১৫ মার্চ, ১৯৭৫। হকি বিশ্বকাপের পুরুষ বিভাগে ভারত চ্যাম্পিয়ন হয়। সে-ই প্রথম ও শেষ। আর, এমন সাফল্য আসেনি। বিশ্বজয়ী হকি দলের অধিনায়ক ছিলেন অজিতপাল সিং। এ-বছর হকিতে বিশ্বখেতাব জেতার ৫০ বছর। যতটা আলোড়ন হওয়ার কথা, তা কি হল? ক্রিকেট যা পারল, কেন হকি তা পারল না? লিখছেন শুভ্রাংশু রায়।

১০ মার্চ, ১৯৮৫। মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানকে হারিয়েছে ভারত। এহেন ‘বেনসন অ্যান্ড হেজেস’ কাপ জেতার পর পুরস্কার বিতরণীর সময়ের একটি বিশেষ দৃশ্যের কথা এখনও অনেকের মনে বেশ টাটকা। টুর্নামেন্টের সেরা, “চ্যাম্পিয়ন অফ চ্যাম্পিয়ন’স”, রবি শাস্ত্রীর জেতা অডি গাড়িতে চেপে পুরো ভারতীয় দল মাঠ পরিভ্রমণ করতে শুরু করে। অপটু হাতে গাড়ি চালিয়েছিলেন স্বয়ং শাস্ত্রী! রঙিন পোশাকে, ভারতীয় দলের এই বিশেষ মুহূর্তটি, রঙিন টেলিভিশনে দেখে, মধ্যবিত্ত ভারতীয় চেতনায় স্বপ্নের যে-বীজ রোপিত হয়েছিল, তার রংবাহার চার দশক পেরিয়ে এখনও ফিকে হয়ে যায়নি।
ফ্ল্যাশব্যাকে আরও ঠিক দশটা বছর পিছিয়ে যাওয়া যাক। মানে, ৫০ বছর আগে। ১৫ মার্চ, ১৯৭৫। কুয়ালা লামপুরের মারডেকা ফুটবল স্টেডিয়াম। তৃতীয় বিশ্বকাপ হকির ফাইনালে মুখোমুখি উপমহাদেশের দুই সেরা দল। ভারত এবং পাকিস্তান। সে-সময় সাফল্যের নিরিখে রীতিমতো ভারতের সঙ্গে পাল্লা দিত পাকিস্তান দল। উত্তেজনাময় সেই নির্ণায়ক ম্যাচে প্রথমার্ধে ০-১ গোলে পিছিয়ে থেকেও দ্বিতীয়ার্ধে দু’টি গোল করে বিশ্বকাপ জেতেন ভারতীয় পুরুষরা। সে-দলের অধিনায়ক অজিত পাল সিং। আর, জয়সূচক গোল এসেছিল ‘হকির জাদুকর’ ধ্যানচাঁদ-পুত্র অশোক কুমারের স্টিক থেকে।
ঘটনাচক্রে অদ্যাবধি হকি বিশ্বকাপে এটিই ভারতের একমাত্র খেতাব। এরপর আর কখনওই খেতাব হাতে আসেনি, শুধু তাই নয়, ভারতীয় দল আর হকি বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল অবধি পৌঁছতে পারেনি। অতীতের পাতা উলটে দেখলে আর-একটি বিষয় উঠে আসে। গত শতকের সাতের দশকে সর্বোচ্চ পর্যায় এটিই ছিল ভারতীয় হকি দলের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সাফল্য। ১৯৭২ সালের মিউনিখ অলিম্পিকে ভারতীয় দল ব্রোঞ্জ জেতে। ১৯৭১ ও ’৭৩ বিশ্বকাপে যথাক্রমে তৃতীয় এবং রানার্স আপ হয়। সাতের দশকে হকিতে অ্যাস্ট্রোটার্ফ আসেনি। কিন্তু স্টেটাসের দিক থেকে আন্তজার্তিক মহলে ‘এক নম্বর’ খেলা ছিল হকি-ই। আবার তত দিনে ভারতের প্রবল প্রতিপক্ষ রূপে উঠে এসেছে পশ্চিম জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডের মতো ইউরোপীয় দেশ। শীর্ষস্থানীয় হকি-খেলিয়ে দেশগুলির মধ্যে ব্যবধান ক্রমশ কমে আসতেও শুরু করে এই সময়।
মনে রাখতে হবে, আন্তর্জাতিক ফুটবলেও ছয়ের দশকের পরে আর আসেনি ভারতের সাফল্য। টেস্ট ক্রিকেট আন্তর্জাতিক স্তরে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠা পেলেও আমজনতার খেলা হিসাবে তখনও নড়বড়ে। এই ১৯৭৫ সালেই প্রথম ক্রিকেট বিশ্বকাপে (প্রুডেনশিয়াল কাপ), ভারতীয় দল দুর্বল ইস্ট-আফ্রিকার বিরুদ্ধে একটি মাত্র জয় অবলম্বন করে, গ্রুপ লিগ থেকে বিদায় নেয়। অন্যদিকে, মর্যাদার পাশাপাশি তখন হকিতে প্রচুর কেন্দ্রীয় সরকারি চাকরি সুযোগ তৈরি হয়েছিল। স্বাভাবিক কারণেই হকি নিয়ে রেডিও ও প্রিন্ট মিডিয়ায় প্রচারের কোনও অভাব ছিল না। প্রায় সব বড় শহরের পাশাপাশি বেশ কিছু ছোট শহরেও জমিয়ে হকি খেলা হত সেই দশকে।
