আজও তাঁর বাড়িতে ঢুকলে যেন ভেসে আসে সেই বিখ্যাত চণ্ডীপাঠ। তিনি ভারতীয় বেতারের প্রাণপুরুষ বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। ‘মহালয়া’ মুক্তির আগে উত্তর কলকাতার সেই বাড়িতে অতিথি প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। সঙ্গে উত্তমকুমারের নাতি গৌরব চট্টোপাধ্যায়। ছিলেন ইন্দ্রনীল রায়ও।
মঙ্গলবার সকাল দশটা কুড়ি। উত্তর কলকাতার গলিও বালাকোট সার্জিক্যাল স্ট্রাইক নিয়ে উত্তেজিত। এমন সময় তাঁর বড় এসইউভি নিয়ে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রর বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালেন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। বাড়িতে তখন অপেক্ষা করছেন উত্তম কুমারের নাতি গৌরব চট্টোপাধ্যায়। দোতলা বাড়ির সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলেন দু’জনে। ভারতীয় বেতারের প্রাণপুরুষের ঘরে ঢোকা হল। খাটের উপর তখন বসে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রর কন্যা। বাড়ির লোকেরা বললেন, “এটি বীরেন্দ্রবাবুর বিয়ের খাট।” খাটের পাশেই রাখা তাঁর সেই চেনা ছবি। প্রসেনজিৎ ও গৌরব অনেকক্ষণ চেয়ে থাকলেন ছবিটির দিকে। সারা জীবন এই বাড়িতে, এই ঘরেই থাকতেন সেই বিখ্যাত মানুষটি। ঘরে এসে হাজির হলেন বীরেন্দ্র ভদ্রর পুত্রবধূ। চারজনে বসলেন পাশাপাশি। অদ্ভুত এক নীরবতা তখন সেই ঘরে। কিছুক্ষণ থেকে বড়দের প্রণাম করে বেরিয়ে এলেন প্রসেনজিৎ-গৌরব। এক ঐতিহাসিক মূহূর্তের সাক্ষী থাকল ‘কফিহাউস’। রেডিওতে না বাজলেও কোথাও যেন ওই বিখ্যাত মানুষটির গলায়, ‘নমস্তস্যৈ, নমস্তস্যৈ, নমস্তস্যৈ নমো নমঃ’ শুনতে পেলাম।
বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রর বাড়িতে আসার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
প্রসেনজিৎ: এটা আমার কাছে তীর্থে যাওয়ার মতো। কেন? কারণ উত্তর কলকাতার ওই বাড়িটা বাঙালির অসম্ভব প্রিয় এক সকালের সঙ্গে ওতঃপ্রোতভাবে জড়িত। আজও মহালয়ার দিন সকালে ওঁর গলাটা শুনলে মনে হয় বেঁচে থাকাটা সার্থক। সেখানে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রর বাড়িতে গিয়ে ওঁর ঘরে বসে থাকার মূহূর্তগুলো আমি সারা জীবন মনে রাখব। আরও একটা কথা আপনাদের বলি। আমার বাবা বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায় কিন্তু বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রকে তাঁর গুরু মানেন। বীরেন্দ্রবাবু ও সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়ই শ্রুতিনাটকে বাবাকে প্রথম সুযোগ দিয়েছিলেন। আর আমার সঙ্গে আরও একজন ওই বাড়িতে গেছিল, গৌরব। ওর দাদু, উত্তমজেঠুও খুব অদ্ভুতভাবে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছেন। যেটা নিয়েই ‘মহালয়া’ ছবিটা। সব মিলিয়ে এত নস্ট্যালজিক সকাল খুব কম এসেছে আমার জীবনে।
[ ইন্দো-পাক সংঘাত একাধিকবার উঠে এসেছে পর্দায়, রইল সেরা পাঁচের হদিশ ]
আপনি তো ‘মহালয়া’ ছবির প্রযোজক। পুজোর সময় ছবি রিলিজ করলেন না কেন?
প্রসেনজিৎ: আমার ছবি তৈরি হয়েছে গত বছর পুজোর সময়। কিন্তু তখন এতগুলো ফিল্ম রিলিজ হচ্ছিল যে জায়গা পাইনি। যদিও ছবির নাম ‘মহালয়া’, তবু এটা কিন্তু দুর্গাপুজোর ছবি নয়। ছবিতে দুর্গা ঠাকুরের একটা শটও নেই। এটা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার ডকু-ফিচার বলতে পারেন। ১৯৭৬ সালে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র আর পঙ্কজ মল্লিককে সরিয়ে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও উত্তমকুমার রেডিওতে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ করেছিলেন। কিশোর কুমার ছাড়া বাকি সব বড় নাম সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু বাঙালি সেটা মেনে নেয়নি। সেই ঘটনা অবলম্বনে এই ‘মহালয়া’ ছবিটি।
‘মহালয়া’ ছবিতে উত্তম কুমার, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রর মতো মহারথীদের উপস্থিতি রয়েছে। ছবিটা মুক্তি পেলে কি নতুন করে বিতর্ক শুরু হতে পারে?
