বিশ্বদীপ দে: সে এক অন্য কলকাতা। সময়ের হিসেবে শ দুয়েক বছরের বেশি হবে না। কিন্তু মনে হয় যেন কত দূরে আমরা ফেলে এসেছি সেই সময়। উনবিংশ শতাব্দীর কলকাতার (Kolkata) কথা বলতে বসলে অবধারিত ভাবে রেনেসাঁর কথা ওঠে। আরও কত কী! রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, মাইকেল, রামকৃষ্ণ, সতীদাহ, বিধবা বিবাহ… প্রসঙ্গের তো শেষ নেই। কিন্তু এসবের সঙ্গেই আলোচনায় উঠে আসে বাবুবিলাস ও হুতোমের লেখায় ফুটে থাকা আজব শহরের আশ্চর্য সব চালচিত্র। যার মধ্যে রয়েছে এমন মানুষরাও, যারা পাখি হতে চাইত। হ্যাঁ, অমলকান্তি যেমন রোদ্দুর হতে চাইত, তেমনই ‘মানুষ পাখি’রা দখল করে রেখেছিল বাগবাজার, বটতলা ও বউবাজার। আর এই পাখিদের রাজা ছিলেন রূপচাঁদ পক্ষী। বদলে যাওয়া শহর কি মনে রেখেছে সেদিনের পক্ষীরাজকে?
কেউ হয়তো বলবেন তিনি কবি, গায়ক। আবার কারও মতে গঞ্জিকা সেবনকারীদের পান্ডা। আসলে এই সবই তাঁর পরিচয়। আদপে বাঙালি নন। তবু তিনি সেযুগের বাঙালিদের আশ্চর্য জীবনযাপনের এক প্রতীক হয়ে থেকে গিয়েছেন। ইতিহাসপ্রেমী মানুষদের কাছে রূপচাঁদের মতো ইন্টারেস্টিং মানুষরা বরাবরই কাল্টিভেট করতে চাওয়ার মতো। প্রমথনাথ বিশীর বিখ্যাত উপন্যাস ‘কেরী সাহেবের মুন্সী’ কে না পড়েছে? সেখানে রয়েছে ‘রূপচাঁদ পক্ষীর পিতৃদত্ত নাম সনাতন চক্রবর্তী বা ওই রকম কিছু।… স্বোপার্জিত রূপচাঁদ পক্ষী পৈতৃক সনাতন চক্রবর্তীকে চাপা দিয়ে লুপ্ত করে দিয়েছে।’ সেই উপন্যাস থেকেই জানা যায় ‘তখনকার কলকাতায় দেড়জন পক্ষী ছিল। পটলডাঙার রূপচাঁদ পক্ষী, আর বাগবাজারের নিতাই হাফ পক্ষী।’
[আরও পড়ুন: মুখে আনা যায় না গ্রামের নাম! পালটে ফেলে হাঁফ ছাড়ল গ্রামবাসীরা]
জন্মসূত্রে রূপচাঁদ ওড়িয়া। কিন্তু গাঁজাবিলাসের পাশাপাশি তিনি যে গান লিখেছেন তা বাংলা ভাষাতেই। বীরেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের বহুদিন আগে লেখা এক প্রবন্ধ ‘রূপচাঁদ পক্ষী’তে পাচ্ছি, ‘কোনও হুজুগ উঠলেই তিনি তা নিয়ে গান রচনা করতেন। রেল, গঙ্গারপোল, বিধবা বিবাহ, কন্যাদায় প্রভৃতি বিষয়ে তিনি গান রচনা করেছেন। বিশেষত বিদ্রুপাত্মক গান রচনায় তাঁহার খ্যাতি ছিল। তাঁহার রচিত প্রায় সব গানে পক্ষী বা খগরাজ ভনিতা দেখা যায়।’ তাঁর গানে ইংরেজি শব্দও মিশিয়ে দিতেন রূপচাঁদ। কেমন সে গান? একটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। ‘লেট মি গো ও দ্বারি/ আই ভিজিট টু বংশীধারী।/ এসেছি ব্রজ হতে, আমি ব্রজের ব্রজ নারী।।/ বেগ ইউ ডোরকিপার লেট মি গেট/ আই ওয়ান্ট সি ক্লক হেড,/ কার হুম আউয়ার রাধে ডেড,/ আমি তারে সার্চ করি।/ শ্রীমতী রাধার কেনা সারভেন্ট/ এই দেখ আচে দাসখত এগ্রিমেন্ট,/ এখনই করব প্রেজেন্ট, ব্রজপুরে লব ধরি।’ এটি একটি দীর্ঘ গানের খণ্ডাংশ। প্রচ্ছন্ন দুরন্ত রসবোধ ও স্মার্ট শব্দচয়নে তিনি কতটা সিদ্ধহস্ত ছিলেন বুঝে নিতে এটুকুই বোধহয় যথেষ্ট। পাঁচালি, আখড়াই, ঢপ, যাত্রা, কবিগান, গাজনের সঙ- সবেতেই তিনি দক্ষ। কিন্তু রূপচাঁদ পক্ষীকে নিয়ে কথা বলতে বসলে তাঁর সঙ্গীত প্রীতির কথাটুকু বললেই তো হল না। আমোদপ্রিয় ও রসিক পুরুষটির প্রেক্ষাপট আরও বড়।
