বিশ্বদীপ দে: ‘…এটাই ভাল হবে। নিঃশব্দে যদি আমি আমার দায়িত্বপ্রাপ্ত এই দপ্তর ছেড়ে বেরিয়ে যাই।’ আজ থেকে প্রায় ৭০ বছর আগে ১৯৫৬ সালের নভেম্বরে তাঁর ইস্তফাপত্রে এই কথাটিই লিখেছিলেন লালবাহাদুর শাস্ত্রী (Lal Bahadur Shastri)। সেই সময় তিনিই ছিলেন দেশের রেলমন্ত্রী। তামিলনাড়ুর আরিয়ালুরে হওয়া রেল দুর্ঘটনার দায় নিজের কাঁধে নিয়ে ইস্তফা দিতে চেয়ে যে চিঠি তিনি লেখেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুকে, সেখানে সবথেকে বেশি চোখ টানে ‘নিঃশব্দে’ শব্দটিই। বালেশ্বরের মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পর অতীতে এদেশে ঘটে যাওয়া বহু ভয়ংকর রেল দুর্ঘটনার কথা উঠে আসছে। পাশাপাশি উঠে আসছে এই ইতিহাসও। লালবাহাদুর শাস্ত্রী ও ভারতীয় রাজনৈতিক আঙিনায় তাঁর সৃষ্টি করে যাওয়া সোনালি দৃষ্টান্তের কথা অনেকেরই মনে পড়ছে।
ইতিমধ্যেই বর্তমান রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণবের (Ashwini Vaishnaw) পদত্যাগের দাবি তুলেছে তৃণমূল কংগ্রেস। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত তাঁর ইস্তফা দেওয়ার কোনও গুঞ্জন শোনা যায়নি। প্রশ্ন উঠছে, তিনি কি বিরোধীদের দাবি মেনে পদ ছাড়বেন? নাকি দুর্ঘটনার দায় অন্য কাউকে নিতে হবে? কী হবে তা ভবিষ্য়ৎই বলবে। কিন্তু বর্তমান সময়ে যেখানে বারবার প্রশ্ন উঠছে, রাজনীতি কি সত্য়িই সাধারণ মানুষের সঙ্গে সংযোগ হারিয়ে ফেলেছে, সেখানে লালবাহাদুরের স্থাপন করে যাওয়া দৃষ্টান্তের কথা ফিরে ফিরে আসবে তা বলাই বাহুল্য।
[আরও পড়ুন: ওড়িশা ট্রেন দুর্ঘটনা: ভিডিও কলে স্ত্রীর সঙ্গে শেষ কথা, বাড়ি ফেরা হল না বর্ধমানের সফিকের]
প্রসঙ্গত, আরও একটু বিস্তারে মনে করা যাক সেই সময়ের কথা। ১৯৫৬ সালের আগস্টে অন্ধ্রপ্রদেশের মেহবুবনগরে হওয়া রেল দুর্ঘটনার সময়ও দায়িত্ব ছাড়তে চেয়েছিলেন লালবাহাদুর শাস্ত্রী। দুর্ঘটনার নৈতিক দায় নিজের কাঁধে নিয়ে। সেবার তাঁর ইস্তফা গ্রহণ করতে রাজি হননি নেহরু। এর ঠিক তিন মাস পরে নভেম্বরে ফের ঘটে যায় বড় দুর্ঘটনা। তামিলনাড়ুর আরিয়ালুরে রেল দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ১৪৪ জন। ফের ইস্তফাপত্র লেখেন তৎকালীন রেলমন্ত্রী। সেই চিঠিতে তাঁকে লিখতে দেখা যায়, ‘সামগ্রিক ভাবে আমার এবং সরকারের জন্য় এটাই ভাল হবে। নিঃশব্দে যদি আমি আমার দায়িত্বপ্রাপ্ত এই দপ্তর ছেড়ে বেরিয়ে যাই।’
এখানে বলে রাখা দরকার, সেই দুর্ঘটনার দায় কিন্তু লালবাহাদুর শাস্ত্রীর উপরে চাপানোও হয়নি। কথাটা উঠেছিল নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে। কিন্তু ব্যক্তি লালবাহাদুরের ইস্তফা দেওয়া উচিত, এমন কথা বলা হয়নি। তবুও স্বেচ্ছায় তিনি চেয়েছিলেন সরে যেতে। শেষ পর্যন্ত সেই ইস্তফা কিন্তু গ্রহণ করেছিলেন জওহরলাল নেহরু। লোকসভায় যদিও তিনি পরিষ্কার জানিয়েছিলেন, এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা তাঁর পক্ষে অত্যন্ত কঠিন ছিল। এবং বারবার তিনি জানিয়েছিলেন, শাস্ত্রীর প্রতি তাঁর প্রগাঢ় শ্রদ্ধার কথা। পাশাপাশি তিনি পরিষ্কার করে দেন, তিনি এই জন্য়ই ওই ইস্তফাপত্র গ্রহণ করতে চান যাতে কোনও মানুষ ভাবতে না পারেন, যাই হয়ে যাক, তাঁরা তাতে কোনওভাবেই প্রভাবিত হন না। তাঁর এই কথা থেকে পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে, এই ইস্তফা গ্রহণ করার পিছনে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে একটা সোনালি দৃষ্টান্ত স্থাপন করাই ছিল নেহরুর প্রধান উদ্দেশ্য।
