shono
Advertisement

Breaking News

India Football

অন্ধকারে দেশের ফুটবল! 'বিদেশি'দের দলে নেওয়া কি নিছকই চমক? বিশ্লেষণে আরাতা-সঞ্জয় সেনরা

দেশে কি ফুটবলার কম পড়েছে? বিশ্লেষণে আরাতা, মেহতাব, সঞ্জয় সেন।
Published By: Arpan DasPosted: 06:46 PM Nov 10, 2025Updated: 06:46 PM Nov 10, 2025

অর্পণ দাস: দেশে কি ফুটবলার কম পড়িয়াছে? থুড়ি, দেশে ফুটবল লিগ কম পড়িয়াছে। ভারতবর্ষে ফুটবল লিগ আদৌ হবে কি না, তা নিয়েই বিরাট প্রশ্নচিহ্ন। আইএসএলের কোনও বিডার নেই। ফের ফেডারেশন থেকে বল ঠেলা হয়েছে মহামান্য সুপ্রিম কোর্টে। এর মধ্যে ভারতীয় দলের ম্যাচ। নেহাতই নিয়মরক্ষার। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যে ফলই হোক না কেন, তাতে এশিয়ান কাপের দরজা খুলবে না। অর্থাৎ, আগামী দু'বছরের জন্য ব্লু টাইগার্সরা মাঠে নেমে যাই করুন না কেন, তা বৃহত্তর কোনও লক্ষ্যে পৌঁছে দেবে না। এই অবস্থায় দলে ডাকা পড়েছে 'বিদেশি' রায়ান উইলিয়ামস ও অবনীত ভারতীর। দেশের ফুটবলের উদ্বেগময় পরিস্থিতিতে এই প্রক্রিয়া কি শুধুই চমক? দীর্ঘমেয়াদী সমাধান না খুঁজে সাময়িক সান্ত্বনা দেওয়া? সেই নিয়ে মুখ খুললেন বাংলার কোচ সঞ্জয় সেন, প্রাক্তন ফুটবলার মেহতাব হোসেন ও আরাতা ইজুমি।

Advertisement

এই মুহূর্তে ভারতীয় দলের র‍্যাঙ্ক ১৩৬। খালিদ জামিল আসার পর কাফা কাপে তৃতীয় হলেও এশিয়ান কাপে যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি। সামনে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নেহাতই নিয়মরক্ষার ম্যাচ। সেখানে ডাক পেয়েছেন দুই 'বিদেশি'। ডিফেন্ডার অবনীত ভারতী ভারতীয় বংশোদ্ভূত। নেপালে জন্মানো ২৭ বছর বয়সি ফুটবলার এখন বলিভিয়ার ক্লাবে খেলেন। বরং দ্বিতীয় নামটি যথেষ্ট পরিচিত। বেঙ্গালুরু এফসি'র রায়ান উইলিয়ামস বেশ কয়েকবছর ভারতীয় ফুটবলে রয়েছেন। অস্ট্রেলিয়ার বাসিন্দার মায়ের দিকের শিকড় রয়েছে ভারতে। সেই সূত্রে অস্ট্রেলীয় নাগরিকত্ব ছেড়ে ভারতের হয়ে খেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

