মাধবী মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা বললেন শ্যামশ্রী সাহা।
সেই কবে থেকে ওঁর সঙ্গে আমার অভিনয় জীবনের সফর। আর আজ এত বছর পরে ফিরে দেখলে মনে হয়, কত মুহূর্ত, কত ছবিই না আমরা একসঙ্গে করলাম। ওঁর জন্মদিনে আমি ওঁর দীর্ঘায়ু কামনা করি। সুস্থ জীবন কামনা করি। উনি আরও অনেক দিন বেঁচে থাকুন। আরও ছবি করুন যাতে প্রতিটি মানুষ আরও শিক্ষিত হতে পারে।
আমার কাছে সৌমিত্র মানেই একজন চূড়ান্ত পেশাদার অভিনেতা। একটা গল্প বলি তাহলে আপনাদের।
‘জোড়াদীঘির চৌধুরী পরিবার’-এর শুটিং চলছে। একটা মারপিটের সিনে বোমা ফাটানোর দৃশ্য ছিল। ডিরেক্টর এই কাজটা করতে গিয়ে বোমাটা ওঁর হাতে ফেটে যায়। সে এক সাংঘাতিক অবস্থা। কেউ কালি নিয়ে এসে হাতে দিচ্ছে, কেউ আলু থেঁতো করে লাগাচ্ছে। এবার কে ডিরেকশন দেবে? শুটিং বন্ধ হয়ে যাওয়ার মত অবস্থা। ডাক্তার ডাকা হল। তিনি ইঞ্জেকশন দিয়ে ওঁকে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু ডিরেক্টর কিছুতেই ঘুমোতে চাইছিলেন না। বলছেন, “আমি কাজ করতে পারব। আমাকে শটগুলো নিতে হবে।” কিন্তু ডাক্তার ওঁর কথা শুনতে চাইছিলেন না।
এমন সময় সৌমিত্রবাবু ডিরেক্টরকে আশ্বস্ত করে বললেন, “শটগুলো আমি নিয়ে নেব। তুই চিন্তা করিস না।” সে দিন উনি এগিয়ে না এলে শুটিং বন্ধ হয়ে যেত।
আর একটা ঘটনা মনে পড়ছে। ‘চারুলতা’ যখন রিলিজ করল, এক সাংবাদিক খুব খারাপ রিভিউ করেছিলেন। উনি বলেছিলেন, ‘চারুলতা’ খুব খারাপ ছবি। মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। ওই ছবিতে কাজ করার সময় আমরা আর কোনও ছবির কাজ নিইনি। একটা ছবির কাজ মনপ্রাণ দিয়ে করেছি। সেই ছবি খারাপ হয়েছে শুনলে মন খারাপ হবে না? কিন্তু ওই সময় সৌমিত্রবাবুর কোনও প্রতিক্রিয়া দেখিনি। পরবর্তীকালে অবশ্য এই ছবি সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো সারা বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল।
[ ‘উরি’-তে কীভাবে ভিভান সিং শেরগিল হয়ে উঠলেন ভিকি? ]
আমি তো এখনও কাজ করছি ওঁর সঙ্গে। উত্তরোত্তর ওঁর কাজ এত ভাল হয়েছে যে, এখনও ওঁর আশেপাশে কাউকে দেখতে পাই না। প্রতিদিন যেন উনি একটা করে ধাপ এগিয়ে যাচ্ছেন। সৌমিত্রবাবু যখন যে কাজটা করেন, তখন সেই কাজ ছাড়া আর কিছু ভাবতেই পারেন না। এটা ওঁর সবথেকে বড় গুণ।
থিয়েটারে যখন ডিরেকশন দিতেন, সবটাই উনি ভাবতেন। সংলাপ কী হবে, হাতের ওঠানামা কী হবে, এক্সপ্রেশন কী হবে, কী ডিজাইনের শাড়ি পরা হবে, সব। এখানে আমি কিছু ভাবব, এই সুযোগ উনি দিতেন না। এটা উনি পছন্দও করতেন না। কিন্তু যখন উনি অভিনেতা, তখন নিজস্ব মতামত দিতেন না। ডিরেক্টর যেভাবে বলতেন সেভাবেই কাজ করতেন।
আর একটা কথা বলতে খুব ইচ্ছে করছে। ওঁর সব ছবিই খুব ভাল কিন্তু ‘একটি জীবন’ ছবিতে উনি যা অভিনয় করেছিলেন, জানি না কীভাবে মূল্যায়ন হয়, ওঁর জাতীয় পুরস্কার পাওয়া উচিত ছিল। কেন পাননি জানি না।
কত গুণ ওঁর। কী অসাধারণ কবিতা লেখেন। আবৃত্তি করেন। জানেন, উনি ভাল গান গাইতেও পারেন। ‘চারুলতা’র গানগুলো উনি কী ভাল গেয়েছিলেন। থিয়েটারে তো উনি বাজাতেনও। একটা নাটকের কথা মনে পড়ছে, থিয়েটারে তখন পর্দার পাশে পিয়ানো, অর্গ্যান, তবলা, চেলো এই সব বাদ্যযন্ত্র থাকত। কিন্তু কোনও কারণে ওই শোতে কোনও বাদ্যযন্ত্র ছিল না। সৌমিত্রবাবু একটা হারমোনিয়াম দড়ি দিয়ে বেঁধে গলায় ঝুলিয়ে বাজালেন আর শ্রীলা (মজুমদার) গান গাইল।
অনেক গুণ ওঁর। ভাল ছবিও আঁকতে পারতেন। অসম্ভব গুণী মানুষ। তবে অভিনয় ওঁর প্রথম পছন্দ। আর বাকি সব কিছু ওঁর মনের প্রতিফলন।
[ শহরের বুক থেকে হারিয়ে যাচ্ছে এই চেনা শব্দগুলো ]
The post চারুর চোখে অমল, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্মদিনে স্মৃতিচারণা মাধবীর appeared first on Sangbad Pratidin.