কিংশুক প্রামাণিক: জানুয়ারি থেকে জুন, মাত্র ছ’মাসে হাতির হানায় জঙ্গলমহলে ১৪ জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন শুনেই ক্ষোভে ফেটে পড়লেন মুখ্যমন্ত্রী৷ ঝাড়গ্রামের পুলিশ সুপার অফিসের অডিটোরিয়ামের প্রশাসনিক বৈঠকে তখন পিন পড়লে শব্দ হবে৷ মঞ্চে মুখ্যসচিব-সহ মন্ত্রীরা, পিছনে বিভিন্ন বিভাগের প্রধান সচিব আর সামনে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনিক কর্তারা৷ বন দফতরের প্রধান সচিব চন্দন সিনহা ও জেলার বনকর্তাদের উদ্দেশ্য করেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবার বললেন, “কী ভেবেছেন আপনারা? মানুষের জীবনের দাম নেই? বারবার বলা সত্ত্বেও আপনারা কোনও ব্যবস্থা নেননি৷ কীভাবে হাতি ঢুকে পড়ছে গ্রামাঞ্চলে, শস্য নষ্ট করছে, মানুষ মারছে, দু’লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দিলেই সব মিটে যায়?” এর পর মুখ্যমন্ত্রী আরও বলেন, “আমি হাতির বিরুদ্ধে নই৷ কিন্তু মানুষ মরছে বলেই বলছি, এই গাফিলতি আর বরদাস্ত করব না৷ এখানে শুধু এনজয় করাই হয়৷ কাজের কাজ কিছু হয় না৷” মুখ্যমন্ত্রীর অগ্নিশর্মা মূর্তি দেখে সবাই তখন বাকরুদ্ধ৷ বন দফতরের সচিব কিছু বলতে গেলেন৷ তাঁকে থামিয়ে দিয়েই মুখ্যমন্ত্রী মুখ্যসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়কে বললেন, “আপনি দেখুন৷ গোটা ডিপার্টমেণ্ট ঢেলে সাজান৷ আমি খুব বিরক্ত৷ আর যেন এমন ঘটনা না ঘটে৷”
একটু বর্ণনা দিই৷ শুরুতেই মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “নির্বাচনের জন্য চার-পাঁচ মাস কাজ বন্ধ ছিল৷ মনে রাখবেন আমরা পরীক্ষার সময় কী করি? একটু বেশি পড়াশোনা করি৷ উপবাস করলে উপবাস ভাঙার পর একটু বেশি খাই৷ এখন আপনাদের তাই-ই করতে হবে৷ অর্থাৎ পাঁচ মাসের বকেয়া কাজ দ্রুত শেষ করতে হবে৷ সময় তো আর বসে থাকবে না৷” এর পরই সিদ্ধান্ত, এখন থেকে জেলা ব্লক স্তর পর্যন্তও থাকবে অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ক্যালেন্ডার৷ সিএমও-ডিএমও-বিডিও, এই তিন স্তরকে এক করে হবে উন্নয়নের কাজ৷ আর বন দফতরের কোনও অফিসারের বদলি হলে অন্য জন দায়িত্ব নিয়ে যেন অসুবিধায় না পড়ে৷ সব কাজের রেকর্ড তাই রাখতে হবে৷ প্রশাসনিক কর্তাদের মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “কী কী কাজ করেছেন আর কী কী কাজ করবেন, তা সরকারের দেওয়া ডাইরিতে লিখে রাখুন৷ এতে আপনাদের কাজের সুবিধা হবে৷”