কেমন দেখতে ছিলেন রূপচাঁদ? ফেরা যাক ‘কেরী সাহেবের মুন্সী’ উপন্যাসে? ‘দীর্ঘ কঙ্কাল, হাঁটু পর্যন্ত মলিন ধুতি, পায়ে খড়ম, খালি গা, জীর্ণ উপবীত, অত্যুজ্জ্বল কোটরগত চক্ষু, মুখমণ্ডলের বাকি অংশ গাল, কপাল, চিবুক প্রভৃতি— অজস্র বলিচিহ্নিত, চুল সাদা, খোঁচা খোঁচা দাড়িগোঁফও সাদা; বয়স পঁয়ত্রিশও হতে পারে আবার পঁচাত্তর হতেও বাধা নেই।’
[আরও পড়ুন: বাড়ছে হিন্দুবিদ্বেষ? এবার রামচরিতমানসকে সায়ানাইডের সঙ্গে তুলনা বিহারের মন্ত্রীর]
কিন্তু তিনি পক্ষী হলেন কী করে? সেকথা বলতে বসলে পক্ষীর দলের ইতিবৃত্তটা একবার ছুঁয়ে আসা দরকার। ‘সংবাদ প্রভাকরে’ ঈশ্বর গুপ্তর একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, পক্ষীর দলের শুরুয়াৎ কিন্তু উনবিংশ শতাব্দীর গোড়াতেই। আবার এমনও মনে করা হয়, তারও আগে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকেই এই পাখিরা কলকাতায় রাজত্ব শুরু করেছিল। তখন এই দলের নেতৃত্বে ছিলেন রামনারায়ণ মিশ্র। যদিও এই দলের প্রতিষ্ঠাতা কে তা নিয়ে নানা মত রয়েছে। তবে প্রতিষ্ঠাতা যিনিই হোন, মূলত বাগবাজার, পাশাপাশি বটতলা ও বউবাজারে আটচালায় দেখা মিলত এই গাঁজাখোর নেশাড়ুদের। তাঁরা নিজেদের বলতেন পক্ষী। ওই আটচালায় বসেই বুলি ঝাড়তেন। উড়তেন! সেসময় রূপচাঁদ জন্মানইনি। বা জন্মালেও একেবারেই কোলের শিশু।
পরবর্তী সময়ে তিনিই হয়ে ওঠেন পক্ষী দলের অন্যতম মুখ। শিবনাথ শাস্ত্রীর ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্-সমাজ’ গ্রন্থে রয়েছে, সেই সময় কলকাতা শহরে গাঁজা খাওয়া দারুণ ভাবেই বেড়ে গিয়েছিল। তিনি লিখছেন, ‘শহরের ভদ্র গৃহের নিষ্কর্মা সন্তানগণের অনেকে পক্ষীর দলের সভ্য হইয়াছিল। দলে ভর্তি হইবার সময়ে এক একজন এক একটি পক্ষীর নাম পাইচ এবং গাঁজাতে উন্নতিলাভ সহকারে উচ্চতর পক্ষীর শ্রেণিতে উন্নীত হইত।’ ওই বইয়েই দাবি করা হয়েছে, বউবাজারের দলকেই মূলত পক্ষীর দল বলা হত। আর সেই দলেরই সেরা পাখি পটলডাঙার রূপচাঁদ।
তবে পাখি হওয়া কি মুখের কথা? কেউ পাখি হতে এলে পক্ষীরাজের কাছে পরীক্ষা দিতে হত। কিন্তু পক্ষীরাজ উপাধি মিলত কেমন করে? একাসনে বসে আট ছিলিম গাঁজা খেতে পেলে মিলত একটি করে ইঁট। সেই ইঁট জুড়ে জুড়ে গোটা বাড়ি বানাতে পারলে তবেই হওয়া যেত পক্ষীরাজ। যা একমাত্র রূপচাঁদই হতে পেরেছিলেন। অন্যজনের নাম তো আগেই বলা হয়েছে। বাগবাজারের নিতাই। তিনি হাফ পক্ষী। কেননা চারটি দেওয়াল বানিয়েই তিনি গত হন। রূপচাঁদ অবশ্য এমন নেশাড়ু হয়েও দীর্ঘ জীবনই পেয়েছিলেন। ১৮১৫ সালে তাঁর জন্ম। মৃত্যু ১৮৯০ সালে। তবে পাখিদের রমরমা কিন্তু কমে গিয়েছিল উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধেই। ‘কেরী সাহেবের মুন্সী’ উপন্যাসে রূপচাঁদের মুখের সংলাপ রয়েছে, ‘এখনকার বড়লোকের ছেলেরা আর এদিকে ঘেঁষতে চায় না, ফিরিঙ্গি বেটাদের দেখাদেখি সব মদ ধরছে। মদে কি আছে হ্যাঁ?’
হুতোমের নকশায় রয়েছে-‘এখন আর পক্ষীর দল নাই… পাখিরা বুড়ো হয়ে মরে গেছেন, দু একটা আদমরা বুড়ো গোছের পক্ষী এখনও দেখা যায়, দল ভাঙা, টাকার খাঁকতিতে মন মরা হয়ে পরেচে। আড্ডাটি মিউনিসিপাল কমিসনরেরা উঠিয়ে দেছেন অ্যাখন কেবল তার রুইনমাত্র পড়ে আছে।’ কত কিছুই এভাবে হারিয়ে গিয়েছে শহরের বুক থেকে। কিন্তু একবার কান পাততে পারলে আজও সেকেলে কলকাতার বুকে হইহই করে ওঠা পাখির দলের সন্ধান মিলবে। কেবল শোনার মতো মনটা চাই। কিছুই তো হারায় না আসলে। থেকে যায়। কেবল খুঁজে পেতে জানতে হয়।