'চুম্বন দৃশ্যের রেশ থেকে যায় নরম দুঃখের মতো', জাতীয় পুরস্কারের ছবি 'ডিপ ফ্রিজ'-এর পরিচালক অর্জুন দত্তের মুখোমুখি শম্পালী মৌলিক।
সদ্য দাদাকে হারালেন আপনি। বাড়িতে একের পর এক বিপর্যয়, তার মধ্যে নিজের ছবি ‘ডিপ ফ্রিজ’ মুক্তি আজ। কীভাবে সামলাচ্ছেন?
...জানি না কী করে সামলাচ্ছি। মনে হয় মা-ই ওপর থেকে আমাকে সামলে দিচ্ছে। আমি জাস্ট আছি। দাদার সঙ্গে ছোটবেলা থেকে একসঙ্গে বড় হয়েছি। প্রচণ্ড ভালোবাসত দাদা আমাকে। আমার প্রথম ভালো ঘড়ি, প্রথম মোবাইল ফোন সব দাদার দেওয়া। ইনফ্যাক্ট আমার এস্থেটিক সেন্স তৈরি হওয়ার নেপথ্যেও মা আর দাদা। দাদা এক সময় শেফ কিংবা ফ্যাশন ডিজাইনার হতে চেয়েছিল। কিন্তু বাড়ির কারণে হয়ে ওঠেনি, যেমন আমাদের মতো মধ্যবিত্ত পরিবারে হয়। আমি যখন ছবি করব বলে ঠিক করি, বিষয়টা ছাড়পত্র পেয়ে যায়। আমি ওর থেকে সাত বছরের ছোট। ফলে আমার বড় হওয়ার সময়ে দৃষ্টিভঙ্গিটা কিছুটা বদলে গিয়েছিল। সারা জীবনই মা-আর দাদাকে মিস করব।
রিলিজের আগে যখন একটা ছবি জাতীয় পুরস্কার পেয়ে যায়। বাড়তি প্রত্যাশা তৈরি হয়। সেটা ভাবাচ্ছে?
... এখানে উল্টো জাতীয় পুরস্কার মানেই লোকে ভাবতে পারে গুরুগম্ভীর ভারী ছবি। তা কিন্তু একেবারেই নয়। সব সাক্ষাৎকারেই আমি বলছি। একটা সিনেমা নিয়ে যেন কথা হয় এবং সমাজের প্রতিচ্ছবি উঠে আসে– আমার কাছে সেটাই ছবি। ‘ডিপ ফ্রিজ’ আজকের আধুনিক সমাজের ছবিটই তুলে ধরবে। ছবি-করিয়ের তো কিছু দায়িত্ব থাকে, সে অর্থে এই ফিল্ম খুবই প্রোগ্রেসিভ। ছবিটা গম্ভীর নয় বরং এন্টারটেনিং।
‘ডিপ ফ্রিজ’ কথাটার সঙ্গে খুব ঠান্ডা অনুভব জড়িয়ে। সম্পর্কের শৈত্য নিয়েই চিত্রনাট্য?
... একদম, এই জন্যই ছবির নাম ‘ডিপ ফ্রিজ’। রূপক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। অনেক মান-অভিমান-রাগ-দুঃখ জমে থাকে ডিপ ফ্রিজে। ওটা আদৌ গলবে কি গলবে না, সময় বলবে। ছবিটা তাই দেখায়।
বিষয় নির্বাচন কীভাবে? নিজের দেখা কোনও ঘটনা কি প্রভাবিত করেছে?
... আমি খুব ঘনিষ্ঠবৃত্তে বিবাহ বিচ্ছেদ দেখেছি। তখন আমি ভাবতাম, একটা কাগজে সই করে দিলেই কি সব শেষ হয়ে যায়? কিছু কি থেকে যায় না? আর আধুনিক সময়ে বিষয়টার সঙ্গে মানুষ রিলেট করবে। আমি নিজেও সম্পর্কের কথা বলতে পছন্দ করি।
শুনেছি আবির চট্টোপাধ্যায় নাকি প্রথম কাজটা করতে চাননি?
