সব্যসাচী বাগচী: আজ ৩০ অক্টোবর। আজ দিয়েগো মারাদোনার জন্মদিন। ৬৩ বছরে পা দিলেন সবার খুব প্রিয় দিয়েগো। রাজার মতো বেঁচে থাকা কাকে বলে সেটা শুধু শেন ওয়ার্ন দেখিয়ে যাননি। এই ‘মতাদর্শ’-এ সেই ১০ নম্বর জার্সিধারী প্রবাদপ্রতিম অনেক এগিয়ে। বেঁচে থাকলে এমন বিশেষ দিনে পার্টি দিতেন। বন্ধু-বান্ধব, এই বয়সেও বিশেষ বান্ধবীদের সঙ্গে মজতেন মজলিসে! পানীয়, সিগারের সঙ্গে চলতো উদ্দাম নাচ। কিন্তু তেমন মুহূর্ত তো আর আসবে না। কারণ ২০২০ সালের ২৫ নভেম্বর থেমে গিয়েছেন তিনি। কিংবদন্তি, নায়ক, ফুটবলের ব্যাড বয়। আসলে ভুখা কিংবা আর্ধেক পেটে ঘুমিয়ে পড়া দেশগুলোর কাছে দিয়েগো একটা আবেগ। কোনও একটা সংজ্ঞায় বাঁধা যেত না সাড়ে ৫ ফুট উচ্চতার মানুষটাকে। এক নজরে দেখে নেওয়া যাক বিতর্ককে সঙ্গে নিয়ে উল্কার গতিতে পেরনো তাঁর জীবন।
শুরুর দিনগুলো
৩০ অক্টোবর ১৯৬০। আর্জেন্টিনার বুয়েনাস আইরেস প্রদেশের লানুসের গোঁড়া ক্যাথলিক পরিবারে জন্ম দিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনার। আট ভাইবোনের পরিবারে তিনি ছিলেন পঞ্চম। বাবা কাজ করতেন কারখানায়। পরিবারে অভাব ছিল যথেষ্টই। ছোট্ট ছেলেটার ফুটবল স্কিল ছিল তাক লাগানোর মতো। ফুটবল স্কাউটদের নজর কাড়তে দেরি হয়নি। দিয়েগোর বয়স তখন ১০। বুয়েনাস আইরেসের বিখ্যাত ক্লাব আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্স তাঁকে সই করিয়ে ফেলল। বয়স ১৬ পূর্ণ হওয়ার আগেই ক্লাবের সিনিয়র দলের দরজা খুলে গেল তাঁর সামনে। সিনিয়র দলে দিয়েগোর প্রথম মরশুম। সেবার স্থানীয় লিগে চ্যাম্পিয়ন হল তাঁর ক্লাব। ঈশ্বর প্রদত্ত দক্ষতায় মাঠে তখন সবুজ গালিচায় ফুল ফোটাচ্ছেন দিয়েগো। ডাক নাম হয়ে গেল ‘ফিওরিতো’। বাংলায় যার মানে ‘ফুলের মতো সুন্দর’।
প্রাণের প্রিয় নীল-সাদা জার্সি
২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৭, দেশের ইতিহাসে কনিষ্ঠতম খেলোয়াড় হিসেবে আর্জেন্টিনার জাতীয় দলে সুযোগ পেলেন দিয়েগো। নীল-সাদা জার্সি, ‘আলবিসেলেস্তে’-এর হয়ে অভিষেক ম্যাচ হাঙ্গেরির বিরুদ্ধে। বয়স তখন ১৬ বছর ১২০ দিন। ৫-১ গোলে সেই ম্যাচ জিতেছিল আর্জেন্টিনা। পরের বছর বিশ্বকাপের আসর বসল মারাদোনার দেশে। কিন্তু জাতীয় কোচ লুই মেনত্তি তাঁকে দলে নিলেন না। কোচের দাবি ছিল মারাদোনা বয়সে ছোট, অভিজ্ঞতাও কম। যদিও নেদারল্যান্ডসকে ৩-১ গোলে হারিয়ে প্রথমবার বিশ্বজয় করল আর্জেন্টিনা। ফাইনালে জোড়া গোল করে জাতীয় নায়ক মারিও কেম্পেস। মাঠের বাইরে থেকেই দেশের বিশ্বজয় দেখতে হল মারাদোনাকে। পরের বছর মারাদোনার নেতৃত্বেই জাপানে অনুষ্ঠিত যুব বিশ্বকাপ জিতল আর্জেন্টিনা। বিশ্ব ফুটবলে আগমন হল ‘ফুটবলের রাজপুত্র’-এর। সে বছরই সিনিয়র দলের হয়ে প্রথম গোল করলেন। স্কটল্যান্ডের বিরুদ্ধে আর্জেন্টিনা ৩-১ গোলে সেই ম্যাচ জিতল। মাত্র ১৮ বছর বয়সেই দক্ষিণ আমেরিকার সেরা ফুটবলার নির্বাচিত হলেন দিয়েগো।
