পুজো প্রায় এসেই গেল৷ পাড়ায় পাড়ায় পুজোর বাদ্যি বেজে গিয়েছে৷ সনাতন জৌলুস না হারিয়েও স্বমহিমায় রয়ে গিয়েছে বাড়ির পুজোর ঐতিহ্য৷ এমনই কিছু বাছাই করা প্রাচীন বাড়ির পুজোর সুলুকসন্ধান নিয়ে হাজির sangbadpratidin.in৷ আজ রইল জলপাইগুড়ির নিয়োগী বাড়ির দুর্গাপুজোর কথা।
ব্রতদীপ ভট্টাচার্য: সেই কবেকার কথা। আজও একইরকম ঐতিহ্য বহন করে চলেছে বনেদি বাড়ির পুজো। কত না-জানা ইতিহাস কথা বলে পুজোর দালানে। কলকাতা, শহরতলি ও জেলায় ছড়িয়ে রয়েছে এমন বহু পুজো। প্রতিমার রং যেখানে অতসীফুলের মতো, মায়ের ডানপাশে সরস্বতী-গণেশ আর বামদিকে লক্ষ্মী ও কার্তিক থাকে, সেই নিয়োগী পরিবারের পুজোর গল্প আজ।
এ পুজোয় বলির ইতিহাস যুগ-যুগান্তরের। ইতিহাসের পাতা উলটে অতীতে গেলে আখ, চালকুমড়ো, পাঁঠা, মহিষ এমনকী, নরবলির রেওয়াজও পাওয়া যাবে। তবে দুর্গাপুজোয় ‘শত্রু বলি’! কলকাতা থেকে কয়েকশো কিলোমিটার দূরে জলপাইগুড়িতে প্রতিবছর শত্রুকে বলি দিয়ে-ই দেবীর পুজোর সূচনা হয় নিয়োগী পরিবারে।
[শের শাহের দান করা জমিতেই ঘোষাল বাড়িতে শুরু মায়ের পুজো]
একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে এই প্রথার কথা শুনে অবাক হওয়াই স্বাভাবিক। রাজা-রাজড়াদের আমলের সে নিয়ম এতদিনে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু ২০৯ বছর পরও হাতি ঘোড়া, সৈন্যসামন্তের সময়কালের ঐতিহাসিক সেই পরম্পরাকে করে বহন করে চলেছে নিয়োগীরা। তবে ‘শত্রু বলি’-র নিয়মকে সময়ের সঙ্গে অভিযোজন করেছেন তাঁরা। বর্তমানে শত্রু বলির প্রথা প্রতীকী রূপে পালিত হয় নিয়োগী বাড়িতে। কলাগাছের থোড় আর চালের গুঁড়ো দিয়ে মানুষের প্রতিরূপ বানিয়ে বলি দেওয়া হয় এই নিয়োগী বাড়িতে।
পরিবারের ইতিহাস অনুযায়ী, ১৮০৮ সালে বাংলাদেশের পাটগ্রামে এই বাড়ির পুজো শুরু হয়। ১৯৫২-তে নিয়োগীরা সপরিবারে বাংলাদেশ থেকে চলে আসে কলকাতায়। এরপর থেকে ভবানীপুরের প্রিয়নাথ মল্লিক লেনের বাড়িতেই শুরু মায়ের আরাধনা। পাঁচ বছর পর ১৯৬৭-তে প্রিয়নাথ মল্লিক লেনের বাড়ি ছেড়ে জলপাইগুড়ির কামারপাড়ার বাড়িতে পুজো স্থানান্তরিত হয়। কলকাতার ওই বাড়িতে অবশ্য আজও পুজো হয়। কিন্তু মূল পুজোটি হয় জলপাইগুড়ির বাড়িতেই। সেখানেই মহা আড়ম্বরের সঙ্গে ঐতিহ্যবাহী পারিবারিক পুজোটি পালন করেন নিয়োগী পরিবারের সদস্যরা।