রায়ান উইলিয়ামস ও অবনীত ভারতী।

এই সিদ্ধান্তে ফুটবল সমর্থকদের একটা অংশ খুশি। তবে ভারতীয় ফুটবলে বিদেশি বংশোদ্ভূতদের নেওয়ার আর্জি আজ থেকে নয়। আবার এটা কোনও নতুন ঘটনাও নয়। বিদেশি বংশোদ্ভূত ভারতীয় ফুটবলার বললে প্রথমেই মনে আসে আরাতা ইজুমির কথা। ২০০৬ সালে ইস্টবেঙ্গলে খেলতে এসেছিলেন। তারপর পুনে এফসি-সহ আইএসএলের এটিকে বা কেরালা ব্লাস্টার্সে খেলেছেন। বাবার দিক থেকে তাঁর মধ্যে ভারতীয় রক্ত ছিল। এদেশের মহিলাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছেন। তাঁর কাছেই প্রথম প্রশ্ন গেল, এটাই কি পথ? আরাতার সটান উত্তর, "এতে একটা সমস্যা আছে। বিদেশি নাগরিক বা বিদেশি বংশোদ্ভূত প্লেয়াররা সম্পূর্ণ অন্য সংস্কৃতি ও পরিবেশে বড় হয়েছে। এখন প্রশ্ন হল, সেই দায়বদ্ধতা ও আবেগ নিয়ে কি তাঁরা ভারতের প্রতিনিধিত্ব করবেন? যদি ভারত বিশ্বের সব দেশে ছড়িয়ে থাকা সব পিআইও এবং ওসিআই প্লেয়ারদের নিয়ে আসে, তাতেও সেটা স্বল্পমেয়াদী সাফল্যই দেবে। তাতে এশিয়ার বড় দেশগুলোর সঙ্গে লড়াই করার শক্তি পাওয়া যাবে না। অনেক দেশই এই পদ্ধতি নিয়েছে। কিন্তু সাফল্য পেয়েছে খুব কম দেশই। এভাবে বিদেশি বংশোদ্ভূতদের না ডেকে ভারতের উচিত নিজস্ব প্রতিভা অন্বেষণ করা এবং তাঁদের বিকশিত করা। একেবারে তৃণমূল স্তর থেকে ফুটবলার তুলে আনার দিকে নজর দিতে হবে। জাপান ঠিক তাই করেছে। নিজেদের পরিকাঠামোয় বিনিয়োগ করেছে। একেবারে গোড়া থেকে প্রতিভা তুলে এনেছে।"

ভারতীয় ফুটবল দলে আরাতা-মেহতাবরা। ফাইল চিত্র

এই দায়বদ্ধতা ও আবেগের কথা বললেন মেহতাব হোসেনও। জাতীয় দলে আরাতার সঙ্গে খেলেছেন। রায়ানদের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে ইস্টবেঙ্গলের মিডফিল্ডার জেনারেলের বক্তব্য, "আরাতার সঙ্গে তুলনা চলে না। ও দেশের মেয়েকে ভালোবেসে বিয়ে করেছে। এদেশের মাটিকে ও চেনে, সংস্কৃতিকে ভালোবাসে।" আরাতা নিজেও স্বীকার করলেন, "বিদেশি বংশোদ্ভূত খেলোয়াড়দের জাতীয় দলে আনা একটি ভালো সিদ্ধান্ত হতেই পারে। কিন্তু আসল বিষয়টি হল এই সিদ্ধান্তের পিছনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। আমি প্রায় ৫ বছর ভারতে থাকার পর জাপানের নাগরিকত্ব ত্যাগ করেছি। ভারতীয় ফুটবলের প্রতি আমার একাত্মতা দায়বদ্ধতা থেকে সেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। রায়ান উইলিয়ামসের মতো একজন প্লেয়ার যদি সেই দায়বদ্ধতা থেকে ভারতের হয়ে খেলার সিদ্ধান্ত নেন, তবে তা অবশ্যই সম্মানযোগ্য।" দুই নতুন প্লেয়ারকে নিয়ে তাঁর বক্তব্য, "রায়ান অভিজ্ঞ প্লেয়ার। আশা করি ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে সফল হবে। অবনীত সম্পর্কে আমার ততটা ধারণা নেই। ওর জন্য শুভকামনা রইল।"

ভারতীয় ফুটবল দল। ফাইল ছবি

মেহতাব বা সঞ্জয় সেন সেভাবে বিষয়টি দেখছেন না। মোহনবাগানকে আই লিগ দেওয়া কোচ বলছেন, "আমাকে একটা কথা বলুন, এরা কতদিন ফুটবল খেলবে? এই পদ্ধতিটা খেটে গেলে লোকে বাহবা দেবে। সোশাল মিডিয়ায় মাতামাতি হবে। আসলে আমাদের তো বিদেশি দেখলেই জিভ লকলক করে। আমার কথা হল, ভারতীয় ফুটবলের উন্নতি করতে হলে দেশীয় ফুটবলার তুলে আনতে হবে। সেটা না করে এইসব করলে শেষ পর্যন্ত দীর্ঘমেয়াদি ক্ষেত্রে উপকার হবে না।" আরও সুর চড়িয়ে মেহতাব বলছেন, "রায়ান উইলিয়ামসের বয়স ৩২। অর্ধেক সময়টা অস্ট্রেলিয়ায় কাটিয়েছে। সে আর কতটা সার্ভিস দেবে? কাউকে ছোট না করেই বলছি, রায়ান ভালো প্লেয়ার। কিন্তু যদি সেরকম বিশ্বমানের হত, তাহলে তো প্রতিবছর আইএসএল জিতত। এরা তো কেউ মেসি, রোনাল্ডো, নেইমার নয়। তাহলে পার্থক্য কী হবে? আর যদি ৩২-র কাউকেই সুযোগ দিতে হয়, তাহলে ৪০-র সুনীল ছেত্রী কেন খেলবে না?"

