সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: “মেরুন ব্যারেট কেউ এমনি এমনি পায় না, ওটা উপার্জন করতে হয়৷” প্যারাশুট রেজিমেন্টের জওয়ানদের মুখে এই কথাই শোনা গিয়েছিল সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের রাতে৷ ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রিমিয়ার এয়ারবোর্ন স্ট্রাইক ফোর্সের জওয়ানরা সেই রাতে শপথ নিয়েছিলেন, উরি হামলায় শহিদ জওয়ানদের হয়ে বদলা নিয়েই ফিরবেন৷
১৯ জন আধাসেনাই জানতেন, এটা টপ সিক্রেট মিশন৷ পাক রেঞ্জার্সদের হাতে ধরা পড়ে গেলে ভারত সরকার তাঁদের দায় নাও নিতে পারে৷ কিন্তু প্রাণ গেলেও দেশের আব্রুকে অক্ষত রাখতে ২৯ সেপ্টেম্বরের আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে তাঁরা পা রেখেছিলেন পাকিস্তানের মাটিতে৷ যে অভিযানের বিস্তারিত তথ্য ভারত সরকার এখনও প্রকাশ করতে চায় না৷ ৬৮ তম সাধারণতন্ত্র দিবসে সেই অকুতোভয় বীরদের শৌর্য পুরস্কারে সম্মানিত করেছেন রাষ্ট্রপতি৷ কিন্তু এবার একটি সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যম সেই কমব্যাট অপারেশনের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ গোপন তথ্য প্রকাশ্যে এনে ফেলেছে৷ ১৯ জন অধাসেনা সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের দায়িত্বে ছিলেন৷ যাঁদের মধ্যে ছিলেন একজন কর্নেল, পাঁচজন মেজর, দু’জন ক্যাপ্টেন, একজন সুবেদার, দু’জন নায়েব সুবেদার, তিনজন হাবিলদার, একজন ল্যান্সনায়েক ও প্যারা রেজিমেন্টের ফোর্থ ও নাইন ব্যাটালিয়ন্সের চারজন প্যারাট্রুপার৷
(সার্জিক্যাল স্ট্রাইকে অংশগ্রহণকারী জওয়ানদের সর্বোচ্চ শৌর্য পুরস্কার)
ফোর্থ ব্যাটালিয়নের মেজর রোহিত সুরিকে কীর্তি চক্র পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে৷ ফোর্থ প্যারা রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার কর্নেল হরপ্রীত সাধু পেয়েছেন যুদ্ধ সেবা মেডেল৷ এই হরপ্রীত সাধুই পাক জঙ্গিদের লঞ্চ প্যাডে পরপর দু’বার নিরবিচ্ছিন্ন আক্রমণ করেন৷ পাশাপাশি, সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের সামগ্রিক পরিকল্পনা নিখুঁতভাবে রূপায়ণের জন্য তাঁকে দেওয়া হয় যুদ্ধ সেবা মেডেল৷ জানা গিয়েছে, উরি হামলায় ১৭ জন জওয়ানের মৃত্যুতে ক্ষোভে ফুঁসছিল ভারতীয় সেনাবাহিনী৷ পাকিস্তানের লাগামছাড়া ঔদ্ধত্যের জবাব দিতে সার্জিক্যাল স্ট্রাইকে অংশ নিতে মুখিয়ে ছিলেন জওয়ানরা৷ কেউই বেঁচে ফিরে আসার আশা করেননি৷ ঘুমন্ত জওয়ানদের উপর নৃশংস হামলার বদলা নিতে শহিদ হতে তৈরি ছিলেন ১৯ জন জওয়ানই৷ সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের ব্লু-প্রিন্ট তৈরি হয়ে গেলেও অমাবস্যার রাতের অপেক্ষা করছিলেন জওয়ানরা৷ অবশেষে ২৮-২৯ সেপ্টেম্বরের রাতে মেজর রোহিত সুরির নেতৃত্বে আটজনের স্ট্রাইক টিম সীমান্ত পেরিয়ে পাকিস্তানে ঢোকেন৷ বিস্তারিত রেইকির পর সুরি তাঁর টিমকে নির্দেশ দেন, জঙ্গিদের লঞ্চপ্যাডে আঘাত হেনে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে৷ সুরি ও আরও দুই জওয়ান টার্গেটের মাত্র ৫০ মিটারের মধ্যে চলে আসেন৷ সেখানেই দুই জঙ্গিকে নিকেশ করে তাঁরা৷ কাছের জঙ্গলে আরও দুই জেহাদি লুকিয়ে রয়েছে বলে ড্রোন মারফত খবর পান রোহিত সুরি৷ নিজের প্রাণের কথা না ভেবে সুরি এগিয়ে যান জঙ্গিদের দিকে৷ গুলির লড়াইয়ে দুই জঙ্গি নিকেশ হয়৷ ২৭ সেপ্টেম্বর থেকে এই জঙ্গিদের ঘাঁটিগুলির উপর ড্রোন মারফত কড়া নজর রেখে চলছিলেন আর এক মেজর৷ নিয়ন্ত্রণরেখার ওপারে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক করার ৪৮ ঘন্টা আগে থেকেই চলছিল কড়া নজরদারি৷ জঙ্গিদের প্রতিটি গতিবিধির উপর নজর রাখছিল সেনা ড্রোন৷ সেই খবর প্রতি মুহূর্তে পৌঁছে যাচ্ছিল অভিযানরত সেনা অফিসারদের কাছে৷
