রূপায়ন গঙ্গোপাধ্যায়: কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর তিনদিনের বঙ্গ সফরেও রাজ্য বিজেপিতে আদি-নব্য দ্বন্দ্ব জিইয়ে রইল। কলকাতা বিমানবন্দরে নেমে সোমবার রাত আটটা নাগাদ সল্টলেক বিজেপি পার্টি অফিসে দলের সাংগঠনিক বৈঠকে যোগ দেন শাহ। আর কোর কমিটির সদস্য হওয়া সত্ত্বেও সেখানে শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে বৈঠকে ডাকা হল না প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষকে। আজ কোর কমিটি ও রাজ্য পদাধিকারীদের বৈঠকেও আমন্ত্রণ করা হয়নি দিলীপকে।
শুধু তাই নয়, শাহর রাজ্য সফরে একাধিক দলীয় বৈঠকে বহু পুরনো নেতাদের ডাকা হয়নি বলেও অভিযোগ। পাশাপাশি নতুন রাজ্য কমিটি ঘোষণাও হয়নি। ফলে দলের ক্ষমতাসীন শিবিরের সেই নেতারাই এই সফরে কার্যত ঘিরে রাখবেন শাহকে। দলের আদি নেতা, বিক্ষুব্ধ ও ব্রাত্যদের সিংহভাগদেরই কোনও বৈঠকেই ডাকা হচ্ছে না। শাহর সামনে যাতে আদিরা দল পরিচালনা নিয়ে কোনও ক্ষোভ তুলে ধরতে না পারে তাই সায়েন্সসিটি থেকে হোটেলের বৈঠকে বাছাই করাদেরই রাখা হচ্ছে। একদিকে গোষ্ঠীকোন্দল, অন্যদিকে সাংগঠনিক দুর্বলতা নিয়ে অমিত শাহ কি বার্তা দেন রাজ্য নেতাদের সেটাই দেখার। কারণ, বাংলায় দলের আদি-নব্য কোন্দল নিয়ে ওয়াকিবহাল শাহ নিজেও।
এদিন রাজ্যে আসার পর রাতে তাঁর সঙ্গে শুভেন্দু অধিকারীর ছবি দিয়ে এক্স হ্যান্ডেলে পোস্ট করেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। সেখানে তিনি লেখেন, 'পশ্চিমবঙ্গ পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুত। তিনদিনের সফরে কলকাতায় পৌঁছেছি। বিমানবন্দরে কর্মী সমর্থকদের ভালবাসায় অভিভূত।'
আজ, মঙ্গলবার দলের কোর গ্রুপের বৈঠকে বিধানসভা নির্বাচন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে এবং সাংসদ ও বিধায়কদের সঙ্গে বৈঠক ও কলকাতার দলের কর্মীদের সঙ্গে তাঁর মত বিনিময় হবে বলেও এক্স হ্যান্ডলে তিনি লেখেন। সোমবার রাতে কলকাতায় পা রেখেই বঙ্গ বিজেপির সংগঠনের হাল নিয়ে কাটাছেঁড়া করতে বসেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। সল্টলেক পার্টি অফিসে দলের রাজ্য পদাধিকারী, কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক ও সোশ্যাল মিডিয়া টিমের সঙ্গে দু 'দফায় বৈঠক করেন। ৪০ শতাংশ বুথে এখনও কমিটি হয়নি। জেলায় জেলায় আদি-নব্য দ্বন্দ্বও গোষ্ঠীকোন্দল অব্যাহত। তার মধ্যেই এদিন রাতের বৈঠক থেকে বুথস্তরে জনসংযোগ ও সঙ্ঘবদ্ধভাবে সকলকে নিয়ে মাঠে নামার বার্তাও দিয়েছেন শাহ।
মতুয়া ভোট ও এসআইআর নিয়েও আলোচনা হয়েছে। আজ সাংবাদিক বৈঠকে শান্তনু ঠাকুরকে থাকতে বলেছেন। পথসভা, জনসভা ও রথযাত্রার প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। শাহর নেতৃত্বে রাতের বৈঠকে শমীক ভট্টাচার্য, শুভেন্দু অধিকারী ও সুকান্ত মজুমদাররা উপস্থিত ছিলেন। ছিলেন কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষকরাও। রাজ্য নেতারা দলের সংগঠনিক প্রস্তুতি, প্রচার ও পরিকল্পনা তুলে ধরেন শাহকে। সরকার গঠন হচ্ছেই, বৈঠকে জানান প্রত্যয়ী শাহ। প্রচারে কোন বিষয় জোর দিতে হবে সেটা ঠিক করে দিয়েছেন। অনুপ্রবেশ, ধর্মীয় বিভাজনের রাজনীতি যেমন রয়েছে তেমনই শিল্প কৃষি, সড়ক পরিবহন, মহিলাদের ক্ষমতায়নের মতো বিকল্প উন্নয়নের মডেল প্রচারে আনার কথা বলেছেন বলে খবর।