পুজোর চারদিন পরিবারের সদস্য ও অতিথিদের ভিড়ে উপচে পড়ে নিয়োগী বাড়ির নাটমন্দিরে। সেখানেই দেবীর আরাধনা হয়। পুজো দেখতে পরিবারের সদস্যরা ছাড়াও নিয়োগী বাড়িতে ভিড় জমান এলাকাবাসী। তবে সব থেকে বেশি ভিড় হয় ‘শত্রু বলি’-র সময়। ২০০ বছর আগে এই পরম্পরায় সত্যিই শত্রুদের বলি দেওয়া হত কি না তার প্রমাণ বর্তমান প্রজন্মের নিয়োগীদের কাছে নেই। এখন শুধু সেই প্রথা প্রতীকী রূপেই পালন করা হয়।
কীভাবে দেওয়া হয় শত্রু বলি? নিয়োগী পরিবারের সূত্রে জানা যায়, এক হাত মাপের কলাগাছের থোড় কাটা হয়। সেটিকে এনে চালের গুঁড়ো দিয়ে একটি মানুষের আকৃতি তৈরি করা হয়। সেটাই নিয়োগী পরিবারের ‘শত্রু’। এরপর সেই শত্রুর একগালে কালি মাখানো হয়। চুন, হলুদ দিয়ে রক্তের রং দেওয়া হয়। তারপর সেটি হাড়িকাঠে তুলে উলুধ্বনি, শঙ্খধ্বনি দেন পরিবারের বধূরা। দেবীর সামনে তারপর সেটিকে বলি দেওয়া হয়। বলির পর থোড়রূপী সেই শত্রুকে দু’খণ্ড করেন পরিবারের লোকেরা। তারপর সেটিকে বাড়ির বাইরে ছুড়ে ফেলে দেওয়া হয়।
[অভাবের সংসারে স্বপ্নাদেশ, তিন দশক পর মাতৃ আরাধনা শুরু পাল পরিবারে]
নিয়োগী পরিবারের পুজোয় শুধু শত্রু বলি-ই বিশেষ নয়। এই পরিবারের দেবীর রূপও অন্যদের থেকে আলাদা। এই বাড়ির প্রতিমার রং অন্য প্রতিমার চেয়ে আলাদা। বাড়ির দুর্গা প্রতিমার রং অতসী ফুলের মতো। মা দুর্গার ডানপাশে থাকে সরস্বতী ও গণেশ, বামদিকে লক্ষ্মী ও কার্তিক। মহালয়ার পরের দিন প্রতিপদে ঠাকুর দালানে ঘট বসে যায়। পঞ্চমীতে মনসা পুজো হয়। সপ্তমী, অষ্টমীতে সন্ধিপুজোর সময় কালীপুজোও করা হয়। আগে কলকাতা থেকে শিল্পীরা জলপাইগুড়িতে আসতেন। কলকাতার শিল্পীদের হাতেই গড়ে উঠত নিয়োগী বাড়ির দুর্গা। তবে এখন স্থানীয় প্রতিমা শিল্পীরাই এই বাড়ির প্রতিমা তৈরি করেন। পুজোর ভোগের পাশাপাশি দেবীকে নিয়োগী বাড়িতে তৈরি নাড়ু, মিষ্টি, মোয়া, পায়েস অর্পণ করেন পরিবারের বধূরা। পুরনো ঐতিহ্যকে এখনও ধরে রেখে নিয়োগী সেই পরম্পরা মেনে করে চলেছেন দেবীর আরাধনা। বদলেছে অনেক কিছুই, কিন্তু এখনও এই পরিবারের পুজোয় সেই পুরনো রীতিনীতি।
[ঘটের বদলে মূর্তি গড়ে দুর্গা আরাধনায় মাতে মহিষাদলের রায়বাড়ি]
The post শত্রুকে বলি দিয়েই এই পরিবারে পুজোর সূচনা হয় appeared first on Sangbad Pratidin.
