বাতাসে বছরশেষের বিদায়ঘণ্টা। নতুন বছরে কোন কোন মার্গ ভারতকে করে তুলতে পারে স্বর্গাদপি গরীয়সী, চলল সুলুকসন্ধান। কলমে রাজদীপ সরদেশাই
২০২২ অস্তাচলে। বর্ষশুরুর আগে আবারও একটি সময় উপস্থিত ভারতের প্রার্থনা করার। প্রার্থনা, এমন একটি দেশ হিসাবে নিজেকে পেশ করার, চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির…।
যেখানে ভারত চিনপ্রদত্ত হুমকিকে ‘সংঘবদ্ধ’ রাষ্ট্র হিসাবে গ্রহণের চেষ্টা করবে। চিনের সঙ্গে গোপন সন্ধিতে আবদ্ধ হওয়ার দরুন কেন্দ্রীয় সরকার ও বিরোধীদের পারস্পরিক বালখিল্য খেয়োখেয়িতে নামতে হবে না। যেখানে নোংরা রাজনৈতিক বিবাদ থেকে দূরে রাখা হবে সেনাকে। তুষারাছন্ন প্রতিকূল পরিবেশে সীমান্ত প্রহরার কারণে তাঁদের জন্য বরাদ্দ থাকবে ন্যায্য সম্মাননা ও সমর্থন। যেখানে ২০২২-এ কিছু ভুল হলে বিষোদ্গার করা হবে না ‘কেষ্টাবেটা’ নেহরু ও তাঁর ’৬২-র ব্যর্থতার উপর।
[আরও পড়ুন: অরুণাচলে গালওয়ান মডেলের পুনরাবৃত্তি, নতুন নাট্যমঞ্চ তৈরি করে কী বার্তা চিনের?]
সেই দেশ, যেখানে সংসদ হয়ে উঠবে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি নিয়ে তথ্যাভিজ্ঞ সুস্থ প্রতর্কের মঞ্চ। বিরোধী সাংসদদের মুখ বন্ধ করতে মাইক সুইচ অফ করে দেওয়া হবে না, এবং এমন অনভিপ্রেত মুহূর্তে ক্যামেরা নির্লজ্জের মতো ফোকাস করা থাকবে না ট্রেজারি বেঞ্চের দিকে। সংসদের অধিবেশন শুধুমাত্র ‘নাম-কে-ওয়াস্তে’ প্রথা হয়ে পড়ে থাকবে না। বিরোধীরা অধিবেশন বয়কট বা ভঙ্গ করবে না। শাসক দলও একছত্র বিধান দেবে না। বরং দু’পক্ষ সহিষ্ণু হয়ে পারস্পারিক বাক্য ও মত বিনিময়ে ব্যাপৃত হবে, কাদা ছোড়াছুড়িতে শশব্যস্ত নয়। যেখানে মন্ত্রিসভার কোনও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়টি শাসক দলের বাঁ হাতের খেলার মতো লঘুতায় পর্যবসিত হবে না। যেখানে ‘জি ২০’-তে ভারতের নেতৃত্ব প্রদান সমষ্টিগত গর্বের বিষয় হয়ে উঠবে, তাকে একক ‘পদোন্নতি’ হিসাবে বিচার করে আত্মম্ভরি হয়ে উঠবে না কেন্দ্র।
সেই দেশ, যেখানে কার্যনির্বাহক এবং বিচারপতিরা পরস্পরের সঙ্গে বিবাদে যাবেন না, বরং দু’পক্ষই নিজের সাংবিধানিক এক্তিয়ার বিষয়ে সচেতন হবেন, এবং সেই মতো আচরণ করবেন। বিচারক নিয়োজিত হবেন না কেন্দ্রের মন বা সুবিধামতো। যেখানে মন্ত্রীরা জনসমক্ষে বিচারকদের উপর চড়াও হয়ে সাংবিধানিক ও আইনি স্বাধীনতা লঙ্ঘন করবেন না। যেখানে বিচারবিভাগ সাধারণ নাগরিকের মৌলিক অধিকার সুনিশ্চিতকরণে সচেষ্ট হবে- মুষ্টিবদ্ধের ক্ষেত্রে নয়; সবার ক্ষেত্রেই। যেখানে মানবাধিকার কর্মীদের দীর্ঘদিন জেল পচতে হবে না বা তাঁদের জামিনের পথ অবরুদ্ধ করা হবে না রাজনৈতিক মতাদর্শের বৈপরীত্য হেতু ‘দেশদ্রোহী’-র তকমা এঁটে।
সেই দেশ, যেখানে নির্বাচন কমিশন এক নিরপক্ষ আম্পায়ারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে, ক্ষমতাসীন দলের হয়ে পুতুল হিসাবে চালিত না হয়ে। নির্বাচিত প্রতিনিধিরা নিজেদের সুবিধা-স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য ঘনঘন দলবদল করবেন না। যেখানে বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলিতে শান্তশিষ্ট ‘পুডল্’-এর মতো আচরণ করে বিরোধীশাসিত রাজ্যগুলিতে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টোরেট খাঁচাছাড়া ‘রটউইলার’ সুলভ শ্বদন্ত বের করবে না। কিংবা, অন্যান্য এনফোর্সমেন্ট এজেন্সিকে বিরোধীদের সবক শিখিয়ে লাইনে আনার কাজে ব্যবহার করা হবে না। যেখানে ‘দোষী সাব্যস্ত না-হওয়া পর্যন্ত নির্দোষ’- আইনশাস্ত্রের এই সাধারণ নীতি বদলে ফেলতে পারবে না আর্থিক তছরুপ প্রতিরোধকারী আইন।