[আরও পড়ুন: Train Accident: ‘রাখে হরি তো মারে কে?’, ট্রেনের জানলাই যেন ‘ত্রাতা’ হামসফর এক্সপ্রেসে থাকা ১২ বঙ্গবাসীর]
এদিকে তিরিশ জন সাংসদ সেদিন নেহরুর কাছে কাকুতি মিনতি করেন, কোনওভাবেই যেন শাস্ত্রীকে সরানো না হয়। তাঁদের সাফ কথা ছিল, দুর্ঘটনার পিছনে রয়েছে প্রযুক্তিগত ত্রুটি। শাস্ত্রী কোনওভাবেই দায়ী নন এই দুর্ঘটনার জন্য। বরং আঙুল তোলা উচিত রেলওয়ে বোর্ডের দিকে। শাস্ত্রী ইস্তফা দিচ্ছেন, এই বিষয়ে তাঁর প্রশংসা করা হোক। কিন্তু তা যেন গ্রহণ করা না হয়। যদিও নেহরু শেষ পর্যন্ত সেই আরজি শোনেননি। তিনি সেটিকে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। লোকসভায় বিষয়টি নিয়ে বলতে গিয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জানিয়ে দিয়েছিলেন, যেন কোনওভাবেই ভাবা না হয় তিনি নিজে শাস্ত্রীকে দুর্ঘটনার জন্য দায়ী মনে করছেন। সেই সঙ্গে পদত্যাগে ইচ্ছুক রেলমন্ত্রীকে ‘সর্বোচ্চ সততা, আনুগত্য, আদর্শের প্রতি নিবেদিত প্রাণ’ বলেও ব্যাখ্যা করেন।
সেদিন দেশের স্বাধীনতার বয়স ছিল মাত্র ৯ বছর। অর্থাৎ এক দশকও পেরোয়নি। এই পরিস্থিতিতে সাংবিধানিক গণতন্ত্রের অর্থ যে কেবল ক্ষমতা ধরে রাখা নয়, দেশ ও দশের জন্য আবেগকে স্পর্শ করে দেখাও, এই বিশ্বাসকে স্থাপন করাই লক্ষ্য ছিল তৎকালীন প্রশাসনের। পরবর্তী সময়ে আরেকজন রেলমন্ত্রীও ইস্তফা দিয়েছিলেন। তিনি নীতীশ কুমার। বর্তমানে বিহারের মসনদে থাকা বর্ষীয়ান এই রাজনীতিকই ১৯৯৯ গাইসাল ট্রেন দুর্ঘটনার পর সরে দাঁড়ান তাঁর পদ থেকে। কিন্তু সেটা ব্যতিক্রম। স্বাধীনতার পরের সাড়ে সাত দশকে অসংখ্য ছোট-বড় রেল দুর্ঘটনার সাক্ষী হয়েছে দেশ। কিন্তু লালবাহাদুর শাস্ত্রীর পরে নীতীশ ছাড়া আরও কোনও নিদর্শন আমাদের সামনে নেই।
এদেশে আজও কোটি কোটি মানুষের কাছে প্রধানতম পরিবহনের মাধ্যম রেল (Indian Railways)। বলা যেতেই পারে, ভারতের পরিবহণের মেরুদণ্ডই রেল। তাই রেল দুর্ঘটনার ভয়াবহতার মাত্রা যেন এক ভিন্ন আঘাতের ছবিই নির্মাণ করে। আর সেই কারণেই যে কোনও বড় দুর্ঘটনার পরেই প্রশ্ন উঠতে থাকে এই বিপর্যয়ের দায় কার? স্বাভাবিক ভাবেই রেলমন্ত্রীর কথা বহু সময়ই ওঠে। ঠিক যেমন এই মুহূর্তে উঠছে। গোটা দেশের বাতাস যেন বিষাদে ভরে উঠেছে বালেশ্বরের দুর্ঘটনায়। লাফিয়ে বাড়ছে মৃতের সংখ্যা। হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন কয়েকশো মানুষ। রেলমন্ত্রী কিন্তু ভোর থেকেই রয়েছেন ঘটনাস্থলে। জানিয়েছেন, তাঁর লক্ষ্য উদ্ধারকাজ দ্রুতগতিতে শেষ করা। তবু তাঁর ইস্তফা দেওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ বলেই মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল। শেষ পর্যন্ত কী হয় তা সময় বলবে। কিন্তু শাস্ত্রীর সেদিনের দৃষ্টান্ত স্থাপনের ইতিহাস কিন্তু এই সময়ে দাঁড়িয়ে নতুন করে ভেসে উঠছে।