ইউরোপে আগমন
১৯৮২ সালে স্পেন বিশ্বকাপের দলে সুযোগ এল। ভালোই খেলছিলেন। কিন্তু চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিলের বিরুদ্ধেই ছন্দপতন। মেজাজ হারিয়ে লাল কার্ড দেখে মাঠ ছাড়তে হল তাঁকে। আর্জেন্টিনাও সেই ম্যাচে ৩-১ গোলে হেরে ছিটকে গেল প্রতিযোগিতা থেকে। কিন্তু মারাদোনার ফুটবল তত দিনে দক্ষিণ আমেরিকার গণ্ডি পেরিয়ে ইউরোপে পৌঁছে গিয়েছে। প্রায় ১১ লক্ষ পাউন্ডে তাঁকে সই করিয়েছিল বার্সেলোনা। ক্লাবের ফুটবল ম্যানেজার আর্জেন্টিনার সেই বিশ্বকাপ জয়ী কোচ লুইস মেনত্তি। বার্সেলোনায় দুটি মরশুম খেললেও সেভাবে দাগ কাটতে পারেননি। পরের মরশুমে রেকর্ড ৪০ লক্ষ পাউন্ড দিয়ে তাঁকে সই করাল ইতালির ক্লাব নাপোলি। প্রায় একক দক্ষতায় এসি মিলান, ইন্টার মিলান, জুভেন্টাসের মতো বড় বড় ক্লাবকে পিছনে ফেলে নাপোলিকে একক দক্ষতায় ইউরোপ চ্যাম্পিয়ন করিয়েছিলেন দিয়েগো।
‘হ্যান্ড অফ গড’ বিতর্ক
দিয়েগোর ফর্ম তখন তুঙ্গে। মাঝ মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তাঁর সেই ‘সোনায় বাধা’ বাঁ-পা। ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপ আসর বসল মেক্সিকোতে। বিশ্ব ফুটবলের ইতিহাসে সব চেয়ে নিন্দিত এবং প্রশংসিত দুটি গোলই সেবার করেছিলেন দিয়েগো। এবং একই ম্যাচে, ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে। বছর চারেক আগে ১৯৮২ সালে ফকল্যান্ড যুদ্ধে ইংল্যান্ডের কাছে পর্যুদস্ত হয়েছিল আর্জেন্টিনা। মাঠের বাইরের যুদ্ধের উত্তাপ যেন সবুজ গালিচায় ও গ্যালারিতে ছড়িয়ে পড়েছিল। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে কোয়ার্টার ফাইনালে যেন সেই যুদ্ধের উত্তাপ। পিটার শিল্টনের মাথার উপর দিয়ে গোল করে দলকে এগিয়ে দিলেন দিয়েগো। সবাই বলল হ্যান্ড বল, তিনি অনেক পরে হেসে বলেছিলেন ‘হ্যান্ড অফ গড’! যদিও দ্বিতীয় গোলটা ছিল ম্যাজিকের মতো। পাঁচ জন ইংরেজ ফুটলারকে অনায়াসে মাটি ধরিয়ে রাজপুত্র গোল করলেন। শতাব্দীর সেরা গোলের স্বীকৃতি পেল সেই গোল। ফাইনালে ৩-২ গোলে পশ্চিম জার্মানিকে হারিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বকাপ জিতল আর্জেন্টিনা। দিয়েগো পেয়েছিলেন সোনার বুট। পেলের পর বিশ্ব ফুটবল পেয়ে গিয়েছিল নতুন কিংবদন্তি।
নায়ক থেকে খলনায়ক!