(প্রয়োজনে ফের সার্জিক্যাল স্ট্রাইক, জানিয়ে দিলেন নয়া সেনাপ্রধান)
শৌর্য চক্রে ভূষিত ওই মেজরের নেতৃত্বে টার্গেট জোনকে চিহ্নিত করা হয়৷ কোথায় জঙ্গিদের অটোমেটিক রাইফেলস রয়েছে, সেই অস্ত্রাগারের খোঁজ, জঙ্গলের কোন দিক থেকে জঙ্গিরা পাল্টা আক্রমণ করতে পারে, প্রায় সবই জানা ছিল মেজরের৷ একদিকে অভিযানরত অফিসাররা জঙ্গিদের নিকেশ করেছিলেন, অন্যদিকে ওই মেজর ধীরে ধীরে তাঁর টিম নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন জঙ্গিদের অস্ত্র ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দিতে৷ এই সময় আচমকাই কাছের একটি অস্ত্রাগার থেকে জঙ্গিরা গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে এগিয়ে আসে ওই মেজর ও তাঁর টিমের দিকে৷ বিপদ আসন্ন বুঝে প্রায় বুকে ভর দিয়ে জঙ্গল ভেদ করে জঙ্গিদের অস্ত্রাগারের দিকে এগিয়ে গিয়ে এক জঙ্গিকে নিকেশ করে গুলির লড়াই স্তব্ধ করে দেন ওই মেজর৷
তৃতীয় মেজর ও তাঁর টিম এগিয়ে যাচ্ছিল ঘুমন্ত জেহাদিদের আরেকটি ঘাঁটির দিকে৷ তাঁর অতিরিক্ত দায়িত্ব ছিল, অভিযানরত সেনা জওয়ানদের নিরাপত্তার বিষয়টি সুনিশ্চিত করা৷ কোনও পরিস্থিতিতেই জঙ্গিদের মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে দেননি এই তৃতীয় মেজর৷ তাঁকেও পরে শৌর্য চক্রে পুরস্কৃত করা হয়৷
চতুর্থ মেজর গ্রেনেড ছুঁড়ে দু’জন জঙ্গিকে একেবারে কাছ থেকে নিকেশ করেন৷ গুঁড়িয়ে দেন জঙ্গিদের লুকনো অস্ত্র ঘাঁটি৷ তাঁকেও সাধারণতন্ত্র দিবসে সেনা মেডেল প্রদান করা হয়৷
(২০১১-তেও হয়েছিল সার্জিক্যাল স্ট্রাইক, তিন পাক সেনার মাথা কেটে আনেন কমান্ডোরা)
কোনও অবস্থাতেই এই সার্জিক্যাল স্ট্রাইক সহজ ছিল না৷ জঙ্গিদের ভারী গুলিবর্ষণের মুখে প্রাণ যাওয়ার আশঙ্কা ছিল যে কোনও সময়৷ পঞ্চম মেজর তিন জঙ্গিকে চিহ্নিত করেন, যাদের হাতে ছিল আরপিজি (রকেট প্রপেলড গ্রেনেডস)৷ কোনওভাবেই যেন সেই রকেট জওয়ানদের দিকে ধেয়ে না আসে, সেই লক্ষ্যে নিজে এগিয়ে গিয়ে জঙ্গিদের গুলির লড়াইয়ে ব্যস্ত রাখেন পঞ্চম মেজর৷ তাঁর গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যায় দুই জঙ্গি৷ এই সুযোগে অন্য দিক থেকে চতুর্থ মেজরের গুলিতে প্রাণ হারায় আরেক জঙ্গি৷ শুধু সেনা অফিসাররাই নন, প্যারাট্রুপাররাও এই অভিযানে অসম সাহসিকতার পরিচয় দেন৷ এক নায়েব সুবেদার গ্রেনেড ছুঁড়ে জঙ্গিদের লঞ্চপ্যাড গুঁড়িয়ে দেন ও প্রায় খালি হাতে দুই জঙ্গিকে নিকেশ করেন৷ তাঁকে দেওয়া হয়েছে শৌর্য চক্র৷ এই সুবেদার যখন দেখেন, জঙ্গিরা তাঁর জওয়ান ভাইয়ের দিকে ভারী গুলিবর্ষণ করছে, সেই সময় বাকিদের সুরক্ষিত স্থানে পাঠিয়ে নিজে এগিয়ে যান জঙ্গিদের নিকেশ করতে৷ গ্রেনেড ছুঁড়ে জঙ্গিদের খতম করে দেন নায়েব সুবেদার৷ সার্জিক্যাল স্ট্রাইকে কোনও জওয়ান শহিদ না হলেও এক প্যারাট্রুপার আহত হন৷ দুই জঙ্গিকে ধাওয়া করতে গিয়ে অসাবধানতাবশত ল্যান্ডমাইনের উপর পা রেখে দেন৷ তাঁর বাঁ পা বিস্ফোরণে উড়ে যায়৷ কিন্তু ওই অবস্থাতেও এক জঙ্গিকে খতম করেন ওই প্যারাট্রুপার৷
(টপ সিক্রেট মিশন বলে এই প্রতিবেদনে সেনাকর্মীদের আসল নামের পরিবর্তে ছদ্মনাম ব্যবহার করা হল)
The post জীবন বাজি রেখে কীভাবে শত্রুশিবিরে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক করেছিলেন জওয়ানরা? appeared first on Sangbad Pratidin.