shono
Advertisement

ভক্তির পথে বাধা নয় ধর্ম, বিধর্মীকেও দর্শন দেন প্রভু জগন্নাথ

শ্রীক্ষেত্রের জগন্নাথ মন্দির সনাতন ধর্মাবলম্বীদের আরাধনাস্থল।
Posted: 02:06 PM Jul 06, 2022Updated: 02:06 PM Jul 06, 2022

অরিঞ্জয় বোস: ভক্তির পথেই ঈশ্বরের দর্শনলাভ। এই পৃথিবীতে যুগে যুগে মহাপুরুষগণ অবতীর্ণ হয়ে এ-কথা বারংবার বলে গিয়েছেন। তবু ধর্মের গূঢ় অর্থের সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের আচরণবিধির কিছু ফারাক থেকেই যায়। আর সেই ভেদবিধি অনুসারেই এক এক ধর্মের জন্য নির্দিষ্ট হয় স্বতন্ত্র আরাধনাস্থল। তবু অখণ্ডসত্তা যে-ঈশ্বর, সেই পরমব্রহ্মের কাছে আদতে মানুষের কোনও ভেদ-ই থাকে না। তথাকথিত ধর্মের নিরিখে তাই যিনি যে-মতই অবলম্বন করুন না কেন, ভক্তির পথ ধরে তিনি একদিন ঠিক ঈশ্বরের দর্শন পান। আর তাই লীলাপুরুষোত্তম শ্রীজগন্নাথদেবও দর্শন দেন বিধর্মীকে। ঠিক যেমন তিনি দেখা দিয়েছিলেন হাফিজ কাদিরকে।

Advertisement

[আরও পড়ুন: বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় মত, বলিদান বন্ধের নির্দেশ, যুগান্তকারী সিদ্ধান্তে অগ্রণী মা সারদা]

শ্রীক্ষেত্রের জগন্নাথ মন্দির সনাতন ধর্মাবলম্বীদের আরাধনাস্থল। সেখানে সকলের প্রবেশের অনুমতি নেই। বহু নিয়ম মেনেই জগন্নাথ দর্শনের সৌভাগ্য হয় কারও কারও। এই অনুমতি সহজলভ্য নয়। ইতিহাস বলছে, বহু বিখ্যাত ব্যক্তিত্বও মন্দিরে প্রবেশের অনুমতি পাননি। তাহলে হাফিজ কাদির, ভিন ধর্মের মানুষ হওয়া সত্ত্বেও কীভাবে পেলেন তাঁর দর্শন? এর উত্তর সন্ধানে আমাদের ফিরয়তে হবে হাফিজের জীবনের ইতিহাসে। বাংলায় তখন চলছে ইসলামি রাজত্ব। সেই সময়ে রাজা হরিকৃষ্ণদেবের পৌত্র গজপতি দ্বিতীয় রামচন্দ্রদেবকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য করেছিলেন বাংলার নবাবের সেনাপতি তাকী খাঁ। রাজার নতুন নাম হল হাফিজ কাদির। নবাবের পরিবারের এক কন্যার সঙ্গে তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলেন। পরিণয়, ধর্মান্তকরণ- সব-ই হল। কিন্তু রাজার মন পড়ে থাকল শ্রীজগন্নাথদেবের পাদপদ্মে। এদিকে ভিনধর্মের মানুষ হয়ে তিনি তখন জগন্নাথদেবের মন্দিরে প্রবেশের অধিকার হারিয়েছেন। জগন্নাথ দর্শন বিহনে তাঁর প্রাণ যেন বাঁচে না। ভক্তের এই বিরহভার সইতে পারলেন না স্বয়ং মহাপ্রভু জগন্নাথ। আমাদের মনে পড়বে, ভক্তশ্রেষ্ঠ যাঁরা, সেই গোপীদের বিরহে কাতর হয়েছিলেন স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ। ভক্তের আকুলতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন ‘গোপীগীতা’। যেখান থেকে আমরা পেয়েছি ‘কথামৃত’ শব্দটিকে। গোপীরা আকুল হয়ে বলেছিলেন, ভগবানের কথাই অমৃতের সমান হয়ে এসে তাঁদের প্রাণরক্ষা করে। অনেকটা যেন সেভাবেই, অন্য রূপে ভক্ত হাফিজ কাদিরকে প্রভু দর্শন দিলেন। মূর্তি নয়, ধরা দিলেন চিত্রের মাধ্যমে। মন্দিরে প্রবেশ করতে হল না কাদিরকে, তবু প্রভুদর্শনের কাঙ্ক্ষা পূর্ণ হল তাঁর। মন্দিরে প্রবেশের সিংহদ্বারের নিচে আঁকা হল প্রভুর মুখ। তা দর্শন করেই বিরহ ভুললেন ভক্ত হাফিজ কাদির। সিংহদ্বার দিয়ে মন্দিরে প্রবেশ করার সময়, ফটকের নিচে করিডরের শেষ প্রান্তে মহাপ্রভুর মুখের অবিকল প্রতিরূপ আজও দেখা যায়। সম্ভবত রঘুরাজপুরের শিল্পীরাই তা এঁকেছিলেন। এই প্রতিরূপ আঁকা হয়েছিল ভক্ত হাফিজের প্রভুদর্শনের অভিলাষ পূরণ করতেই।

সময়ের নিরিখে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের নানা রূপ আমরা দেখতে পাই। জল-অচল ভাগ কখনও ক্ষীণ, কখনও তীব্র। তবু একেবারে যে মিলিয়ে যায়, তা নয়। সেই প্রেক্ষিতেই, জগন্নাথদেব আর ভক্ত হাফিজ কাদিরের এই আখ্যান যেন সন্ধান দেয় অপূর্ব উদারতার। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের ভিতরই সমন্বয়ের এক বার্তা হয়ে প্রতিভাত হয় এই কাহিনি। যা আজও আমাদের জানায়, ভক্তির পথে সত্যিই বাধা হয়ে দাঁড়ায় না কোনও ধর্ম। ইসলাম মতে সাধন করেছিলেন স্বয়ং শ্রীরামকৃষ্ণ, মায়ের দর্শন পেতে সেই সাধনা কিন্তু প্রতিবন্ধক হয়ে ওঠেনি। এ-সবই আমাদের পৌঁছে দেয় সেই ঋত উপলব্ধির কাছে, যা শেখায়, মানুষ নিজে বহু ভেদাভেদ রচনা করে বটে, তবে অখণ্ডসত্তার কাছে মানুষের শুধু ভক্তরূপটিই গ্রাহ্য হয়, অন্য কিছু নয়।

[আরও পড়ুন: নন্দগাঁও ও বারসানা, রাধাকৃষ্ণের নিজেদের গ্রামে আজও নিষিদ্ধ প্রেম]

 

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement