shono
Advertisement
Pritika Barman

দেশকে তুলেছে এশিয়ান কাপে, রায়গঞ্জে বাড়ি ফিরতেই সংবর্ধনায় ভাসল দশম শ্রেণির প্রীতিকা

শারীরিক সমস্যা অতিক্রম করেই জাতীয় দলে জায়গা করে নেয় প্রীতিকা।
Published By: Arpan DasPosted: 09:17 PM Oct 20, 2025Updated: 09:18 PM Oct 20, 2025

শংকর কুমার রায়, রায়গঞ্জ: তখন ভয়ানক মুহূর্ত। খেলতে খেলতে এক টাকার কয়েন মুখে পুরে হঠাৎ গলার নলিতে আটকে শ্বাসবন্ধ হয়ে গিয়েছিল তার। শেষমেশ গলা থেকে সেই টাকার কয়েন দীর্ঘ চেষ্টায় বের করে সেদিনের মতো একরত্তি কন্যার প্রাণ রক্ষা করেছিলেন স্বয়ং বাবা। তখন তার বয়স ছিল সবে মাত্র চার বছর। সেই থেকে গলার স্বরে জড়তা আজও স্পষ্ট। কিন্তু শারীরিক জড়তাকে হেলায় উড়িয়ে এবার প্রথম এশিয়ান কাপ ফুটবলের যোগ্যতা অর্জন পর্বের অনূর্ধ্ব-১৭ ভারতীয় মহিলা ফুটবল দলে জায়গা করে নিয়েছিল রায়গঞ্জের প্রত্যন্ত গ্রামের সেই প্রীতিকা বর্মণ। সেদিনের প্রাণ ফিরে পাওয়া মেয়েটিকে নিয়ে সোমবার সংবর্ধনায় ভাসল রায়গঞ্জ।

Advertisement

নিজের স্বপ্ন আর কঠোর পরিশ্রমের জোরে জয় করার জেদ যেন ছোটবেলা থেকেই তার রক্তে। আর সেই জেদেই স্থানীয় নুড়িপুরের অজ গাঁয়ের বাড়ি থেকে প্রায় সাড়ে চার কিলোমিটার পথ রোজ সাইকেল করে হাতিয়া হাই স্কুলে আসা যাওয়া শুরু। ভর্তির পঞ্চম শ্রেণি থেকেই প্রীতিকার ফুটবল প্রীতি দেখে নজর পড়েছিল স্কুলে ক্রীড়া শিক্ষক অনুপ কেরকেট্টার। তারপর থেকে শুরু প্রশিক্ষণে কসরত।

বাবা কাশীনাথ বর্মন দিল্লিতে পরিযায়ী শ্রমিক ছিলেন। কিন্তু কোভিডের গ্রাসে কাজ হারিয়ে বাড়ি ফিরতে বাধ্য হয়েছিলেন। তারপর জনমজুরে অন্যের জমিতে চাষাবাদ করে তীব্র আর্থিক অনটনের সংসার চালান। আর মা পুতুলদেবী বাড়ির কাজে দিনভর ব্যস্ত থাকেন। সোমবার সকালে গৌরী পঞ্চায়েতের নুড়িপুরের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল গ্রামবাসীদের উপচে পড়া ভিড়। বাঁশ বেড়া আর মরচে পড়া টিন ছাউনির একফালি ঘরেই ঠাসা বিভিন্ন ট্রফি প্রীতিকার। ছোট্ট ঘরের সামনে বিস্তীর্ণ উঠোনে সকলের নয়ণের মণি কিশোরী ফুটবলারকে নিয়ে মেতে উঠলেন গ্রামবাসীরা। মানপত্র তুলে দিয়ে সোনার কন্যাকে সংবর্ধিত করলেন রায়গঞ্জের প্রাক্তন বিধায়ক কংগ্রেসের মোহিত সেনগুপ্ত। সেইসঙ্গে আর্থিক সাহায্যের হাতও বাড়িয়ে দিলেন তিনি।

প্রীতিকা বর্মনকে সংবর্ধনা রায়গঞ্জের প্রাক্তন বিধায়ক মোহিত সেনগুপ্ত। পাশে বাবা কাশীনাথ বর্মন।