এদিকে, ভোটের আগে বাংলায় শাহর সফর নিয়ে কটাক্ষ করেছে তৃণমূল কংগ্রেস। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তৃণমূলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষের বক্তব্য, "নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহদের যাতায়াত নতুন নয়। ভোট এলেই ডেলিপ্যাসেঞ্জারি করেন। কিন্তু নিট রেজাল্ট বাংলার মানুষের দ্বারা বিজেপিকে প্রত্যাখ্যান।" বিজেপিকে কেন বাংলার মানুষ প্রত্যাখান করবে তার ব্যাখ্যাও দিয়েছেন তৃণমূলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক। কুণালের ব্যাখ্যা, "১) বাংলার প্রতি আর্থিক বৈষম্য। ২) বাংলাকে অধিকার থেকে বঞ্চিত করা। ৩) বাংলা ভাষাকে অপমান। ৪) বাংলার সংস্কৃতিকে অপমান। ৫) বাংলাভাষীদের বাংলাদেশী বলে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া। সামগ্রিকতার উপর দাঁড়িয়ে বঙ্গ বিরোধী বিজেপি প্রত্যাখ্যাত হয়।"
কুণাল ঘোষের কথায়, "ওঁর (অমিত শাহ) দলের অর্ধেক সংগঠন নেই। ৩-৪টি গ্রুপ। মানুষ তাদের উপর আস্থা রাখবে কেন।" তৃণমূল মুখপাত্রের কটাক্ষ, "আর বাংলায় বিজেপির আবার রাকৌশল আবার কী? কুঁজোরও সাধ হয় চিৎ হয়ে শোওয়ার, আর গামছারও শখ হয় ধোপার বাড়ি যাওয়ার। বিজেপি নেতারা আসবে-ঘুরবে-হোটেলে খরচা করবে-বিল পেমেন্ট করবে, আর ভোটে হারবে।"
সূত্রের খবর, নির্বাচনী কৌশল সংক্রান্ত পরামর্শ ছাড়াও প্রচারের অভিমুখ কী হবে, তার প্রাথমিক দিকনির্দেশ দিয়ে যাবেন শাহ। আজ, মঙ্গলবার দুপুরে সাংবাদিক সম্মেলনে এসআইআর ও সিএএ নিয়ে শাহ কি বলেন সেদিকে নজর রয়েছে রাজনৈতিক মহলের।
ভোটার তালিকা থেকে বাদ যেতে বসেছে মতুয়াদের বড় অংশের নাম। মতুয়া ঠাকুরবাড়ির দুই ভাই বিজেপি সাংসদ শান্তনু ঠাকুর ও বিধায়ক সুব্রত ঠাকুরের নানা কার্যকলাপ ও বক্তব্যে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে। মতুয়া ভোট ধরে রাখা নিয়ে শঙ্কায় পদ্মশিবির। সেই পরিস্থিতিতে মতুয়াদের নাগরিকত্বের বিষয়টি নিয়েও বার্তা দিতে পারেন শাহ।
আজ মধ্যাহ্নভোজনের পর হোটেলে নির্দিষ্ট কয়েকজন শীর্ষনেতার সঙ্গেও বৈঠক করার কথা। বিকেলে সংঘের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে বৈঠক করবেন। আর কাল বুধবার সায়েন্স সিটিতে কলকাতা মহানগরীর মণ্ডল, জোন, জেলা এবং রাজ্যস্তরের নেতৃত্বদের নিয়ে সভা করবেন শাহ। তার আগে যাবেন ঠনঠনিয়া কালীবাড়িতে। এদিন রাতে বিমানবন্দরে শাহকে স্বাগত জানান শুভেন্দু ও শমীক। ভিড় করে থাকা কর্মী-সমর্থকদের দিকে হাত নেড়ে এগিয়ে যান শাহ। তারপর শমীক ও শুভেন্দুকে নিজের গাড়িতে নিয়ে বিজেপি পার্টি অফিসে যান।