প্রাক্তন জাতীয় দলের মিডফিল্ডারের সংযোজন, "যদি নিতেই হয়, তাহলে যাঁরা জার্মানিতে, ইংল্যান্ডে, স্কটল্যান্ডে খেলছে, তাঁদের ফেরানোর চেষ্টা করা হোক। যাঁরা দেশের মাটিতে খেলছে, তাঁরা ছোটবেলা থেকে পরিশ্রম করছে। তাহলে তাঁরা কোথায় যাবে?" কিন্তু দেশে কি সত্যিই সেরকম প্রতিভা আছে? বা থাকলেও তারা কোথায়? কেন 'বিদেশি'দের উপর ভরসা করতে হচ্ছে? এআইএফএফ আদৌ কতটা সক্রিয়? সঞ্জয় সেন বললেন, "সেগুলো যাঁরা হর্তাকর্তা বিধাতা, তাঁরা বলতে পারবেন। আমরা ছোট মানুষ। আমাদের বক্তব্যের আদৌ কি গুরুত্ব আছে? এগুলো আমাদের দৈন্যদশাকে প্রকট করছে। আমরা নিজেদের দেশের ফুটবলার তুলতে পারি না। যদি এতে দেশের ফুটবলের উপকার হয়, তাহলে ভালো। কিন্তু কতটা কী হবে সেটা তো ভবিষ্যৎ বলবে।"

আরাতাও ভবিষ্যতের দিকে তাকাচ্ছেন। তবে তিনি অনেক আশাবাদী। ভারতে ফুটবল প্রতিভার অভাব নেই, কিন্তু তাদের তুলে আনার কী পদ্ধতি আছে? আরাতা বললেন, "এদেশে প্রতিভা নেই, এটা আমি কোনও ভাবেই মানতে পারব না। আমি ২০১৮-২০২৩ এই পাঁচ বছর রিলায়েন্স ফাউন্ডেশনের ইয়ং চ্যাম্পসে কাজ করেছি। তারও আগে পুনেতে খেলার সময় একটি বাচ্চাকে দেখেছিলাম। এমনি নিজের পাড়ায় সমবয়সিদের সঙ্গে খেলছিল। তাঁকে খেলতে দেখে সবার আগে যেটা আমার মাথায় আসে, একে জাপানে নিয়ে যেতে হবে। ওই বাচ্চাটা আমার চোখ খুলে দিয়েছিল। রিলায়েন্স ফাউন্ডেশনেও আমি এরকম প্রচুর বাচ্চাকে দেখেছি, যাদের ওরকম প্রতিভা ছিল। আমার বা রায়ানের এই দেশে খেলাটা হয়তো বিরল ঘটনা। আসল কথা হল, আমাদেরকে দেশের উঠতি প্রতিভাদের জন্য যেভাবেই হোক রাস্তা করে দিতে হবে। নাহলে আমাদের এগোনোর কোনও উপায় নেই।"

