ক্রিকেট আর বিনিয়োগ-দুনিয়ায় মধ্যে মিল বিস্তর। বাইশ গজে যেমন অধিনায়ক ঠিক করেন টিমের এগারো সৈনিক কে কে হবেন, তেমনই লগ্নিক্ষেত্রে কোথায়, কীভাবে কতটা বরাদ্দ হবে, ঝুঁকি কতটা নেওয়া যাবে-সিদ্ধান্ত লগ্নিকারীকেই নিতে হয়। ক্যাপ্টেনের সিদ্ধান্তে নির্ভর করে দলের পারফরম্যান্স। সেরকমই লগ্নিকারীর সিদ্ধান্তে নির্ভর করে লাভ-লোকসান। ‘সঞ্চয়’-এর জন্য লিখছেন ফরহাদ গদিওয়ালা, এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট ও প্রোডাক্ট হেড, ইউটিআই মিউচুয়াল ফান্ড।
সঠিক অ্যাসেট অ্যালোকেশন একান্ত প্রয়োজন যদি সম্পদ গঠন সুষ্ঠুভাবে করতে হয়। ক্রিকেটীয় উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি বোঝানো যাক। টি-টোয়েন্টি খেলায় যেমন স্ট্র্যাটেজির গুরুত্ব অপরিসীম আর বিজয়ী টিমকে নানা ধরনের পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হয়-তেমনই লগ্নির পৃথিবীতে কৌশলের প্রয়োগ খুবই জরুরি। স্ট্র্যাটেজি ছাড়া আপনার পোর্টফোলিও ভালভাবে পারফর্ম করবে না।
অ্যাসেট অ্যালোকেশনের প্রসঙ্গ এখানেই আসে। ইনভেস্টমেন্টের সাফল্য এর উপর ভীষণভাবে নির্ভর করে। কোন শ্রেণির অ্যাসেটে ঠিক কতখানি বিনিয়োগ করবেন, তা বুঝতে হবে। অ্যাসেট ক্লাস তো একাধিক রকম হতে পারে- ইকুইটি, ডেট (ফিক্সড ইনকাম), রিয়েল এস্টেট বা গোল্ড, এগুলিই প্রধান অ্যাসেট। আপনার ‘ফাইন্যান্সিয়াল গোলস’ বা বিনিয়োগের লক্ষ্যবস্তুগুলি কেমন, তা প্রথমে ঠিক করুন। কিভাবে রিস্ক নিতে পারবেন, তাও বুঝে নিন। তারপর অ্যালোকেশন করুন-এতে পোর্টফোলিও ঠিক মাপের হবে, অনিশ্চয়তা (ভোলাটিলিটি) কমবে এবং স্থিতিশীলও হবে।
[আরও পড়ুন: অনলাইন লেনদেনে সাবধান, ফাঁদ পেতে রয়েছে সাইবার প্রতারকরা]
মনে করুন আপনি ক্রিকেট টিমের ক্যাপ্টেন, আপনি ঠিক করবেন ব্যাটসম্যান, বোলার, ফিল্ডারদের মিশ্রণ। ব্যাপারটা অনেকটা সেইরকমই। মিশ্রণে ভুল থাকলে, খাদ মিশলে, পারফরম্যান্স খারাপ হবে গোটা টিমের। লগ্নির ক্ষেত্রেও তাই। বিভিন্ন সময় একেবারে সঠিক মিশ্রণের লক্ষ্যে অবিচল থাকুন, লাভবান হবেন।
এইবার মূল প্রশ্ন, কোনটি আপনার জন্য ঠিক অ্যালোকেশন? উত্তর দেওয়ার আগে বলে রাখি আমার কাছে কোনও ম্যাজিক ফর্মূলা নেই। তবে ছোট ছোট কিন্তু জরুরি কয়েকটি কথা বলতে চাই, এগুলি মনে রাখবেন। সর্বদা আপনার ‘ফাইন্যান্সিয়াল গোলস’—এর তালিকা স্মরণে রাখবেন। ‘শর্ট টার্ম’ যদি কোন লক্ষ্য হয় – যেমন নতুন গাড়ি কেনা বা ভাল ভাবে কোথাও বেড়াতে যাওয়া- তাহলে স্বল্প মেয়াদের জন্য আদর্শ এমন অ্যাসেট বেছে নিন। দেখবেন সেখানে ভোলাটিলিটি যেন তুলনায় কম হয়, হয়তো ফিক্সড ইনকাম গোত্রের কোনও অ্যাসেট হবে সেটি। অন্যদিকে, ধরা যাক আপনার অভীপ্সা বাচ্চাদের উচ্চশিক্ষা বা নিজের অবসর। তখন আবার দীর্ঘ মেয়াদের লগ্নিই ঠিক বলে গণ্য হবে। ইকুইটির কথা স্বাভাবিকভাবেই মনে আসে এই প্রসঙ্গে। লম্বা দৌড়ের সম্পদ গঠন করা এই অ্যাসেট ক্লাসের পক্ষে অসম্ভব কিছু নয়।
এই প্রসঙ্গে বলে রাখি আপনার ‘রিস্ক প্রোফাইল’-এর কথা।
‘কতটা ঝুঁকি নিতে পারব আমি?’- এই প্রশ্ন খুবই জরুরি। এর ভিত্তিতেই ঠিক করতে হবে মাসিক উপার্জনের কতটা আপনি বিনিয়োগ করতে পারবেন, কত অংশ থাকবে ‘রিস্কি অ্যাসেটে’ এবং কত অংশ থাকবে স্বল্প ঝুঁকির অ্যাসেটে? যদি আপনি প্রধানত কনজারভেটিভ বা রক্ষণশীল মানুষ হন, তাহলে অপেক্ষাকৃত কম ঝুঁকিই আপনার পক্ষে শ্রেয়। অন্যদিকে যদি ঝুঁকি নিতে পিছপা না হন, তাহলে আপনি অবশ্যই ইকুইটি ইত্যাদি পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। সম্পদ গঠন করার সময় সুরক্ষার দিকে চোখ রাখবেন বেশি, না কি তুলনায় কম-তা ঠিক করার দায় কিন্তু আপনার, অন্যেরর নয়। যদি ঝুঁকি নিতে চান, তাহলে মনে রাখুন পরে সুবিধা পেতে পারেন বটে তবে তার জন্য প্রাথমিকভাবে ক্ষতি স্বীকার করতে হতে পারে। অনলাইনে নির্দিষ্ট কিছু ‘টুল’ আছে, সেগুলি ব্যবহার করে নিজের রিস্ক নেবার ক্ষমতা যাচাই করতে পারেন।
যদি সময় (টাইম হরাইজন) এবং রিস্ক, দুইই নিয়ে সম্যক ধারণা হয়ে থাকে তাহলে নিজের অ্যাসেট অ্যালোকেশন নিজেই করুন। পূর্বের অভিজ্ঞতা থাকলে তা কাজে লাগান। না থাকলে কোনও পেশাদারের সাহায্য নিতে দ্বিধা করবেন না। অল্পবয়সি ক্রিকেটার যেমন কোচের পরামর্শ নিয়েই খেলতে নামেন, এখানেও তেমন। সঠিক অ্যালোকেশনের মদতে মার্কেটের বিভিন্ন পরিস্থিতি মোকাবিলা করুন, নিজের লগ্নির ভিত সুদৃঢ় করতে হবে আপনাকেই।