সুরজিৎ দেব, ডায়মন্ড হারবার: কোনও নাড়ির টান ছিল না। তবু ওঁরাই ছিলেন রূপসার আত্মার আত্মীয়। ওঁরা মানে ডায়মন্ডহারবার মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের এসএনসিইউ বিভাগের ডাক্তার, নার্স ও কর্মীরা। কন্যাসন্তান৷ তাই প্রসবের পরেই দুধের শিশুকে হাসপাতালে ফেলে রেখে গিয়েছিল মা-বাবা আর পরিজনেরা।
তারপর কেটে গেছে দু’শো ঊনিশটা দিন। স্নেহ, মায়া আর মমতায় এ ক’দিন হাসপাতালেই কেটেছে ছোট্ট রূপসার। এ ক’দিনেই সে বড় আপনজন হয়ে উঠেছিল ওঁদের সকলের। শুক্রবার সেই রূপসাই তাঁদের সকলকে কাঁদিয়ে বিদায় নিল হাসপাতাল থেকে। সরকারি আধিকারিকের কোলে চেপে চলল নতুন ঠিকানায়, নতুন আশ্রয়ের খোঁজে।
[ আরও পড়ুন: মুখ্যমন্ত্রীর বৈঠকে ‘বিদ্রোহী’ সব্যসাচী, জলাজমি ভরাটের প্রসঙ্গ তুলে মমতার দৃষ্টি আকর্ষণ ]
সরকারি নির্দেশটা এসেছিল বৃহস্পতিবারই। সরকারি নিয়ম মেনে রূপসাকে পাঠাতে হবে কোনও সরকারি হোমে। সেই নির্দেশ হাতে পেয়েই মনখারাপ ডাক্তার, নার্স আর কর্মীদের। ২১৯টা দিন। নেহাতই কম সময়। তবু এর মধ্যেই তো রূপসাকে বড় আপন করে নিয়েছিলেন ওঁরা সবাই। আদর করে নাম রেখেছিলেন রূপসা। ঘটা করে হাসপাতালেই দেওয়া হয়েছে মুখেভাত। কত উপহার দেওয়া হয়েছে তাকে। কখনও ডাক্তারবাবু আবার কখনও নার্স বা অন্য কর্মীদের কোলে চড়ে ঘুরে বেড়িয়েছে সে। সময় মেনে গা স্পঞ্জ করে দেওয়া, খাওয়াদাওয়া, ওষুধ খাওয়ানো কত পরিচর্যাই না হয়েছে ওর। এককথায় ডাক্তার, নার্স আর কর্মীদের পরম আদরে এসএনসিইউতেই বেড়ে উঠছিল ছোট্ট রূপসা। হঠাৎই ছন্দপতন।
শুক্রবার সকাল থেকেই তোড়জোড় চলছিল রূপসাকে হোমে পাঠানোর। রূপসাকে নিয়ে যেতে হাসপাতালে তখন হাজির সরকারি আধিকারিক, পুলিশ প্রশাসন, চাইল্ড লাইনের কর্মীরা। সুন্দর করে ওকে সাজিয়ে দিলেন নার্স আর কর্মীরা। কোলে নিয়ে চলল শেষবারের মত আদরের পর্বও। এক আশ্রয় ছেড়ে যে অন্য আশ্রয়ে চলে যেতে হচ্ছে তা বোধহয় বুঝেছিল রূপসাও। শুরু করে দেয় কান্নাকাটি। এক এক করে যারই কোলে চড়ে, তার হাতের আঙুলগুলো আঁকড়ে ধরে সে। যেন বলতে চায়, “তোমাদের ছেড়ে যাব না আমি।”
এসএনসিইউ ইনচার্জ ও শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ড: মাসুদ মণ্ডল তো বলেই ফেললেন, “এ ক’দিনেই বড় ভালবেসে ফেলেছিলাম ওকে। ছাড়তে কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু কী করব, সরকারি নিয়মে ছাড়তে তো হবেই।” মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের সুপারিন্টেডেন্ট ও ভাইস-প্রিন্সিপ্যাল ড: প্রফেসর রামপ্রসাদ রায় বলেন, “সত্যিই খুব খারাপ লাগছে মেয়েটাকে ছাড়তে। কিন্তু উপায়ও যে নেই।” এসএনসিইউ বিভাগের অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপার শুচিস্মিতা দাস, হাসপাতালের অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপার সুপ্রীম সাহা প্রত্যেকেই জানালেন, “একদিন ছাড়তে ওকে হবে জানতামই, কিন্তু এত তাড়াতাড়ি যে ওকে ছেড়ে দিতে হবে ভাবিনি।”
[ আরও পড়ুন: ‘চাইলেই সব মিলবে না, সরকারের টাকার অবস্থা ভাল নয়’, কড়া মন্তব্য মমতার ]
যেতে দিতে মন চায় না। তবু যেতে দিতেই হল রূপসাকে। শুক্রবার অতিরিক্ত জেলাশাসকের নির্দেশ মেনে পুলিশ প্রশাসনকে সাক্ষী রেখে সাতমাসের ছোট্ট রূপসাকে চাইল্ড লাইন কো-অর্ডিনেটর দেবারতি সরকারের মাধ্যমে দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার শিশু সুরক্ষা দপ্তরের প্রোটেকশন অফিসার লুৎফুন্নেসা বেগমের হাতে তুলে দেওয়া হয়। নিজের অনুভূতি বর্ণনা করতে গিয়ে দেবারতি সরকার বলেন, “ভীষণ বেদনাদায়ক এ ছবি। সমাজের এই ব্যাধি বড়ই কষ্টের। এত আধুনিক হচ্ছি আমরা, অথচ এখনও মেয়ে মানেই সমাজের বোঝা কেন হবে। এ ব্যাধি তাড়াতে আরও সামাজিক সচেতনতার প্রয়োজন।”
রূপসাকে নিয়ে আপাতত রাখা হয়েছে গড়িয়ায় আধা সরকারি একটি হোমে। আগামী সোমবার তাকে চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটির হাতে তুলে দেওয়া হবে। শিশুটির বাবা-মায়ের যে ফোন নম্বর রয়েছে তার মাধ্যমে তাঁদের ডেকে কাউন্সেলিং করার পরও যদি তাঁরা শিশুটির দায়িত্ব নিতে রাজি না হন তখন কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে রূপসার দায়িত্ব নেওয়ার আবেদন জানানো হবে সরকারি তরফে। যেসব দম্পতি অনলাইনে সে আবেদনে সাড়া দেবেন তাঁদের পরিবার সম্পর্কে আগাগোড়া যাচাই করে তবেই কোনও এক দম্পতির হাতে কন্যাস্নেহে পালন করার জন্য সরকারিভাবে তুলে দেওয়া হবে রূপসাকে। না হলে সরকারি হোমই হবে ছোট্ট মেয়েটির ভবিষ্যৎ ঠিকানা। বাবা-মা বর্তমান থাকা সত্ত্বেও রূপসার ভাগ্য তাই ঝুলেই রইল সরু সুতোর বাঁধনে।
The post বছর খানেক পর নতুন ঠিকানায় ছোট্ট রূপসা, চোখের জলে বিদায় নার্সদের appeared first on Sangbad Pratidin.