সেই দেশ, যেখানে অর্থনীতি সংক্রান্ত কার্যকর আলোচনায় তাৎক্ষণিক মতামতের চেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য হবে যুক্তিনিষ্ঠ তথ্য। যেখানে সবাই ধ্বস্ত এবং নৈরাশ্যবাদী নয়; আবার ‘চুলোয় যাক দুনিয়া’ বলে নিশ্চিন্তে গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেওয়াতেও নয় বিশ্বাসী। চাকরির বাজার খারাপ এবং সার্বিক উন্নতিও শম্বুক গতিতে এগচ্ছে- এই সহজ সত্য অস্বীকার না-করে মেনে নেওয়া হবে যেখানে। যেখানে ‘গ্লোবাল হাংগার ইনডেক্স’-এ ভারতের অধগমন আমাদের ততটাই দুশ্চিন্তায় ফেলবে, যতটা আনন্দ ও তৃপ্তি দেবে লক্ষাধিক ভারতবাসীর দারিদ্রসীমার নিচের অভিশপ্ত গন্ডি কাটিয়ে বেরিয়ে আসার খবর।
সেই দেশ, যেখানে একটি রাজনৈতিক দলের জনকল্যাণমূলক প্রকল্প অন্য দলের ‘রেউড়ি’তে পরিণত হবে না। যেখানে রাজনৈতিক দলগুলি নির্বাচনে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রাখার চেষ্টা করবে এমন কিছু করার বদলে যা আদতে রাজকোষকেই দেউলিয়া বানিয়ে ছাড়ে। যেখানে সাধারণ মানুষের কাছে রাজনৈতিক দলগুলির ভোটপ্রার্থনার হাতিয়ার হবে তাদের শাসনপদ্ধতির গ্রহণযোগ্যতা, কোনওরকম মেরুকরণকে ইসু্যকে শস্ত্র বানিয়ে ভোটার টানার অন্যায় প্রয়াস থাকবে না। যেখানে ভোটের ময়দানে নামা হবে একুশ শতকের ভারতের চাহিদাগুলোর কথা মাথায় রেখে, ষোড়শ শতকে কে কোন ইমারত ধ্বংস করেছিল, তার প্রেক্ষিতে নয়।
সেই দেশ, যেখানে জলবায়ু পরিবর্তনের মতো মহার্ঘ বিষয়কে ঘরোয়া সেমিনার কিংবা আন্তর্জাতিক মঞ্চের মুখাপেক্ষী করে বসিয়ে রাখা হবে না, তা হয়ে উঠবে গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় অভ্যন্তরীণ ইস্যুগুলির অন্যতম। যেখানে পরিষ্কার বাতাসে প্রশ্বাস নেওয়া ও বিশুদ্ধ জলপান করার অধিকারকে ‘মৌলিক’ অধিকার হিসাবে মান্যতা দেওয়া হবে। যেখানে বন্যায় শহরকে-শহর ভেসে গেলে পৌরনিগমের কাছে পরিকাঠামোর মানোন্নয়ন নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারবে করদাতা নাগরিক।
সেই দেশ, যেখানে পুঁজিপতি বাণিজ্যিক সংস্থাগুলোর মোটা লোন পাওয়ার সুবিধা নেই। বা যেখানে সুদের কোনও কিস্তি শোধ না-করতে পারার জন্য গরিব হতদরিদ্র চাষির শেষ সম্বল ট্র্যাক্টরটি কেড়ে নেওয়া হবে না। যেখানে নামীদামি শিল্পক্ষেত্র থেকে কোনও অংশে কম সুযোগ-সুবিধা পাবে না অনামি, অনতিপরিচিত মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্পক্ষেত্রসমূহ। যেখানে অর্থাভাবে বা আয়কর বিভাগের ভয়ে ব্যবসা চালু করতে ভয় পাবে না সাধারণ মধ্যবিত্ত; ধনী ব্যবসায়ী নাগরিকত্ব বদলে বিদেশে থিতু কেন হল ভাবতে হবে না তাদের।