বিশ্বজয়ের পর নাপোলিকেও তিনি পরের পর ট্রফি জেতাচ্ছেন। নেপলস শহরের কাছে তিনি তখন ঈশ্বরসম। কিন্তু উশৃঙ্খল জীবন তত দিন গ্রাস করতে শুরু করেছে তাঁকে। দিয়েগো কি মাদক নিচ্ছিলেন? উঠেছিল প্রশ্ন। গ্রহণ লেগেছিল তাঁর ফুটবলেও। ব্যক্তিগত জীবনেও বিতর্ক। বিয়ে করেছেন ক্লদিয়া ভিলাফেনকে, এরই মধ্যে ক্রিস্টানা সিনাগ্রা মামলা করে দাবি করেছিলেন তাঁরা সন্তানের বাবা মারাদোনাই! ১৯৯০ বিশ্বকাপেও ফাইনালে গেল আর্জেন্টিনা। প্রতিপক্ষ সেই পশ্চিম জার্মানি। কিন্তু ইতালি থেকে রানার্স হয়েই ফিরতে হল মারাদোনার দলকে। গোটা প্রতিযোগিতায় চেনা ফর্মের ধারেকাছেও দেখা গেল না তাঁকে। যে ইতালিতে ফুটবল খেলতে গিয়ে তিনি বিশ্বসেরা হয়েছিলেন, সেই ইতালিতেই তিনি সেবার নিন্দিত, ধিকৃত। ডোপ পরীক্ষায় ধরা পড়েছিলেন। ইতালির ফুটবলে ১৫ মাসের জন্য তাঁকে নির্বাসন করা হয়েছিল। ইতালি ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। এর পর দেশে ফিরে সমস্যা আরও বেড়ে যায়। কারণ আর্জেন্টিনা ফিরতেই গ্রেপ্তার হয়েছিলেন কোকেন নেওয়ার অপরাধে। তাঁকে দুই বছরের জন্য নির্বাসিত করেছিল ফিফা। যদিও সেই পর্ব ভুলে ১৯৯২ সালে আবার স্পেনের সেভিয়াতে যোগ দিলেন মারাদোনা। কোচ ছিলেন ১৯৮৬ এবং ১৯৯০ বিশ্বকাপের আর্জেন্টিনাকে ফাইনালে তোলা কার্লোস বিলার্দো। কিন্তু সেবার আর মারাদোনা ও বিলার্দো জুটি জমেনি। ২৬ ম্যাচে ৫ গোল করে সেভিয়া ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন।
ফিদেল কাস্ত্রোর অন্ধ ভক্ত
‘গুডবাই কমানদান্তে’ – ঠিক এভাবেই ফুটবলের রাজপুত্রের বিদায়ের পরে তাঁকে বিশ্বজুড়ে বামপন্থী চিন্তাধারার মানুষ শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। দিয়েগো মারাদোনা নিজেকে কোনওদিন বামপন্থী বলেননি। বরং জানাতেন, তিনি ফিদেল কাস্ত্রোর ভক্ত। বলেছিলেন, ‘আমি কমিউনিস্ট নই। মৃত্যু পর্যন্ত আমি ফিদেলিস্তা।’ একইসঙ্গে হাতে বড় করে আঁকা চে’র উল্কির বারবার প্রদর্শন ঘটিয়েছেন জনসমক্ষে। হাভানা চুরুট হাতে একাধিকবার ধরা পড়েছেন ক্যামেরার লেন্সে। সার্বিয়ান সংবাদপত্র পলিটিকায় দেওয়া এক অকপট সাক্ষাৎকারে মারাদোনা বলেছিলেন, ‘বুয়েনাস আইরেসের সবচেয়ে দারিদ্র পীড়িত অংশ ফ্যাবেল ফিওরিটোতে আমার জন্ম। অঞ্চলের দারিদ্রের রূপ এখনও আগের মতোই আছে। বন্ধুরা এখনেও সেই আগের মতোই আছে। শুধু রাজনীতিবিদ আর সরকারি লোকেরাই দিনদিন ধনী হয়েছে।’ অকপট স্বীকারোক্তিতে জানিয়েছিলেন, ‘ধনী হওয়ার সুযোগ আমারও ছিল। কিন্তু আমি সুযোগ নিইনি, কারণ সেটা করতে গেলে আমায় গরিবের পেটে লাথি মেরে তাঁদের কাছ থেকে চুরি করতে হত।’
[আরও পড়ুন: সত্তর হাজার ‘কোহলি’র সামনে বিরাট-জন্মদিন উদযাপন ইডেনে]
কেরিয়ারের শেষের দিকে
কিংবদন্তি তখন চোট আঘাতে জেরবার। খেলছেন আর্জেন্টিনার রোজারিও শহরের নিউওয়েলস ওল্ড বয়েস ক্লাবে। বিশ্বকাপে প্রাথমিক দলে তাঁর জায়গা হল না। শেষমেশ বিশ্বকাপের যোগ্যতা অর্জন পর্বে আর্জেন্টিনা যখন খাদের কিনারে, তখন তাঁর ডাক পড়ল। ১৯৯৪ সালের আমেরিকা বিশ্বকাপের খেলতে নামলেন দিয়েগো। তবে তখন তিনি অতীতের ছায়া মাত্র। গ্রিসের বিরুদ্ধে ৪-০ গোলে জিতল আর্জেন্টিনা। গোল করলেন তিনিও। আস্ফালন করলেন টিভি ক্যামেরার সামনে এসে। সেটাই হয়ে থাকল দেশের জার্সিতে তাঁর শেষ ম্যাচ। নিষিদ্ধ ড্রাগ এফেড্রিন নেওয়ায় বিশ্বকাপ থেকে তাঁকে ফেরত পাঠানো হল। লিগ পর্যায় হেরে ফিরল আর্জেন্টিনাও। ফিফা তাঁকে ১৫ মাসের নির্বাসনে পাঠায়। ফলে দেশের হয়ে ১০০টা ম্যাচ খেলা হল না তাঁর। আন্তর্জাতিক কেরিয়ার শেষ হল ৯১ ম্যাচে ৩৪ গোল নিয়ে। ১৯৯৭ সালে বোকা জুনিয়র্সের হয়ে খেলতে খেলতে ৩৭ বছর বয়সে ফুটবলকে বিদায় জানালেন মারাদোনা। রেকর্ড বইয়ে তাঁর নামের পাশে লেখা থাকল ৬৭৮ ম্যাচে ৩৪৫টি গোল। পরে কোচ হয়ে মারাদোনা ফিরলেন বটে, সবাই ধরে নিয়েছিল যে ২০১০ সালের বিশ্বকাপে লিওনেল মেসি ও মারাদোনা জুটি দেশকে ফের হারানো সম্মান এনে দেবে। তাক লাগিয়ে দেবে ফুটবল বিশ্বকে। কিন্তু ভাল খেলোয়াড় মানেই ভাল কোচ নয়। মারাদোনার ক্ষেত্রে সেটা খেটে গেল। সেই বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে খেলোয়াড় জীবনের প্রতিদ্বন্দ্বী যুরগেন ক্লিন্সম্যানের জার্মানির কাছে হারল কোচ মারাদোনার আর্জেন্টিনা।
পেলে না মারাদোনা? কে সেরা?
