সুমিত বিশ্বাস, প্রয়াগরাজ: শাহী স্নানে দেড় কোটি। আর অমৃতস্নানে ৬ কোটি! মঙ্গলবার মকর সংক্রান্তিতে প্রয়াগরাজে মহাকুম্ভ মেলায় সেই ভোর ৪টে থেকে রাত পর্যন্ত ৬ কোটি মানুষ অমৃত স্নান করেছেন। একদিনে মহাকুম্ভ মেলায় ৬ কোটি মানুষের অমৃতস্নান রেকর্ড বলে দাবি করেছে উত্তরপ্রদেশ সরকার। হবেই বা না কেন? ১৪৪ বছর পর যে এমন যোগ। স্বাধীন ভারতে এই প্রথম! তাই আসমুদ্র হিমাচলের সব রাস্তা যেন প্রয়াগরাজে মিশে গিয়েছে। সেই সঙ্গে বিদেশ থেকেও বহু পুণ্যার্থী, পর্যটকরা এখানে পা রাখেন। জাপান, জার্মানি, রাশিয়া, ব্রাজিল, স্পেন, আমেরিকা থেকে পর্যটকরা আসেন। সবে মিলিয়ে মহাকুম্ভে মহামিলন ক্ষেত্র।
আর এই মিলনক্ষেত্র সামাল দিতে ৪৪ দিন ধরে সেই ২৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মহাকুম্ভনগরে প্রবেশের ৭ টি রাস্তায় ১০২টি চেক পয়েন্ট থাকবে। জমি এবং জল দুটি অংশেই নিরাপত্তা বলয়। মেলা প্রাঙ্গণে ১০০০ পুলিশ কর্মী। তার মধ্যে ৭১ জন ইনস্পেক্টর পদমর্যাদার আধিকারিক, ২৩৪ জন সাব ইন্সপেক্টর, ৬৪৫ জন কনস্টেবল ও ১১৩ জন হোমগার্ড। এছাড়া সাইবার ক্রাইম রুখতে ৪০ হাজার সাইবার অপরাধ বিশেষজ্ঞ। সেই সঙ্গে জঙ্গি দমন শাখা, এনএসজি, উত্তরপ্রদেশ পুলিশের সশস্ত্র বাহিনী, ২,৭৫০ সিসিটিভি ক্যামেরা। এছাড়া গঙ্গার সুরক্ষায় জল পুলিশ, এনডিআরএফ। রয়েছে বিপর্যয় মোকাবিলার বাহিনীও। এমনকি গঙ্গা- যমুনার তলাতেও রয়েছে ১১৩ টি ড্রোন। প্রয়াগরাজের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার অবনীশ কুমার জানান, "এই মহামিলনক্ষেত্রে আসা পুণ্যার্থীদের যাতে কোনও সমস্যা না হয় তার সবরকম ব্যবস্থা করা হয়েছে। জমি এবং জল দুটি অংশে আমরা নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছি।"
স্ত্রীকে নিয়ে অমৃতস্নানে এসেছিলেন বিহারের গোপালগঞ্জের রুদল বারি। তাঁর কথায়, "ভাবছিলাম কোটি কোটি মানুষজনের ভিড়ে স্নান করতে পারব কি না। গঙ্গা মাইয়া অবশ্য সেই সুযোগ করে দিয়েছেন। স্নানের পর যেভাবে হিমেল হাওয়ায় মনে হল যেন স্বর্গ! এবার যেন সব পাপ ধুয়ে যায়।" এদিন প্রয়াগরাজের সর্বনিম্ন ছিল ১২ ডিগ্রি।
এই মহাকুম্ভ মেলাকে নির্মল ও স্বচ্ছতার লক্ষ্যে ১ লাখ ৪৫ হাজার শৌচালয় তৈরি করা হয়েছে। এছাড়া বিলাসবহুল টেন্ট রয়েছে ১ লাখ ৬০ হাজার। প্রথম অমৃত স্নান পার হলেও আরও যে চারটি মহাস্নান রয়েছে। ২৯ জানুয়ারি মৌনি অমাবস্যা, ৩ ফেব্রুয়ারি বসন্ত পঞ্চমী, ১২ ফেব্রুয়ারি মাঘী পূর্ণিমা ও ২৬ ফেব্রুয়ারি মহা শিবরাত্রি। তাই বিলাসবহুল তাঁবুর বুকিং চলছেই।
মহাকুম্ভের জেরে গঙ্গা-যমুনা-সরস্বতী ত্রিবেণী সঙ্গমস্থলের কাছাকাছি ২ হাজার টাকার হোটেল ভাড়া ১০ হাজার ছাড়িয়েছে। এছাড়া সঙ্গমের আশেপাশে যে সকল অতিথি আবাস, হোটেল রয়েছে তার সাধারণ ভাড়া দেড় হাজার টাকা হলেও এখন তা ঠেকেছে ৫ থেকে ৬ হাজারে। প্রতিদিন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে এই হোটেল ভাড়া। প্রয়াগরাজ শহরে তিন কিমি দূরে সঙ্গমস্থলে যাওয়ার জন্য টোটোতে চাপলেই প্রতি জনকে দিতে হচ্ছে ২০০ টাকা। দেশজুড়ে বিভিন্ন মহারাজদের তাঁবুর কাছে চার চাকার গাড়ি পৌঁছে দেওয়ার জন্যও দিতে হচ্ছে এক থেকে দেড় হাজার টাকা।
আর তারই সঙ্গে চলছে হোটেল বুকিং-র প্রতারণা। বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরের বাসিন্দা তথা মানিকলাল সিং উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক দুর্বাদল মহাপাত্র বলেন, "প্রায় ২ মাস আগে ১৬ নভেম্বর প্রয়াগরাজ শহরের থেকে একটু বাইরে অ্যাপের মাধ্যমে হোটেল বুকিং করি। মকর সংক্রান্তির আগের দিন সোমবার বিকালে ওই হোটেলে গিয়ে জানতে পারি আমাদের কোনও বুকিং নেই। ওই অ্যাপের সঙ্গে হোটেল কর্তৃপক্ষের না কি কোনও যোগাযোগই নেই। আমরা বন্ধুবান্ধব মিলে অথৈ জলে পড়ি। তারপর কোনও ভাবে একটি বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা হয়।"
এই সবের মধ্যেও প্রয়াগরাজ শহর আলোকমালায় সাজা। কোটি কোটি মানুষের সমাগম। কিন্তু রাস্তাঘাটে কোনও যানজট নেই। শহরে ঢোকার প্রায় ১০ কিলোমিটার আগে থেকেই গাড়ি অন্য গলিপথে ঘুরিয়ে নিতে হচ্ছে। নতুবা রয়েছে অজস্র পার্কিং। এ যে একতার মহাকুম্ভ।