...প্রথম দিকে আবিরদার ডেট নিয়ে সমস্যা ছিল। একটু সন্দিহান ছিল যে, করবে কি করবে না। আবিরদার চরিত্রটা ছবিতে মরালি খুব আপরাইট নয়। এই ছবিতে নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। তবে সেটা আমি দর্শকের ওপরেই ছেড়েছি। কে ঠিক, কে ভুল দর্শক সিদ্ধান্ত নিক। চরিত্রটা ইমমরাল নয়, তবে আলোচনা হবে মনে হয়। আবিরদার সঙ্গে এটা নিয়ে কথাও হয়েছে অনেক। একটা মানুষকে কেবলমাত্র সাদা-কালোর ভিত্তিতে বিচার করা যায় না। আবিরদার স্ত্রী নন্দিনীদিকে ধন্যবাদ এ জন্য। আবিরদার দ্বিধা থাকা সত্ত্বেও নন্দিনী দি আবিরদাকে বলেছিল কাজটা করতে। জোর দিয়ে বলতে পারি, আবিরদার কেরিয়ারের সেরা ছবি ‘ডিপ ফ্রিজ’। হয়তো আমি বায়াসড (হাসি)।
আপনার ‘অব্যক্ত’ এর আগে বিভিন্ন উৎসবে প্রশংসিত। ‘ডিপ ফ্রিজ’ ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ডে অনেক ভারী নামের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ছিল। সেখানে আপনি অপেক্ষাকৃত নবীন পরিচালক হিসেবে সেরার সম্মান অর্জন করেন।
...সত্যিই ওঁদের তুলনায় আমি নবীন এবং অভিজ্ঞতাও কম। এই প্রাপ্তি আনন্দের। তবে খবরটা শুনে আমি অত্যন্ত নার্ভাস হয়ে গিয়েছিলাম। হয়তো ঠিক পথেই যাচ্ছি। মা চলে যাওয়ার পর ডিপ্রেশনে চলে গিয়েছিলাম। তারপরে দাদার অসুস্থতা। ছবিটা স্বীকৃতি পেল, অদ্ভূতভাবে ছবি রিলিজের তিন-চারদিন আগে দাদাকেও নিয়ে নিল। ‘ডিপ ফ্রিজ’ ছবিটা আদতে চলে যেতে দেওয়ার। আমাকে যেন ‘লেট গো’ করতে শিখিয়ে দিল এই ছবি। আমার জীবনের দু’জন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি চলে গেল এই সময়। কখনও মনে হচ্ছে রিল আর রিয়্যাল মিশে গেল এই ছবিটার ক্ষেত্রে। অদ্ভূত লাগছে।
পুরস্কার পাওয়া আর দর্শক দেখা দুটো আলাদা বিষয়।
... ছবিটা খুব স্মার্ট, আজকের দিনের গল্প। নাটকীয়তা নেই। আবিরদা, তনুশ্রী, অনুরাধা, শোয়েব সকলে দারুণ কাজ করেছে।
আবির আর তনুশ্রী চক্রবর্তীর একটা গভীর চুম্বনদৃশ্য আছে। সচরাচর আবিরকে এমন দৃশ্যে দেখা যায় না।
...খুব প্যাশনেট চুম্বন দৃশ্য। দুজনেই অত্যন্ত পেশাদার। আমার কথায় একটা না করেনি। ছবির অন্যতম সেরা দৃশ্য এটা। আর ডিওপি সুপ্রতিম ভোলের কথা বলতেই হবে, দারুণ তুলেছে। খুব কষ্টের দৃশ্যটা। কেমন, সুইট-সরো যেন, থেকে যায় ছবিটা দেখার পরেও।
কিছু দিন আগেই পড়ে গিয়ে চোট পেলেন। মেরুদণ্ডে আঘাত এবং অপারেশন। কতটা সামলে উঠেছেন?
...এখন বেটার। ডঃ প্রধান খুবই ভালো। আমি চঞ্চল প্রকৃতির। যাই হোক, বেরিয়ে পড়েছি ব্যথা নিয়েও, প্রচার সামলাচ্ছি। সব মা-আর দাদাই করিয়ে নিচ্ছে হয়তো। তবে প্রচার আর কী। আমার ছবির বিশাল হোর্ডিং-ও নেই, গিমিকও নেই। বিতর্কও নেই। তবে বলব, ছবিটা যত্ন করে বানিয়েছি। আশা করি দর্শক আসবে।
বাংলা ছবি পিছিয়ে পড়ছে অনেকের অভিমত।
...এটা যার যার পারসেপশন। আমি খুব পজিটিভ। যদি পিছিয়েও পড়ি, কাজটা আরও ভালো করে যেতে হবে মনে করি।