উত্তর দিনাজপুরের রায়গঞ্জ হাতিয়া হাই স্কুলের দশম শ্রেণির এই ছাত্রী যাবতীয় প্রতিবন্ধকতাকে পাত্তা না দিয়ে অনুর্ধ্ব ১৭ জাতীয় মহিলা ফুটবল দলের বাংলার হয়ে জাতীয় দলের ট্রায়ালে বেঙ্গালুরুতে সুযোগ পান ফেব্রুয়ারিতে। তারপর ভুটানের চাংলিমিথাং ফুটবল স্টেডিয়ামে অনূর্ধ্ব-১৭ ভারতীয় মহিলা ফুটবল দলের হয়ে প্রথম সাব গেমসে একাদশের খেলোয়াড় হিসাবে সুযোগ পেয়ে বাংলাদেশ এবং ভূটানকে পরাস্ত করে চ্যাম্পিয়ন ট্রফি ছিনিয়ে নেন। আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। সুযোগ আসে এশিয়া কাপের কোয়ালিফাই রাউন্ডে।

চরম দারিদ্রতা মেখেই পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে বড় হয়ে ওঠা এই লড়াকু কন্যা এবছর এশিয়ান কাপের যোগ্যতা অর্জন পর্বের অনুর্ধ্ব১৭ ভারতীয় মহিলা ফুটবলের কাজাখস্তানে জায়গা করে নিয়েছিল। ২০২৬-এ এশিয়ান কাপ ফুটবল প্রতিযোগিতায় মহিলা ভারতীয় দলের হয়ে চিনের ময়দানে নামবে। রবিবার রাতে দিল্লি থেকে বাগডোগরা বিমান বন্দর নেমে সোজা সড়ক পথে রায়গঞ্জে পৌঁছতেই প্রীতিকাকে হুটখোলা গাড়ি নিয়ে শহরের রাস্তায় মিছিল করে সম্মান জানান রায়গঞ্জবাসী। এদিন বাবা কাশীনাথ বর্মন বলেন,"বাড়ির পাশেই নুড়িপুর প্রাথমিক স্কুলে পড়ার সময় থেকে ফুটবলের প্রতি প্রচণ্ড ভালোবাসা। তারপর পঞ্চম শ্রেণিতে হাতিয়া হাই স্কুলে ভর্তি করাতে ওই স্কুলের শিক্ষক অনুপ কেরকেট্টা এবং ঠাকুর প্রসাদ রায় একদিন আমার বাড়িতে এসেছিলেন। তারপর থেকে সেই হাতিয়া স্কুল থেকে সব কোচিং ব্যবস্থা।"

প্রায় ভেঙে পড়া টিনের চালের ঘরের কোণে কয়েকশো ট্রফি প্রীতিকার দখলে। মাটির বারান্দায় নিজের ছবির পাশে দাঁড়িয়ে প্রীতিকা অস্ফুটস্বরে জানান, "স্কুলের পরিচালন সমিতির সভাপতি অরিজিৎ ঘোষ প্রাক্তন ফুটবলার। তিনিও নানাভাবে আর্থিক সাহায্য করেছেন। বেঙ্গল ন্যাশনাল ক্যাম্প বেঙ্গালুরুতে যাওয়ার বিমানের টিকিট কেটে দিয়েছিলেন।" সদ্য অবসর নেওয়া স্কুলের প্রধান শিক্ষক গৌতম সিনহা বলেন," ভুটানে সাব গেমসে চ্যাম্পিয়ন। তারপর জাতীয় মহিলা দলের হয়ে এশিয়া কাপ খেলার সুযোগ। বাড়িতে আর্থিক অনটনের মধ্যেও প্রীতিকা নিজের চেষ্টায় নিজেকে এমন জায়গায় তুলে ধরেছে। এটা দেশের গর্ব।" হাতিয়া হাই স্কুলের বর্তমান ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক সুব্রত গুহ বলেন,"প্রীতিকা ভারতের মহিলা ফুটবল দলের হয়ে খেলছেন। অনূর্ধ্ব-১৭ এশিয়ান কাপে ভারত খেলার সুযোগ পেয়েছে। সেখানে রায়গঞ্জের প্রীতিকা দলের হয়ে খেলবে।" প্রীতিকা আজ সকলের প্রিয়। ভালোবাসার এক অনন্য অনুভুতি প্রীতিকা স্বয়ং আজ।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

হাইলাইটস

Highlights Heading
  • নিজের স্বপ্ন আর কঠোর পরিশ্রমের জোরে জয় করার জেদ যেন ছোটবেলা থেকেই তার রক্তে।
  • সেই জেদেই স্থানীয় নুড়িপুরের অজ গাঁয়ের বাড়ি থেকে প্রায় সাড়ে চার কিলোমিটার পথ রোজ সাইকেল করে হাতিয়া হাই স্কুলে আসা যাওয়া শুরু।
  • ভর্তির পঞ্চম শ্রেণি থেকেই প্রীতিকার ফুটবল প্রীতি দেখে নজর পড়েছিল স্কুলে ক্রীড়া শিক্ষক অনুপ কেরকেট্টার।
Advertisement