সন্দীপ্তা ভঞ্জ: নীল জার্সির প্রমিলা বাহিনীর বিশ্বজয়ের আবহে 'হইচই'তে মুক্তি পেল 'অনুসন্ধান'। দেশজুড়ে যখন নারীশক্তির জয়গান, তখন এমন আবহে 'কামাল' দেখালেন বাংলা সিনেইন্ডাস্ট্রির তিন নারী। পরিচালক অদিতি রায়, চিত্রনাট্যকার সম্রাজ্ঞী বন্দ্যোপাধ্যায় এবং 'প্রোটাগনিস্ট' শুভশ্রী গঙ্গোপাধ্যায়। সিরিজের আনাচে-কানাচে তিন নারীর দক্ষতার স্বাক্ষর স্পষ্ট। চিত্রনাট্যের পরতে পরতে যেমন রহস্য-রোমাঞ্চ জিইয়ে রেখেছেন সম্রাজ্ঞী, তেমনই অদিতির স্মার্ট-দক্ষ পরিচালনা। যার সঙ্গে যোগ্যসঙ্গত শুভশ্রীর অভিনয়।
'পুরুষ প্রবেশ নিষিদ্ধ' রূপপুর জেলে 'অসূর্যস্পর্শ্যা' মহিলা কয়েদিদের লাগাতার অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার নেপথ্যের কারণ 'অনুসন্ধান' করতে গিয়ে বিপাকে পড়েন ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্ট অনুমিতা সেন। মরচে ধরা সিস্টেমের বিরুদ্ধে মুখ খোলার মাশুল কীভাবে গুনতে হয় সেই মহিলা সাংবাদিককে? সেই গল্প নিয়েই এগিয়েছে অদিতি রায়ের 'অনুসন্ধান'। ৭ পর্বের এই ওয়েব সিরিজের শেষ থেকে শুরু মুগ্ধ করে শুভশ্রীর পারফরম্যান্স। কখনও অন্তঃসত্ত্বা কয়েদি, আবার কখনও বা দাপুটে সাংবাদিকের বেশে তাঁর অভিনয় হাততালি কুড়িয়ে নেয়। ডিগ্ল্যাম লুক। চোখেমুখে আঘাতের চিহ্ন নিয়ে শুধুমাত্র চোখ দিয়ে যেভাবে অভিনয় করেছেন তিনি, তাতে হলফ করে বলা যায়, শুভশ্রী বাংলা সিনেইন্ডাস্ট্রির 'ডার্ক হর্স'। নায়িকা থেকে অভিনেত্রী হিসেবে তাঁর উত্তরণ অনেক আগেই হয়েছে, তবে অদিতির 'অনুসন্ধান'-এর সুবাদে 'অভিনেত্রী শুভশ্রী'কে নতুনভাবে আবিষ্কার করার সুযোগ পাবেন দর্শকমহল। এপ্রসঙ্গে ক্লাইম্যাক্স দৃশ্যের একটি রেফারেন্স না দিলেই নয়! যেখানে দেখা যায়, পুলিশ ভ্যানে ঘাপটি মেরে বসে থাকা সাংবাদিক অনুমিতা গল্পের অ্যান্টাগনিস্ট (খলচরিত্র) নারায়ণ সান্যালের মুখোমুখি হন। সেই দৃশ্য কোথাও যেন 'অসুরবধে'র কথা মনে করায়। এক লহমায় বদলে যাওয়া শুভশ্রীর বডি ল্যাঙ্গুয়েজ মনে করায়, 'দিওয়ার' সিনেমার বচ্চন সাহেবকেও! গল্পের প্রেক্ষাপট বাস্তব হলেও কল্পনারসের মিশেলে অদিতি-সম্রাজ্ঞীর 'অনুমিতা' কিন্তু চরিত্রটিকে জীবন্ত করে তুলেছে। সাহেব চট্টোপাধ্যায়ের মতো অভিনয়ের 'পাওয়ার হাউস'-এর সঙ্গে প্রতিটা ফ্রেমে পাল্লা দিয়ে অভিনয় করা চ্যালেঞ্জিং হলেও শুভশ্রী গঙ্গোপাধ্যায় অতি দক্ষতার সঙ্গে সেটা করে দেখিয়েছেন।
ক্ষমতার দম্ভ, শরীরী লালসায় মেতে ওঠা রাজনীতিক নারায়ণ সান্যালের ভূমিকায় সাহেব বাজিমাত করেছেন। চিত্রনাট্য মাফিক ব্যাটে-বলে ছক্কা হাঁকানো যাকে বলে। কারাগারের ভারপ্রাপ্ত 'চাটুকার' পুলিশের ভূমিকায় সাগ্নিক চট্টোপাধ্যায় প্রশংসার দাবিদার। আর হ্যাঁ, এই সিরিজের অন্যতম বড় প্রাপ্তি সোহিনী সেনগুপ্ত। মিষ্টিমুখো খলনায়িকা 'মিলি মিত্রে'র চরিত্রে তিনি মনে করালেন 'কাহানি'র কনট্রাক্ট কিলার বব বিশ্বাস শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়কে। অদিতিকে ধন্যবাদ বাংলা ওয়েব সিরিজের দুনিয়ায় এহেন একটি চরিত্রকে পরিচয় (উপহার দেওয়ার) করানোর জন্য। 'মিলি মিত্রে'র কুকীর্তি দেখার জন্য অনায়াসে আলাদা একটা সিরিজ আবদার করা যায়। স্বল্প পরিসরে স্বাগতা মুখোপাধ্যায়, সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অরিত্র দত্ত বণিক যথাযথ।
'অনুসন্ধান' দেখতে বসে কোথাও একঘেয়ে মনে হয় না, তার বড় কারণ মেদহীন ঝরঝরে চিত্রনাট্য। যেখানে সম্রাজ্ঞীর পাশাপাশি কৃতীত্বের অংশীদার অয়ন চক্রবর্তীও। হইচইয়ের পর্দায় এর আগেও একাধিক থ্রিলার সিরিজ মুক্তি পেয়েছে। তবে পরিচালক অদিতির মুন্সিয়ানায় এই সিরিজ টেক্কা দেওয়ার ক্ষমতা রাখে সর্বভারতীয় স্তরের যে কোনও সিরিজকে। সিনেমা-সিরিজের মাধ্যমে এর আগেও নারীশক্তির জয়গান গেয়েছেন অদিতি রায়। তবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কর্তব্যে অবিচল থাকা এক মহিলা সাংবাদিকের সফর যেভাবে প্রতিটা ফ্রেমে তিনি তুলে ধরেছেন, তার জন্যে পরিচালককে কুর্নিশ জানাতেই হয়। যুক্তি-বুদ্ধির মারপ্যাঁচ বর্জিত সরল ন্যারেটিভ, 'অনুসন্ধান' সিরিজের অন্যতম ইউএসপি। দর্শক হিসেবে আপাতত দ্বিতীয় মরশুমের অপেক্ষায়। তবে শেষপাতে 'প্রশাসনের দালাল' শব্দটিতে চতুর্থ স্তম্ভকে হেয় করলেন কিনা? সেটা পরের সিজনে জানার অপেক্ষায় রইলাম।