প্রসেনজিৎ: আমার মনে হয় না বিতর্কের কোনও জায়গা আছে। তার কারণ আমরা এমন কিছু দেখাচ্ছি না যা হয়নি। পুরো স্ক্রিপ্টটা পরিচালক সৌমিক সেন লিখেছে বহু দিনের রিসার্চের পরে। সত্যি তো পঙ্কজ মল্লিক বা বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রকে সরিয়ে উত্তমকুমার আর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে আনা হয়েছিল। এখানে সেই সময়ের একটা পাওয়ার স্ট্রাকচারকেও দেখানো হয়েছে যেটা সত্যি। আমার একটাই কথা বারবার মনে হয়েছে, এত বড় বড় চরিত্র যেখানে উপস্থিত, এত মোচড় গল্পে– এই বিষয় নিয়ে কেন আগে কেউ ছবি করল না? এটা আমার বারবার মনে হয়েছে। আর আজ থেকে তিরিশ বা চল্লিশ বছর পর যখন কেউ এই বিষয় নিয়ে রিসার্চ করবে, এই ছবিটা রেফারেন্স পয়েন্ট হিসেবে থেকে যাবে। আমার কাছে প্রযোজক হিসেবে সেটা বড় প্রাপ্তি।
[ ‘চোখের সামনে নিজের মৃত্যু দেখেছি’, কেন এমন বললেন অনিন্দ্য? ]
লাস্ট দু’তিন মাসে এত চুপচাপ হয়ে গেছেন কেন? এটা কি ‘কিশোর কুমার জুনিয়র’ না চলার জন্য?
প্রসেনজিৎ: ‘কিশোর কুমার জুনিয়র’ আমরা সবাই যে জায়গায় পৌঁছবে ভেবেছিলাম সত্যি সেই জায়গায় পৌঁছয়নি। সেটার একটা কারণ হতে পারে দর্শক কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছ থেকে হয়তো ‘নগরকীর্তন’-এর মতো ছবি এক্সপেক্ট করে। সেটা ভুলও নয়, কারণ কৌশিক নিজেই ভাল কাজের মাধ্যমে সেই এক্সপেক্টেশনটা তৈরি করেছে গত দশ বছর ধরে। তাই দর্শক হয়তো ভাবছে, কৌশিক কেন এ রকম একটা ছবি করল? আমার ধারণা ঋতুপর্ণ ঘোষও এটা করলে মানুষ নিত না। ঠিক যেমন ঋতুর ‘ব্যোমকেশ বক্সী’-তে হলে লোক ঢোকেনি। এটাও সে রকম। তবে একটা ভুল তো আমরা সবাই করেছিলাম। আর আমরাই সবার আগে সেটা অ্যাক্সেপ্ট করেছি। তবে তার জন্য আমি চুপচাপ হয়ে যাইনি। (হাসি) চুপচাপ বসে চারিদিকটা দেখছি।
বাংলা ইন্ডাস্ট্রির নামকরা প্রযোজক, এসভিএফের শ্রীকান্ত মোহতা ভুবনেশ্বরের জেলে রয়েছেন। ইন্ডাস্ট্রিতে টালমাটাল অবস্থা। কাজের ব্যাপারে অনিশ্চয়তা চারিদিকে। বড় স্টারদের ডেট খালি পড়ে রয়েছে। এই অবস্থা সম্বন্ধে প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের রিঅ্যাকশন কী?
প্রসেনজিৎ: কেটে যাবে। আমি বিশ্বাস করি খুব শিগগিরই এই টালমাটাল অবস্থা কেটে যাবে। এমনিতেই জীবনে, সিনেমায় এ রকম একটা অস্থিরতার সময় আসে। মাথা ঠান্ডা রেখে সেই সময়টা কাটানো খুব দরকার। সবাই মিলে আমরা সেটাই করছি। আমি ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে সবচেয়ে আশাবাদী। আগেও ছিলাম, আজও আছি, ভবিষ্যতেও থাকব।
The post ‘মহালয়া’ মুক্তির আগে আশীর্বাদ নিতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের বাড়ি গেলেন প্রসেনজিৎ appeared first on Sangbad Pratidin.