পলাশ পাত্র, তেহট্ট: রবীন্দ্র ভাবধারার কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচি তাঁদের যমশেরপুরের জমিদার বাড়িতে বসেই ‘কাজলা দিদি’ কবিতাটি লিখেছিলেন – বাঁশ বাগানের মাথার ওপর/চাঁদ উঠেছে ওই। পরবর্তীকালে প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠে তা বিখ্যাত ও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
[আরও পড়ুন: রুষ্ট হয়েছিলেন দেবী, বন্ধ হয়েও ফের শুরু হয় হাসনাবাদের খাঁড়া পরিবারের পুজো]
কবির সেই যমশেরপুরের বাড়িতে জমিদারির পাট কবে চুকে গিয়েছে। তাতে অবশ্য নদিয়ার তেহট্টের বাগচি বাড়ির পুজোয় ভাঁটা পড়েনি। নিষ্ঠা আর আন্তরিকতায় সীমান্ত লাগোয়া জেলার এই পুজো ঘিরে দুই বাংলার মানুষ এক হয়ে যান। মহালয়ার পরে এখন সেই বাড়িতে দেবী আরাধনার প্রস্তুতি তুঙ্গে।
যমশেরপুর জমিদার বাড়িতে সাবেকি ঘরানার একচালার দেবীর গায়ের রং হালকা হলুদ। এখানে দেবী দুর্গার বাহন সিংহের রং সাদা, অসুর সবুজ, গণেশ গোলাপি ও কার্ত্তিক মায়ের মতো হালকা হলুদ রঙের। ডাকের সাজে সজ্জিত দেবী মাতৃমুখী। জানা যায়, বাগচি বাড়ির পুজোর প্রতিষ্ঠাতা রামভদ্র হোগলবেড়িয়ার সুন্দলপুরের জামাই ছিলেন। বাংলার ১০৫৩ সালে রাম ভদ্র বাগচি সুন্দলপুরে আসেন। যমশেরপুরে তখন জঙ্গল ছিল। এলাকায় কোনও ব্রাহ্মণের বসবাস ছিল না তখন। ঘোষেরা রামভদ্রকে গুরু করে যমশেরপুরে আনেন। বাগচিরা অনেক আগেই ঢাকা থেকে সুন্দলপুরে বসতি গড়ে তুলেছিলেন৷ বিশাল জমি অধিগ্রহণ করে তাঁরা কালক্রমে জমিদার হয়ে ওঠেন।
এই সময় রামভদ্র দুর্গাপুজো শুরু করেন। প্রথম পুজো ঘটে হয়। নদিয়ার গবেষক মোহিত রায়ের ‘রূপে রূপে দুর্গা’ গ্রন্থটি থেকে জানা যায়, যমশেরপুরের জমিদার বাড়ির স্বর্ণালংকার ভূষিতা দুর্গার মাটির মূর্তির লোকায়ত নাম – কনকদুর্গা। একসময় দেবীকে কয়েকশো ভরি সোনার গয়না পরানো হত৷ পরে অবশ্য ডাকাতির ভয়ে এত বিপুল অলংকার পরানো বন্ধ হয়ে যায়৷
তৎকালীন সময়ে রবীন্দ্র ভাবধারার শক্তিশালী কবি ছিলেন যতীন্দ্রমোহন বাগচি। একসময় এই জমিদার বাড়িতে বসেই তিনি লেখালিখি করতেন৷ এখানকার সুন্দর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখেই তিনি ‘কাজলা দিদি’ কবিতাটি রচনা করেছিলেন, এমনই মনে করে থাকেন বাংলা কবিতা গবেষকদের একাংশ। আজও দুর্গা মন্দির থেকে বাগানের মধ্যে দিয়ে চাঁদ দেখা যায়৷ গানের বিখ্যাত সেই দিঘিও রয়েছে।
এখনও পুজোকে কেন্দ্র করে দেশে-বিদেশে থাকা বাগচি পরিবারের সদস্যরা এই জমিদার বাড়িতে মিলিত হয়। এই পুজোর কটা দিন দেবীকে নিরামিষ ভোগ দেওয়া হয়৷ খিচুড়ি, পোলাও, লুচি, বোঁদে, মিষ্টি, পাঁচরকমের ভাজা, তরকারি ভোগ দেওয়া হয়৷ দশমীর দিন পান্তা ভাত, কচুর শাক ও ইলিশ মাছ খাওয়া হয়৷ সন্ধিপুজোর দিন নারকেল পায়েস ও সমস্ত সবজি মিশিয়ে রসাঝোলের খ্যাতি রয়েছে। বৈষ্ণবমতে পুজো হওয়ায় প্রথম থেকেই পশুবলি হয় না এখানে। একসময় গোটা গ্রামের মানুষ প্রসাদ পেতেন৷ এখন সামর্থ্য কুলোয় না। তবে, যাঁরা আসেন, তাঁরা প্রসাদ না খেয়ে যান না।
[আরও পড়ুন: এক টুকরো রাজস্থান উঠে এল মুম্বইয়ের পুজো মণ্ডপে]
এই প্রজন্মের পুজো কর্তাদের সদস্য পথক্লান্ত বাগচি বলেন, ‘আগের মতোই নিয়মনীতির সঙ্গে পুজোটা করা হয়। বাড়ির সকল আত্মীয়স্বজনরা মিলিত হন। পুজোতে একসময় স্বদেশিরা অন্ধকারে আমাদের বাড়িতে আসতেন। আবার ভোর হওয়ার আগে চলে যেতেন। প্রথম পুজোটা ঘটে শুরু হয়েছিল। পরে সদস্য সংখ্যা বেড়ে গেলে মাটির প্রতিমা গড়ে পুজো করা হয়। অনেক বিখ্যাত মানুষই পুজোতে আসতেন।’ কাঁটাতারের ওপার থেকেও মানুষ ভক্তি, শ্রদ্ধার টানে কনকদুর্গাকে দেখতে, পুজো দিতে আসেন। দশমীর দিন রীতি মেনে দেবীকে কালীতলার বিলে বিসর্জন দেওয়া হয়৷
The post কনকদুর্গা বরণের প্রস্তুতি, সাজছে ‘কাজলা দিদি’ খ্যাত নদিয়ার যমশেরপুর জমিদার বাড়ি appeared first on Sangbad Pratidin.
