বর্তমান সমাজে শিশু ধর্ষণের ঘটনা ক্রমবর্ধমান হওয়া উদ্বেগজনক। এরাজ্যে বিশেষত কন্যাসন্তানদের নিয়ে মা-বাবাদের চিন্তা যেন দিন দিন বাড়ছে। কিন্তু কেন এমন অমানবিক অপরাধের সংখ্যা লাফিয়ে বাড়ছে? কেন বয়স বাড়লেও মানুষের মনে থেকে যায় এমন নোংরা প্রবৃত্তি? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে সমাজ, শিক্ষা, এবং মানসিকতার গভীর বিশ্লেষণ প্রয়োজন। বললেন সাইকিয়াট্রিস্ট ডা. দেবাঞ্জন পান। লিখলেন জিনিয়া সরকার।
যে আদরে আহ্লাদ আছে, সেই আদরই যদি বিকার হয় তবে সাবধান। এমনকী, ঘটে না? ছোটবেলায় প্রিয় দাদা হাতটা ধরে আদর করার ছলে করেছিল ব্যাডটাচ, কিংবা চেনা কাকু সবসময়ই যা চাওয়া হত তাই কিনে দিত কিন্তু এই মন ভোলানোর ছলেই নিয়েছিল সুযোগ। যা আজও ভাবলে শিউরে ওঠে মন। আদতেই শিশুমনকে খুশি করার ছলে মনের মধ্যে থাকা নৃসংশতা যখন বেরিয়ে আসে তখন সেটা এক ভয়াবহ যৌন নির্যাতন।
অতি চেনা আত্মীয় থেকে পাড়া প্রতিবেশী যাঁদের চোখ বন্ধ করে ভরসা করা যায়, তাঁদের দ্বারাই যে কোনও সময় যৌন হেনস্তার ঘটনা খবরের কাগজের পাতা ওলটালেই নিত্য চোখে পড়ে। সাত মাসের শিশু থেকে সাতবছরের শিশু কিংবা আরও কম বা একটু বেশি বয়সি যারা সচরাচর এমন কুনজরের চক্করে পড়ে। এর মতো লজ্জার, ঘৃণার আর কিছু হতে পারে না। বয়সে ছোট বা সন্তানতুল্য (বয়ঃসন্ধির আগের শিশু) কারও প্রতি বয়জ্যেষ্ঠের যৌনচাহিদা এক প্রকার মানসিক বিকার। চিকিৎসা বিজ্ঞানের পরিভাষায় যার নাম পিডোফিলিয়া (Pedophilia)।
শিশুধর্ষণের ঘটনা এরাজ্যে ক্রমবর্ধমান। কেন এমন ঘটনার বাড়বাড়ন্ত? শিশু, বিশেষত কন্যাসন্তানকে নিয়ে ছোট বয়স থেকেই উদ্বিগ্নতা বাড়ছে মা-বাবাদের মধ্যে। আসলে রোগটা মানুষের মনে, কেন বয়স বাড়লেও মানসিকতার থেকে যায় এমন নোংরা অভিব্যক্তি?
চাপা কষ্ট
যাঁদের মধ্যে এই ধরনের মানসিক বিকার রয়েছে তাঁদের মনের মধ্যে এমন যৌনচাহিদা নিয়ে ভাবনা অহরহ চলতেই থাকে। এই তাড়না যতক্ষণ না পর্যন্ত প্রকাশ করতে পারছে ততক্ষণ চাপা কষ্ট তাড়া করে বেড়ায়। প্রথমে চেনা শিশুর সঙ্গেও দূরত্ব তৈরি ফেলে এরা। কারণ প্রথমে নির্যাতনকারী মনে করেন পাছে শিশুটিকে সে কষ্ট দিয়ে ফেলে! যখন আত্মনিয়ন্ত্রণ চলে যায় তখন এই বিকারগ্রস্ত মন কু-কাজটি করে ফেলে চেনা পরিধির মধ্যেই।
কাদের প্রতি জাগে
সাধারণত ১২-১৩ বছর বয়সি বা তার থেকে কমবয়সিদের প্রতি আকর্ষণ। এই অভিপ্রায় বা যৌন চাহিদা ছ’মাস ধরে বজায় থাকলে সেটা ধরে নিতে হবে এটা পিডোফিলিয়ার লক্ষণ। সমবয়সিদের প্রতি যৌন আকর্ষণ কিন্তু পিডোফিলিয়া নয়। এটা সাধারণত সেই নির্যাতন যেখানে নির্যাতিতা হবে ১২-১৩ বছর বয়সের কম বয়সি ও যে যৌন নির্যাতন করছেন সে হবে অন্তত পক্ষে পাঁচ বছরের বড় বা তার চেয়েও অনেক বেশি বয়সি।
দায়ী কে বা কী
শিশু যৌন নির্যাতনকারীদের এই অপরাধের তাড়না আসে কোথা থেকে?