বিশ্বের সর্বকালের সেরা ফুটবলার কে? নতুন শতকের শুরুতে ২০০০ সালের পেলের সঙ্গে যৌথ ভাবে শতাব্দীর সেরা ফুটবলার নির্বাচিত হয়েছিলেন দিয়েগো মারাদোনা। পেলের তিন বিশ্বকাপ জয়ের কীর্তি আর কারও কখনো ছোঁয়া হবে কি না সংশয় আছে। আর মারাদোনা? তাঁর মতো করে একা হাতে, এত আলোচনায়-বিতর্কে থেকে, মুগ্ধতা ছড়িয়ে বিশ্বকাপ জেতার সৌভাগ্য আর সম্ভবত কারও হবে না। তবুও পেলে বনাম মারাদোনা’র আকর্ষণ অনন্য! শেষ কয়েক বছরে অবশ্য অন্য কারও তুলনায় নিজেরাই বিতর্কটাকে জাগিয়ে তুলেছেন বেশি। সেই আশির দশকে বিতর্কটা শুরু হওয়ার পর থেকেই কত শতবার যে একে অন্যকে খুঁচিয়ে গিয়েছেন, সেই হিসাব করতে গেলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পেরিয়ে যাবে। কখনই মুখে লাগাম না–টানা মারাদোনা বলেছিলেন, ‘পেলের জাদুঘরে যাওয়ার সময় হয়েছে!’ নিজের আত্মজীবনীতেই পেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিলেন। লিখেছিলেন, ‘ব্রাজিলকে ১৯৬২ বিশ্বকাপ এনে দেওয়া গারিঞ্চাকে এভাবে ধুঁকে ধুঁকে দারিদ্র্যে মরতে দিলেন পেলে!’ তবে আজীবন নিজেকে বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখা পেলে এ ভাবে কাঁদা–ছোড়াছুড়িতে যাননি, বিতর্কে তাঁর পাল্টা জবাবগুলো মূলত সীমাবদ্ধ ছিল খেলোয়াড় মারাদোনার খামতি আর তাঁর পূর্ণতার আলোচনায়।
তবুও ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তির অত গোল নিয়েও খোঁচা মারতে কখনো ছাড়েননি দিয়েগো। কটাক্ষের সুরে বলেছিলেন, ‘অত গোল কার বিরুদ্ধে করেছিলেন? বাড়ির উঠানে ভাইপোর বিরুদ্ধে?’ আসলে দিনের শেষে তুলনা অর্থহীন। নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে তুলনা সম্ভবত কখনও সম্ভবও হবে না। পেলে ও দিয়েগো তাই দিন শেষে নিজ নিজ সমর্থকদের চোখে অন্য রকম এক সম্মোহনের নাম। তবে একটা জায়গায় দুজনের বেশ মিল। নিজেকে সেরা বলায় কখনও ছাড় দেননি কেউই! মারাদোনা তো যুক্তির তর্কে মায়ের আবেগও টেনে এনেছিলেন। বলেছিলেন, ‘আমার মা বলেছে, আমিই সেরা, আর আমি আমার মায়ের কথা সব সময় বিশ্বাস করি।’
মারাদোনার কলকাতা সফর
সালটা ২০০৮। কলকাতা সফরে এসেছিলেন মারাদোনা। ফুটবলের শহর কলকাতাতেও যে তাঁর গুণমুগ্ধের সংখ্যা বিপুল, এর প্রমাণ মিলেছিল সে দিনের বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস-উন্মাদনায়। সফর চলাকালীন ১২ ডিসেম্বর দক্ষিণ ২৪ পরগনার মহেশতলায় একটি ফুটবল অ্যাকাডেমির উদ্বোধন করেছিলেন তিনি। অনুষ্ঠান শেষে সেবার মারাদোনার স্মৃতি হিসেবে একটি সিমেন্টের বেদির উপর তাঁর পায়ের ছাপ রেখে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু