ষ চারা তৈরি করতে পারবে ৬ মাসে। চারার বয়স যখন ১৫ দিন হয়ে যাবে, তখন প্রতিটি গাছে ১০ গ্রাম করে দানাসার (NPK-10-26-26) এবং সরষের খোল পচা জল দিতে হবে ১৫ দিন অন্তর। চারাগুলির শিকড় মাটিকে ধরে নেবে, সেজন্য এক মাস অন্তর শিফটিং করতে হবে। ব্লাইটকস ২ গ্রাম লিটার জলে এবং ডার্সবান ৩ মিলিলিটার জলে গুলে মাসে একবার করে দিতে হবে।
এবার আসা যাক চারা লাগানোর ব্যাপারে। বৈশাখ-জৈষ্ঠ্য মাসে ২x২ ফুট গর্ত করে একমাস যাবৎ রোদ খাওয়াতে হবে। তারপর প্রতি গর্তে গোবরসার আধঝুড়ি + ১০০ গ্রাম নিমখোল + ১০০ গ্রাম সরষের খোল দিয়ে গর্ত করে দিতে হবে জৈষ্ঠ্য মাসের শেষের দিকে। আষাঢ়ের মাঝামাঝি প্রতি গর্তে ২৫ গ্রাম (NPK-Ro-১০-২৬-২৬) দিয়ে চারা বসিয়ে দিতে হবে। সরাসরি বীজ বা আঁটিকে গর্তে লাগানো যেতে পারে। সেক্ষেত্রে প্রতি গর্তে ২টি করে বীজ বা আঁটি বসাতে হবে। সেরা গাছটি রেখে দেওয়ার পর অন্যটি তুলে ফেলে দিতে হবে। তবে এখানে জমিতে পরিচর্যা করা কষ্টসাধ্য ব্যাপার। প্রত্যেক ক্ষেত্রে নাইলনের জাল দিয়ে বেড় দিতে হবে এবং গাছের গোড়ায় উপরোক্ত সারের মিশ্রণ ১ মাস দিয়ে রাখতে হবে। চারা লাগানো ও ১ বছরের পরিচর্যা করার জন্য গাছ প্রতি ১০ টাকা করে SHG সদস্যদের দিতে হবে।