অগ্রাধিকার কোন কোন প্রকল্পে? মুখ্যমন্ত্রী এক এক করে ধরেন প্রত্যেকটি বিষয়৷ প্রথমেই বলেন, “এখন প্রধান লক্ষ্য খাদ্যসাথী প্রকল্প এগিয়ে নিয়ে যাওয়া৷ একজনও গরিব মানুষ যেন এই প্রকল্পের বাইরে না থাকে৷ ডিজিটাল রেশন কার্ডের কাজ দ্রুত শেষ করতে হবে৷ আদিবাসীদের জন্য আলাদা রঙের কার্ড করতে হবে৷ পাড়ার ক্লাবগুলিকে এই ধরনের সামাজিক প্রকল্পে ইনভলভ করতে হবে৷” এর পর মমতা আসেন একশো দিনের কাজ নিয়ে৷ জেলার ডিএম জগদীশ প্রসাদ মিনা যে তথ্য দেন, তাতে অভিভূত মুখ্যমন্ত্রী৷ তাতে দেখা যায় যে, ১৬২ শতাংশ সাফল্য এসেছে এই জেলায়৷ দিনের হিসাবে ৫৪, ন্যাশনাল অ্যাভারেজ সেখানে ৪৭ দিন৷ এক সময়ে সন্ত্রাসের আগুনে পুড়ত কেশপুর৷ আজ সেখানে একশো দিনের কাজে সাফল্য ২৩১ শতাংশ৷ ডেবরা, নারায়ণগড়, দাসপুর–সবই দুশোর উপরে৷ বাকি ব্লকগুলিও পিছিয়ে নেই৷ মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেন, “যারা দুশো অতিক্রম করেছে, তাদের পুরস্কার দেওয়া হবে৷”
গ্রামাঞ্চলের উন্নয়নে অগ্রাধিকার, বাংলার সাফল্য কোথায়, তা তুলে ধরতে মুখ্যমন্ত্রী এর পর জানান, রাজ্যে একটি পঞ্চায়েতি রাজ সম্মেলন হবে৷ ১৮, ১৯ আগস্ট, কলকাতার নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামের ওই সম্মেলনে দিল্লির সচিব পর্যায়ের অফিসাররাও আসবেন৷ এর পরের প্রসঙ্গ স্কুল৷ কোন গ্রামে স্কুল দরকার, কোথায় ছাত্ররা জুতো পেয়েছে কি না, সব খবর তাঁর চাই৷ অফিসারদের বলেন, “মিড-ডে মিল ঠিকঠাক দেওয়া হচেছ কি না, তা নিশ্চিত করতে মাঝে মাঝেই সারপ্রাইজ ভিজিট করুন স্কুলে৷ খাবার খেয়ে দেখুন৷” এর পর সেচ ও কৃষি৷ সামনে বর্ষা৷ কংসাবতী, সুবর্ণরেখা ইত্যাদির জলাধারের জল যাতে নিয়ন্ত্রণে থাকে, তা নিয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেন সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দোপাধ্যায়কে৷ ঘাটাল মাস্টারপ্ল্যান, কেলেঘাই-কপালেশ্বরী প্রকল্প কোন পর্যায়ে তার খবর নেন৷ পরিবহণের কী প্রয়োজন, সে সম্পর্কে মন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারীকে নির্দেশ দেন৷ একইভাবে পূর্তমন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসকেও প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেন৷ মুখ্যমন্ত্রী এদিন বৈঠকে জানান যে রাজ্যে এখন থেকে মুরগির মতো হাঁসের পোলট্রিও বাড়াতে হবে৷ হাঁসের ডিমের উৎপাদনও দরকার৷
সর্বোপরি, আইন-শৃঙ্খলা৷ স্বরাষ্ট্রসচিব মলয় দে, ডিজি সুরজিৎ করপুরকায়স্থ, পুলিশ সুপার ভারতী ঘোষ থেকে শুরু করে ব্লক লেভেলের পুলিশ অফিসার সবাইকে মুখ্যমন্ত্রী নির্দেশ দেন, “জেলায় শান্তি বজায় রাখতে হবে৷ নানা প্ররোচনা থাকতে পারে৷ কিন্তু শান্তি বজায় রাখতে হবে উন্নয়নের স্বার্থেই৷” বস্তুত, অগ্নিগর্ভ পশ্চিম মেদিনীপুরে উন্নয়নকে পাথেয় করেই শান্তি ফিরিয়েছিলেন মমতা৷ আজ তিনি সেই শান্তি আর কোনওভাবেই নষ্ট হতে দিতে রাজি নন৷ তা এদিনের প্রশাসনিক বৈঠকে স্পষ্ট বুঝিয়ে দেন মুখ্যমন্ত্রী৷
The post বন দফতর নিয়ে ‘এনজয়’ নয়, স্পষ্ট বার্তা মুখ্যমন্ত্রীর appeared first on Sangbad Pratidin.