অযত্নে, অবহেলায় সেই স্মৃতি আজ উধাও। মারাদোনাকে প্রথমবার কলকাতা এবং মহেশতলায় আনার দায়িত্বে ছিলেন মূলত প্রাক্তন সিপিএম সাংসদ শমীক লাহিড়ী। আর অনুষ্ঠানের আয়োজনের দায়িত্ব ছিল একটি বেসরকারি সংস্থা। অনুষ্ঠানের পর মহেশতলা পুরসভার পক্ষ থেকে মারাদোনার হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল রুপোর তৈরি তাজমহল। কিন্তু সবটাই এখন কালের গর্ভে বিলীন। মারাদোনার পদার্পণের স্মৃতি বলতে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই মহেশতলায়।
এর পর ২০১৭ সালে ফের কলকাতায় পা রেখেছিলেন তিনি। সেবার তিন দিনের কলকাতা সফরে এসেছিলেন ফুটবলের রাজপুত্র। ১১ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় শহরে ফের পা রেখেছিলেন দিয়েগো ৷ সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় একাদশের বিরুদ্ধে একটি প্রদর্শনী ম্যাচ তো খেলার পাশাপাশি মারাদোনার একাধিক কর্মসূচী ছিল শহর জুড়ে ৷ শ্রীভূমি স্পোর্টিং ক্লাবে সংবর্ধনা এবং মোমের মূর্তি উদ্বোধনের মধ্যে দিয়েই কলকাতায় সফর শুরু হয়েছিল মারাদোনার ৷ দিয়েগোর হাতে তুলে দেওয়া হল সোনার ব্রেসলেট এবং রসগোল্লা।
ফুটবল রাজপুত্রের রহস্যজনক মৃত্যু
দিয়েগো মারাদোনার মৃত্যুর পর প্রায় তিন বছর কাটতে চলেছে। কিন্তু এখনও এই কিংবদন্তি ফুটবল তারকার মৃত্যুরহস্য নিয়ে চলছে জল্পনা। ঠিক কী ভাবে তিনি মারা গিয়েছেন, তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত। এই রহস্য খোলসা করার চেষ্টা থেকেই নির্মিত হল নতুন ওয়েবসিরিজ, যার নাম ‘হোয়াট কিলড মারাদোনা?’। হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে মাত্র ৬০ বছর বয়সে পৃথিবী ছেড়ে গিয়েছেন বিশ্বের ফুটবল রাজপুত্র। তাঁর মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই শুরু হয়ে গিয়েছে এই নিয়ে বিতর্ক। মারাদোনার ডাক্তার যেমন দাবি করেছিলেন, ফুটবলারের ঠিকমতো খেয়াল রাখা হয়নি। পাল্টা দাবি করা হয়েছে যে, মারাদোনার অসুস্থতার ব্যাপারে সঠিক তথ্য দেননি তাঁর ডাক্তাররা। এক কথায়, প্রত্যেকেই দায় এড়াতে চেয়েছেন। সঠিক তথ্যপ্রমাণের অভাবে আদালতও তদন্ত এগোতে পারেনি। নিজেদের মতো করে তদন্ত চালানোর চেষ্টা করেছিল আর্জেন্টিনার সংবাদমাধ্যমও। বেশিরভাগেরই দাবি, ড্রাগের প্রতি আসক্তি, অত্যধিক মদ্যপান এবং শরীরের উপর অত্যাচারই মারাদোনার মৃত্যুর জন্য দায়ী। ২০২০ সালের ২৫ নভেম্বর সেই হৃদরোগই থামিয়ে দিল মারাদোনার হৃদস্পন্দন। থেমে গেল বিশ্ব ফুটবলের একটা অধ্যায়। তবুও ফুটবলপ্রেমীদের স্মৃতি বরাবরের মতো থেকে গিয়েছেন সবার প্রিয় দিয়েগো।