নির্মল ধর: মার্কিন নাট্যকারে মারে সিজেলের লেখা ‘টাইপিস্ট’কে (Typist bengali Drama) প্রয়াত অভিনেতা-নাট্যকার সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় (Soumitra Chatterjee) বাংলায় শুধু অনুবাদ করেননি, তিনি যেমনটি করে থাকেন বাংলায় অনুকৃতি করেছিলেন। এক অফিসের দুই সহকর্মী নব্য যোগ দেওয়া পল্ আর পুরনো কর্মী সিলভিয়া এখানে অনিরুদ্ধ হালদার এবং ইন্দ্রাণী দাশগুপ্ত। শুধু নামকরণেই সীমাবদ্ধ নয়, দু’জনের অতীত, বর্তমান, মানসিক গঠন, পরিবারের প্রতি দায়িত্ব, অভিমান, রাগ, অনুরাগ — সবকিছুই অনুকৃতিকার সৌমিত্র একেবারেই নিজস্ব অভিজ্ঞতায় বাঙালিয়ানার ভরপুর করে সাজিয়েছেন।
শুধু সাজিয়েছেন বলি কেন, চরিত্রদের নিজস্ব অনুভূতি, একাকীত্ব, শূন্যতা, নিজেদের চাওয়া, না পাওয়া, হতে চাওয়া, না হতে পারার চাপা মানসিক যন্ত্রণাকে একত্রিত করে সুন্দর পরিস্থিতি তৈরি করেছেন। নাটকের দৈর্ঘ্য মাত্র সোয়া ঘণ্টা। অথচ তার মধ্যেই দীর্ঘ সময়কে ধরতে হয়েছে। নির্দেশক পৌলমী বসু (Poulami Bose) দু-তিনবার পোশাকের পরিবর্তন এবং রূপসজ্জারও ন্যূনতম বদল ঘটিয়ে সেই প্রবহমান সময়কে ধরেছেন মঞ্চে। আমরা সিনেমায় সময়ের পরিবর্তন দেখতে পাই, মঞ্চে তো সেভাবে সম্ভব নয়! তাই এমন প্রয়োগশৈলীর ব্যবহার।
বেশ মজাই লাগে চকিতে হওয়া এই বদলগুলো। অনিরুদ্ধ কাজে যোগ দিয়েই বলেছিল, আইন পাশ করতে পারলেই সে তার জ্যাঠার ফার্মে যোগ দেবে। তা আর হল কই! বয়স বাড়ল। চুলে পাক ধরল দু’জনারই। ঝগড়া, খুনসুটি, বন্ধুত্বের মধ্যেই কীভাবে, কখন যেন অনিরুদ্ধ ও ইন্দ্রাণীর মধ্যে গড়ে উঠল এক বিনি সুতোয় গাথা সম্পর্কের বিনুনি। অনিরুদ্ধ রয়ে গেল তার স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে। ইন্দ্রাণী তার দিদি ও মাকে না ভালোবাসলেও তাদের নিয়েই প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছে গেলো অনিরুদ্ধর বন্ধুত্বের হাত ধরে।
[আরও পড়ুন: প্রেমে পড়া বারণ! খদ্দেরের বিয়ের প্রস্তাব পেয়ে এ কী করলেন যৌনকর্মী!]
নাটকের যে এমন পরিণতি হবে এটা দর্শকের কাছে অজানা নয়। কিন্তু তাঁরা অপেক্ষা করছিলেন কীভাবে ঘটনাটি ঘটে তা দেখার জন্য। তাঁদের সেই অপেক্ষা সার্থক করে দিয়েছেন দুই শিল্পী দেবশংকর হালদার (Debshankar Haldar) এবং পরিচালক পৌলমী স্বয়ং। খুবই সাবলীল, সংযত, স্বতস্ফূর্ত, প্রাণবন্ত তাঁদের চরিত্রায়ন। দেবশংকরের ছোট ছোট পজ, চকিত চাহনি, হাফ কথা উচ্চারণ করে গিলে ফেলার অভ্যাস বেশ নাটকীয় এবং উপভোগ্য। অবশ্য সেই সঙ্গে পৌলমীর সঙ্গত (কখনও নীরব, কখনও পালটা সংলাপে) অসাধারণ।
এই দু’জনের উপস্থিতিতে ‘টাইপিস্ট’ হয়ে ওঠে যথার্থ এক বাংলা প্রযোজনা, যার গায়ে কোনও বিদেশি বর্ণ-গন্ধ-পোশাক নেই। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের অনুবাদের রসগুণ ছিল এমনটাই। মেয়ে পৌলমী বাবার রচনার সেই ধর্ম ও গুণটিকে যথাযথ বজায় রেখেই ‘মুখোমুখি’ ব্যানারে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীর ঠিক আগের দিন অ্যাকাডেমি মঞ্চে ‘টাইপিস্ট’ পরিবেশন করলেন। দিশারী চক্রবর্তীর আবহ, বিলু দত্তর প্রায় নিরাভরণ মঞ্চ, মনোজ – মানসের আলো এই দুই অভিনেতার অভিনব যুগলবন্দিকে করে তুলেছিল আরও বাঙ্ময় ও উপভোগ্য। পৌলমীর কথায় ,”বাবার আদর্শ অনুসরণ করেই আমি লড়াই করে যাব। পিছিয়ে পড়ব না। থেমেও যাব না।”