সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: উন্নতমানের ডিগ্রি, ভালো কর্মসংস্থানের সুযোগ এবং ইউরোপে ভবিষ্যৎ গড়ার আশায় শত শত ভারতীয় পড়ুয়া জার্মানিতে (Indian Students In Germany) পাড়ি দিয়েছিলেন। কিন্তু বার্লিনের ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বা আইইউ-তে পড়তে গিয়ে সেই স্বপ্ন এখন অনেকের কাছেই দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে।
ইউরোনিউজ’-এর এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, বিপুল অঙ্কের টিউশন ফি ও শিক্ষাঋণ নিয়ে জার্মানিতে যাওয়া বহু ভারতীয় ছাত্রছাত্রীকে দেশ ছাড়ার নোটিস দেওয়া হচ্ছে। অভিযোগ, তাঁরা কোনও আইন ভাঙেননি, কিন্তু তাঁদের বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্সগুলিকে অভিবাসন দপ্তর নতুন করে ব্যাখ্যা করায় ভিসা সংক্রান্ত জটিলতা তৈরি হয়েছে। ডিসার্টেশন বা শেষ পর্যায়ের পড়াশোনায় মন দেওয়ার বদলে এখন এই পড়ুয়াদের বড় অংশই ব্যস্ত কীভাবে হঠাৎ করে তাঁদের আইনি অবস্থান অনিশ্চিত হয়ে পড়ল, তা বোঝার চেষ্টায়। সমস্যার কেন্দ্রে রয়েছে হাইব্রিড ও অনলাইন কোর্স নিয়ে বিভ্রান্তি। পড়ুয়াদের অভিযোগ, তাঁদের যে কোর্সে ভর্তি করা হয়েছিল, তা পূর্ণাঙ্গ ক্যাম্পাসভিত্তিক বলেই দেখানো হয়েছিল। কিন্তু এখন জার্মান অভিবাসন কর্তৃপক্ষ প্রশ্ন তুলছে, এই কোর্সগুলি আদৌ মুখোমুখি উপস্থিতির শর্ত পূরণ করে কি না।
ইউনিভার্সিটি লিভিং-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও সিওও ময়ঙ্ক মাহেশ্বরীর মতে, এই ধরনের পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক শিক্ষাব্যবস্থার জটিলতাগুলি প্রকাশ করে দিয়েছে। তিনি বলেন, পড়ুয়ারা ভর্তি হওয়ার সময় কোর্সের কাঠামো, পড়ানোর পদ্ধতি এবং বিশ্ববিদ্যালয় ও মধ্যস্থতাকারীদের দেওয়া তথ্যের উপর ভরসা করেই জীবনের বড় সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু পড়াশোনার মাঝপথে নিয়মের ব্যাখ্যা বদলে গেলে বা নতুনভাবে প্রয়োগ হলে, স্পষ্ট দিশা ও রূপান্তরের ব্যবস্থা না থাকলে সৎ উদ্দেশ্যে কাজ করা পড়ুয়ারাই সবচেয়ে বেশি অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েন।
এই সংকটের প্রভাব মারাত্মক। অনেক ভারতীয় পড়ুয়া ২০ হাজার ইউরোরও বেশি বিনিয়োগ করেছেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভারতে নেওয়া শিক্ষাঋণের মাধ্যমে। এখন তাঁদের বলা হচ্ছে, পড়াশোনা শেষ করতে হলে হয়তো জার্মানিতে না থেকে ভারত থেকেই অনলাইনে কোর্স সম্পূর্ণ করতে হবে, যদিও ভর্তি হওয়ার সময় অন-ক্যাম্পাস শিক্ষার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। মাহেশ্বরী কোনও একক প্রতিষ্ঠান বা কর্তৃপক্ষকে দায়ী না করে বলেন, আন্তর্জাতিক শিক্ষাব্যবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়, মধ্যস্থতাকারী সংস্থা ও অভিবাসন দপ্তর—সবাই আলাদা দায়িত্ব নিয়ে কাজ করে। এই ব্যবস্থাগুলি একে অপরের সঙ্গে সামঞ্জস্য না হলে পড়ুয়ারাই সেই ফাঁকের মধ্যে পড়ে যান।
এই ঘটনা ভারতীয় পরিবারগুলির কাছেও এক বড় সতর্কবার্তা বলে মনে করা হচ্ছে। তুলনামূলকভাবে সাশ্রয়ী ও স্বচ্ছ গন্তব্য হিসাবে জার্মানির উপর দীর্ঘদিন ধরেই ভারতীয় পড়ুয়াদের আস্থা ছিল। কিন্তু এই ধরনের ঘটনা সেই বিশ্বাসে চিড় ধরাতে পারে। মাহেশ্বরীর মতে, শুধুমাত্র ভর্তি ও ফি দেওয়াই যথেষ্ট নয়, কোর্সের স্বীকৃতি, পড়াশোনার পদ্ধতি, উপস্থিতির নিয়ম এবং ভিসার যোগ্যতা—সব কিছুই বর্তমান ও সরকারি সূত্র থেকে যাচাই করা জরুরি। এই সংকট আরও একটি বড় সমস্যার দিকেও ইঙ্গিত দিচ্ছে। বিশ্বজুড়ে হাইব্রিড ও নমনীয় শিক্ষামডেল দ্রুত জনপ্রিয় হচ্ছে, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই ভিসা ও অভিবাসন সংক্রান্ত নিয়ম সেই পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না। ফলে পড়ুয়ারা আইনি ও প্রশাসনিক জটিলতার শিকার হচ্ছেন। বর্তমানে বার্লিনে বহু ভারতীয় পড়ুয়া আইনিভাবে দেশে অবস্থান করলেও তাঁদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত, তাঁরা আদৌ ডিগ্রি শেষ করতে পারবেন কি না, সেই প্রশ্নই এখন সবচেয়ে বড়। আন্তর্জাতিক শিক্ষার ভিত্তি বিশ্বাস ও পূর্বানুমেয়তার উপর দাঁড়িয়ে, আর সেই বিশ্বাস নড়বড়ে হয়ে গেলে তার প্রভাব শুধু একটি বিশ্ববিদ্যালয় বা একটি শহরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না।