সাধারণত যাদের এই ধরনের অসুখ আছে দেখা যায় তাদের হরমোনাল কিছু সমস্যা থাকতে পারে।
কিছু ক্ষেত্রে নিউরোলজিক্যাল সমস্যাও দায়ী হতে পারে। যাদের কখনও ট্রমাটিক ব্রেন ইনজুরি হয়েছে বিশেষত অল্পবয়সে এমন হলে পরবর্তীকালে নানা মানসিক সমস্যা হতে পারে। যা থেকেই পিডোফিলিয়ার মতো খারাপ অভিব্যক্তি প্রকাশ পায়।
কারও কারও ক্ষেত্রে মানসিক অবসাদও দায়ী হয়। বিভিন্ন নেশা বা আসক্তির কারণেও এমন ধরনের বিকারগ্রস্ততা তৈরি হতে পারে। অল্প বয়সে যৌন উৎপীড়নের শিকার বা সাক্ষী হলে তার বয়সকালে এমন মানসিক সমস্যা প্রকাশ পেতে পারে।
অনেকক্ষেত্রেই পরিবেশ এই ধরনের সমস্যার জন্য দায়ী। হতে পারে সেই মানুষটি অল্পবয়সে এমন পরিবেশেই বেড়ে উঠেছে, যার ফলে তার কাছে এটা স্বাভাবিক আচরণ হিসাবেই মনে হয়।
কীভাবে কাটিয়ে উঠবেন?
মনের মধ্যে এই অস্থিরতা চলতে থাকে, নোংরা প্রবৃত্তির জন্ম নেয়। এটা প্রকাশ করতে না পারলেও যার এমন হচ্ছে সে নিজে কিন্তু বুঝতেই পারে। বিশেষ করে শিশুর প্রতি একটা আকর্ষণ তৈরি হয়। এমন হলে বিহেভিয়ারাল থেরাপি করা দরকার। তাতে করে একজনের মনের মধ্যে থাকা বিকৃত ভাবনা-চিন্তাগুলো খুঁজে বের করে সেটা কাটিয়ে তোলা সম্ভব।
কেন একজনের এমন নোংরা প্রবৃত্তি জন্মাচ্ছে সেটাও কিন্তু এই থেরাপি করে নির্ণয় করা সম্ভব। কী ধরনের ট্রমা থেকে মনে এমন চিন্তা আসে তা বোঝাও জরুরি। কখনও কখনও মনের মধ্যে কোনও ‘কোর বিলিফ’ বা ‘ভ্রান্ত ধারণা’ তৈরি হতে পারে যা থেকেও এমন স্পৃহা পরবর্তীকালে প্রকাশ পেতে পারে। সেখানে বিহেভিয়ারাল থেরাপির মাধ্যমে সেই ভ্রান্ত ধারণাকে সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করে সেটাকে কাটিয়ে তুলতে সাহায্য করা হয়।
কিছু ক্ষেত্রে এমপ্যাথি ট্রেনিং করানো হয়। এখানে যে ব্যক্তি শিশুর উপর এই নির্যাতন করছে তাকে বোঝানো হয় শিশুর কতটা কষ্ট হচ্ছে বা হয়। ফলে সে ধীরে ধীরে বুঝতে শেখে মনের মধ্যে এই উন্মুখ প্রবৃত্তি কতটা খারাপ একটা জিনিস। আস্তে আস্তে মন বদলাতে থাকে।
কিছু ক্ষেত্রে অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট ওষুধ দেওয়ারও প্রয়োজন হয়। আবার কারও কারও ক্ষেত্রে এটা বাতিকেও পর্যবসিত হয়। সে ক্ষেত্রেও সাইকোট্রপিক ওষুধের ভূমিকা অনস্বীকার্য। প্রয়োজনে কিছু হরমোনাল ওষুধও দেওয়া হয়।
পেডোফিলিকদের হাত থেকে সন্তানকে রক্ষা করবেন কীভাবে?
এ ক্ষেত্রে আগাম সতর্কতা জরুরি। খুব আগে থেকে যৌন শিক্ষার পাঠ দিতে হবে শিশুকে। এখনও আমাদের সমাজে শিশুদের সঙ্গে এই ধরনের কথা বলতে অভিভাবকরা স্বতঃস্ফূর্ত বোধ করেন না। তাই এড়িয়ে যান। এই মানসিকতা বদলাতে হবে। শিশুর তিন-চার বছর বয়স থেকেই কতগুলি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস তাকে শেখাতে হবে। যেমন-
বোঝান কোনটা গুডটাচ ও ব্যাডটাচ। প্রথমে বোঝাতে হবে অধিকাংশ স্পর্শই ভালো। কিন্তু কোনও স্পর্শে যদি তার অস্বস্তি হয় সে যেন না বলে, প্রকাশ করে অভিভাবকদের কাছে।
চার-পাঁচ বছর বয়স থেকেই শিশুকে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ এমনকী, যৌনাঙ্গগুলিও চিনতে ও নামকরণ করত শেখানো দরকার।
শিশুকে শেখানো জরুরি, কেউ যদি তাকে আদর, আলিঙ্গন বা চুম্বন করতে আসে তবে শিশুর অনুমতি ছাড়া কেউ যেন তা না করে।
এগুলো সবই শিশুকে সহজবোধ্য ভাষায় বোঝাতে হবে তার মতো করে। তাহলে জীবনের শুরুতেই শিশু সতর্ক হবে ও এমন লোলুপ চাহনি থেকে নিজেকে রক্ষা করে পারবে। এদেশে তথা এরাজ্যে এইটুকু শিক্ষার চরম অভাব রয়েছে। তাই দিনে দিনে বাড়ছে এমন ঘটনা। সারাদেশে এই ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে উত্তরপ্রদেশ, মুম্বই, তার পরই রয়েছে এই রাজ্য। ২০১৯ সাল থেকে গত কয়েক বছরে শিশুদের উপর যৌন অত্যাচার বা ধর্ষণের মতো অপরাধ বেড়েছে প্রায় ৩৬ শতাংশ। এখনও সাবধান না হলে আর কবে?