সেই দেশ, যেখানে সরকারি চাকরির পরীক্ষা বছরের পর বছর পিছিয়ে দেওয়া হবে না। প্রশ্নপত্র প্রকাশিত হয়ে যাওয়ার দরুন লক্ষাধিক চাকরিপ্রার্থীর ভাগ্যাকাশ অনিশ্চয়তার চাদরে ঢাকা পড়বে না অনির্দিষ্টকালের জন্য। যেখানে সংরক্ষণ এমন কোনও রাজনৈতিক হাতিয়ার হয়ে উঠবে না, যাতে জেনারেল ক্যাটাগোরির সিট ক্রমশ কমতে থাকে এবং উচ্চ প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাগুলোয় বসতেই অস্বীকার করে যোগ্য চাকরিপ্রার্থীদের একটা বড় অংশ। যেখানে সুনির্দিষ্ট স্কলারশিপ প্রোগ্রামের মাধ্যমে যোগ্য প্রার্থীদের দেওয়া হবে সমান সুযোগ।
সেই দেশ, যেখানে দুই ভিন্ন ধর্মাবলম্বীর স্বেচ্ছাবিবাহকে অবিলম্বে ‘লাভ জিহাদ’ বলে দাগিয়ে দেওয়া হবে না। যেখানে ভালবাসাকে ‘দাগী আসামি’-র কাঠগোড়ায় তোলা হবে না অ-সাংবিধানিক ভিত্তিহীন আইনের মাধ্যমে। যেখানে ধর্ষণের ঘটনার বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ ক্রোধের নির্ণায়ক হবে অপরাধীর হিংস্রতার মাত্রা বা ধরন, তার ধর্মীয় পরিচয় নয়। অপরাধীর নাম ‘আফতাব’ হোক বা ‘অমর’- হত্যার বিরুদ্ধে আইন সব্বার জন্য সমান হবে যেখানে।
সেই দেশ, যেখানে অভিনেতার পোশাকের রং সিনেমা ব্যানের কারণ হয়ে উঠবে না। সেই দেশ, যেখানকার গোষ্ঠীনির্ভর সমাজে- যে-সমাজে কোনও রংয়ের উপর কারও একচ্ছত্র অধিকার নেই- কমলা হয়ে উঠতে পারবে একই সঙ্গে পবিত্রতা ও সৌন্দর্যের রং। যেখানে অবিমিশ্র ধর্মান্ধতার বশে একজন মুসলিম তারকাকে আক্রমণ করার ডাক পরিত্যাজ্য হবে। যেখানে স্ব-ঘোষিত সাংস্কৃতিক কেষ্টবিষ্টুরা সহস্রাব্দ-প্রাচীন এক সভ্যতার একমেবাদ্বিতীয়ম্ অভিভাবক হয়ে উঠতে পারবে না। যেখানে নিজেদের প্রোপাগান্ডা চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সরকার কোনও নির্দিষ্ট চলচ্চিত্রকে প্রোমোট করতে পারবে না; পারবে না সরকারকে তোশামোদ না-করা কোনও ছবিকে অযথা সেন্সর করে দিতে। যেখানে ‘আমরা-ওরা’-এ দ্বিখণ্ডিত সমাজে ‘ওদের’ পাশাপাশি বসবাস ও সহিষ্ণুতা দেশের আদর্শ বৈচিত্রের স্মারক হয়ে উঠবে।
সেই দেশ, যেখানে হেট স্পিচ ও কুৎসা ছড়ানোর জন্য ‘ফ্রি ফর অল’ করে দেওয়া হবে না সোশ্যাল মিডিয়া। যেখানে ফ্যাক্ট চেকারদের এই মর্মে গ্রেফতার করা হবে না যে, তাঁদের পরিবেশিত যুক্তি উত্তর-সত্য যুগের শাসকের কাছে যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য নয়। যেখানে রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় পুষ্ট ও সুরক্ষিত কর্পোরেট ধনকুবেররা বলপূর্বক মিডিয়া কোম্পানি অধিগ্রহণ করে বাক্স্বাধীনতার পক্ষে ঠুনকো বুলি ছড়াবেন না। যেখানে প্রাইমটাইম টিভি শো-কে লাভের গুড় চাটতে ধর্মীয় মেরুকরণভিত্তিক ইস্যুর উপর নির্ভর করতে হবে না; বদলে তারা দর্শককে ঋদ্ধ করবে প্রকৃত জ্ঞানের দ্বারা, কানঝালাপালা করা চিৎকার দিয়ে নয়।
সেই দেশ, যা একদিন ফুটবল বিশ্বকাপের ফাইনালে কোয়ালিফায়েড হবে। যার টিমকে কোনও বিদেশি মেসি-র মুখাপেক্ষী হয়ে বসে থাকতে হবে না, নিজের টিমের মণিমানিক্য যারা দেশের মাটিতেই সৃজন করবে। যেখানে দেশের মহিলা ক্রিকেট-হকিও পুরুষ ক্রিকেট-হকির মতো সমান গুরুত্ব ও স্বীকৃতি পাবে যেকোনও জয়ের পর।
সেই দেশ, যেখানে দিনান্তে প্রতিটি দেশবাসী- জাতি-ধর্ম-প্রদেশ-লিঙ্গ-উপার্জন ভেদে- ভারতীয় নাগরিক হওয়ার অনুভূতিতে গর্বিত হতে পারবে। ভারতেরে সেই স্বর্গে করো জাগরিত।
আগাম হ্যাপি নিউ ইয়ার!