আরাতা ইজুমি। ছবি: ফেসবুক

কিন্তু এগোবে কীভাবে? দেশের ফুটবল লিগগুলোই যে বন্ধ। আইএসএলের বিডার নেই। অনেকে দোষারোপ করছেন এফএসডিএলকে বা রিলায়েন্সকে। কিন্তু তাহলে আই লিগ বন্ধ কেন? সেটা তো ফেডারেশন নিজেই আয়োজন করে। বরং এই বিডার না পাওয়াটা ভারতের ফুটবল পরিচালনার চূড়ান্ত অযত্নকে প্রকট করে। আশ্চর্যের বিষয়, ৬ নভেম্বর রায়ানদের দলে অন্তর্ভুক্ত করার কথা ঘোষণা করা হয়। আর বিড জমার শেষদিন বাড়িয়ে করা হয় ৭ নভেম্বর। ৬ নভেম্বর নিশ্চয়ই পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে, কোনও বিডার নেই। তাহলে কি রায়ানদের দলে নেওয়াটা একটা 'চমক'? আরও আগেই তো তাঁদের নাম ঘোষণা করা যেত? সঞ্জয় সেন স্পষ্ট বলে দিলেন, "আমরা তো সাম্প্রতিক সময়ে ভালো ফল করতে পারিনি। সামনের ম্যাচগুলো জিতলেও আমাদের কিছু করার নেই। এই অবস্থায় রায়ান উইলিয়ামসের মতো প্লেয়ারদের নেওয়া একটা চমক! এআইএফএফ তো এভাবেই চলছে। এখনও পর্যন্ত দেশের লিগটা চালু করতে পারল না। আইএসএল কবে হবে? আই লিগ কবে হবে? কেউ জানে না। দেশের লিগটা যারা চালাতে পারে না, তারা এই সস্তা পদ্ধতি নেয়।"

সঞ্জয় সেন। ছবি: আইএফএ।

মেহতাব আবার পালটা প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে বলছেন, "আগে বলো আমাদের লিগ কবে? লিগ থেকে কীভাবে প্লেয়ার তুলে নিয়ে আসবে? সেসবের বালাই নেই। কোনও মডেল স্ট্রাকচার নেই, কোনও ক্যালেন্ডার নেই। কীভাবে যে চলছে এআইএফএফ! সুপার কাপে একটা দল খেলার একমাস পর সেমিফাইনাল। ইস্টবেঙ্গল ধীরে ধীরে ফর্মে আসছে। সেখানে ম্যাচ পড়ছে একমাস পর। কেউ জানে না, কোথায় ম্যাচ হবে। এটা মোহনবাগানের সঙ্গেও হতে পারত। সেখানে এই পদক্ষেপগুলো পুরোপুরি ভাঁওতাবাজি।"

মেহতাব হোসেন। ফাইল চিত্র

আপাতত ভারতীয় ফুটবল একটি জগদ্দল পাথর। আদৌ কোনও গতি হবে কি না কেউ জানে না। ভক্তদের একরাশ হতাশ মুখ একটা আলোর রেখার দিকে তাকিয়ে। মোহনবাগানের অনুশীলন বন্ধ। সোশাল মিডিয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করছেন ইস্টবেঙ্গলের ফুটবলার সৌভিক চক্রবর্তী-দেবজিৎ মজুমদার থেকে ইন্টার কাশীর কোচ আন্তোনিও হাবাস। প্রশ্ন উঠছে, উঠেই চলেছে। যত দিন যাবে তার সংখ্যা বাড়বে। যাদের উত্তর দেওয়া কাজ, তাদের সম্বল সোশাল মিডিয়ায় একটি বিবৃতি পোস্ট করা। অনেকেই বলছেন, এবার আর কথা নয়, কাজ চাই। সেটা নিশ্চয়ই বিদেশি বংশোদ্ভূতদের দেশীয় জার্সি পরানোয় নয়। বরং দেশীয় জার্সি পরা ফুটবলাররা বিদেশের ক্লাবগুলোতে খেলুক। দিশাহীন পথ ছেড়ে সুর্নিদিষ্ট রোডম্যাপ তৈরি হোক। ফিফার ব্যান নয়, বিশ্বকাপে যোগ্যতা অর্জন করুক। সেটুকু চাওয়া কি খুব বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে?

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

হাইলাইটস

Highlights Heading
  • দেশে কি ফুটবলার কম পড়িয়াছে? থুড়ি, দেশে ফুটবল লিগ কম পড়িয়াছে।
  • ভারতবর্ষে ফুটবল লিগ আদৌ হবে কি না, তা নিয়েই বিরাট প্রশ্নচিহ্ন।
  • আইএসএলের কোনও বিডার নেই। ফের ফেডারেশন থেকে বল ঠেলা হয়েছে মহামান্য সুপ্রিম কোর্টে।
Advertisement