সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: বিহারের নালন্দা জেলার কল্যাণ বিঘা গ্রামের দিনমজুর মেঘন মাঁঝি। তিনি যাবতীয় 'সরকারি কাগজ' বলতে বোঝেন আধার কার্ড, ভোটার কার্ড আর এমএনরেগার (একশো দিনের কাজ) জব কার্ড। কিন্তু এবার এই তিনটি কাগজ আর যথেষ্ট নয়। নির্বাচন কমিশনের নির্দেশে, যাঁদের নাম ২০০৩ সালের ভোটার তালিকায় ছিল না, তাঁদের জন্য নাগরিকত্ব প্রমাণে ১১টি নির্ধারিত নথির একটি দিতে হবে। মেঘনের কাছে এই নথিগুলোর কোনওটিই নেই। বস্তুত, নতুন ভোটার তালিকা সংশোধন প্রক্রিয়ার অংশ হিসাবে বিহারে চলছে এক বিশেষ অভিযানের কাজ। ৭৭ হাজারেরও বেশি বুথ স্তরের অফিসার (বিএলও) রাজ্যের ৭.৮ কোটি ভোটারের তথ্য যাচাই করছেন। শুধু নতুন ভোটার নয়, পুরনোদেরও দিতে হবে নাগরিকত্বের প্রমাণ।
তাৎপর্যপূর্ণভাবে, কল্যাণ বিঘা মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারের নিজের গ্রাম, এখানেই দাঁড়িয়ে বিএলও পিঙ্কি কুমারী ব্যস্ত গ্রামের মানুষের ভোটার ফর্ম পূরণ করতে, তাঁদের কাছ থেকে নথিপত্র সংগ্রহ করতে, কারও কারও আঙুলের ছাপ নিতে। তিনি বলছেন, "২০০৩ সালের তালিকায় বেশির ভাগের নাম আছে, কিন্তু ৫-৭ শতাংশ মানুষের নেই। তারা অধিকাংশই দরিদ্র শ্রেণির এবং উপযুক্ত কাগজপত্র কারও কাছেই নেই।" আসলে, নতুন ভোটার তালিকা সংশোধনের ফরমান বিড়ম্বনায় ফেলে দিয়েছে গ্রামগঞ্জের দরিদ্র মানুষগুলিকে। এই সমস্যার চিত্র কেবল কল্যাণ বিঘাতেই নয়, রাজ্য জুড়েই। আরজেডি নেতা তেজস্বী যাদবের নির্বাচনী এলাকা রাঘোপুর, বা রাজগির, বিহার শরিফ কিংবা ভৈরবপুর, সর্বত্রই চলছে কাগজ জোগাড়ের জন্য হাহাকার। ভৈরালির এক মহিলার প্রশ্ন, "আমরা যারা রেশন কার্ড আর আধার ছাড়া আর কিছু জানি না, তারা কীভাবে প্রমাণ করব নাগরিকত্ব?”
তথ্য জানাতে গিয়ে অনেকেই বিভ্রান্ত। অনেকেই ২০০৩ সালের পরে জন্ম নেওয়ায় বাবা-মায়ের পরিচয়পত্র দরকার পড়ছে। অথচ আশিসের বাবা মারা গিয়েছেন ২০০৯ সালে। এখন সে কোথা থেকে বাবার নাগরিকত্বের প্রমাণ জোগাড় করবে? রাজগিরের পূজা কুমারী জানালেন, তিনি হায়দরাবাদে থাকতেন, কোভিডকালে ফিরেছেন। হায়দরাবাদেই ভোটার কার্ড হয়েছিল আধার ব্যবহার করে। কিন্তু নতুন এই নাগরিকত্ব প্রমাণের প্রক্রিয়া সম্পর্কে তার কোনও ধারণাই নেই। মহিলাদের মধ্যে অনিশ্চয়তা আরও বেশি। অনেকে বলছেন, "কাস্ট সার্টিফিকেট তো শুধু সরকারি চাকরি বা কলেজে ভর্তির জন্য লাগে, আমরা এসব করিনি কখনও। এখন কোথা থেকে আনব?"
যদিও প্রশাসন বলছে, ১ আগস্ট প্রকাশিত হতে চলা খসড়া তালিকায় শুধু তাদের নামই থাকবে, যারা এইসব প্রমাণ জমা দিতে পেরেছেন। ফলে যারা এখনও তালিকায় নেই বা কাগজ নেই, তাদের নাম বাদ পড়ার সম্ভাবনা প্রবল। নির্বাচন কমিশনের ঘোষিত ১১টি নথির তালিকায় রয়েছে- সরকারি বা রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার পরিচয়পত্র, ১ জুলাই ১৯৮৭-র আগে জারি হওয়া কোনও সরকারি নথি, জন্ম সার্টিফিকেট, পাসপোর্ট, শিক্ষাগত যোগ্যতার সার্টিফিকেট, স্থায়ী বাসিন্দা সার্টিফিকেট, বনপালের সার্টিফিকেট, কাস্ট সার্টিফিকেট, এনআরসি অন্তর্ভুক্তি, পারিবারিক রেজিস্টার এবং জমির দলিল।
এই প্রক্রিয়া নিয়ে রাজনৈতিক মহলেও অস্বস্তি বাড়ছে। আরজেডি মুখপাত্র মৃত্যুঞ্জয় তিওয়ারি বলছেন, "এই উদ্যোগ মূলত যুবক, দরিদ্র, দলিত এবং তেজস্বীর (যাদব) ভোটারদের বাদ দিতে করা হচ্ছে। এত কম সময়, তাও বর্ষার সময়, মানুষ কীভাবে শহর ছেড়ে গ্রামে এসে ফর্ম জমা দেবে?” এমনকী জেডিইউ নেতা রাজকিশোর সিংও বলছেন, "ভোটার তালিকার সংশোধন প্রয়োজন, কিন্তু এত তাড়াহুড়ো করে নয়। অন্তত ছয় মাস সময় দেওয়া উচিত ছিল।"