হকি বিশ্বকাপের ধারণা দিয়েছিলেন– পাকিস্তানের এয়ার মার্শাল নূর খান। তৎকালীন ‘ওয়ার্ল্ড হকি ম্যাগাজিন’-এর কর্ণধার প্যাট্রিক রাউলের মাধ্যমে ‘আন্তর্জাতিক হকি ফেডারেশন’-কে (এফআইএইচ) এই প্রস্তাব দিলে, ‘এফআইএইচ’ তা গ্রহণ করে (১২ এপ্রিল, ১৯৭০)। স্থির হয়, প্রথম হকি বিশ্বকাপের আসর বসবে পাকিস্তানে। সে-বছর অক্টোবর মাসে হকি বিশ্বকাপ পাকিস্তানে শুরু হওয়ার কথা থাকলেও, ‘বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ’-কে কেন্দ্র করে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সামরিক সংঘাতের বাতাবরণ তৈরি হয়। পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে ভারতকে অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হলেও– পাকিস্তানে এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু হয়। ফলে, তড়িঘড়ি ‘এফআইএইচ’ টুর্নামেন্টের ভেনু বদলে বার্সেলোনায় নিয়ে যায়। মাত্র দশটি দেশ নিয়ে অনুষ্ঠিত প্রথম বিশ্বকাপের আসরে সেমিফাইনালে পাকিস্তানের কাছে ভারত ১-২ গোলে পরাজিত হয় ও কেনিয়াকে হারিয়ে তৃতীয় স্থান নিয়েই সন্তুষ্ট থাকে। সেরার খেতাব জিতে নেয় পাকিস্তান। ১৯৭৩ বিশ্বকাপে ভারত ফাইনালে পৌঁছয়। আয়োজক দেশ নেদারল্যান্ডসের বিরুদ্ধে ২-০ গোলে এগিয়ে থেকেও শেষ পর্যন্ত টাইব্রেকারে হারে। নেদারল্যান্ডস জিতে নেয় হকির বিশ্ব সেরার ট্রফি।
’৭৫ বিশ্বকাপের আসর শুরুর প্রায় আড়াই মাস আগে, তৎকালীন পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী জ্ঞানী জৈল সিংয়ের উদ্যোগে হকি দলের জন্য চণ্ডীগড় শহরে পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটি গ্রাউন্ডে শিবির করা হয়। শিবিরে থাকা খেলোয়াড়দের দৈনিক ভাতা বাড়িয়ে ২৫ থেকে ৫০ টাকা করা হয়। তিনবারের অলিম্পিক স্বর্ণজয়ী বলবীর সিং সিনিয়রের প্রশিক্ষণে ভারতীয় দল প্রথম দিল্লি থেকে সিঙ্গাপুর উড়ে যায়। যেখানে কয়েকটি প্রস্তুতি ম্যাচ খেলার পরে হাজির হয় মালয়েশিয়ায়– কুয়ালা লামপুরে বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করতে। সে-বছর ভারতের ১৬ জনের দলটি ছিল– অজিতপাল সিং (অধিনায়ক), অশোক দিওয়ান, লেসলি ফার্নান্ডেজ, মাইকেল কিন্ডো, সুরজিৎ সিং, আসলাম শের খান, ভরিন্দর সিং, ওঙ্কার সিং, মহিন্দর সিং, ভিক্টর ফিলিপ্স, হরচরণ সিং, শিবাজী পাওয়ার, অশোক কুমার, বি. পি. গোবিন্দা, হরজিন্দর সিং, পি. ই. কালাইয়া। ‘গ্রুপ বি’-তে ৫টি ম্যাচ খেলে ৭ পয়েন্ট নিয়ে (৩টি জয়, ১টি ড্র, ১টি হার) গ্রুপের সেরা হয়েছিল ভারত। এই গ্রুপে বাকি পাঁচটি দল ছিল– পশ্চিম জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, আর্জেন্টিনা ও ঘানা। ১৪ মার্চ সেমিফাইনালে ভারত দু’-দু’বার (০-১ ও ১-২) পিছিয়ে পড়েও শেষ পর্যন্ত অতিরিক্ত সময় ৩-২ গোলে হারিয়ে দেয় আয়োজক দেশ মালয়েশিয়াকে। অন্য সেমিফাইনালে পাকিস্তান ৫-১ গোলে পশ্চিম জার্মানিকে হারিয়ে মুখোমুখি হয় ভারতের। আর ১৫ মার্চ পাকিস্তানকে ২-১ গোলে হারিয়ে ভারত জিতে নিয়েছিল হকি বিশ্বকাপ।
তৎকালীন পত্রপত্রিকা দেখলে বোঝা যায়, দেশের মধ্যে ভালোই প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছিল এই জয়। প্রায় সমস্ত অগ্রগণ্য খবরের কাগজে, এমনকী আঞ্চলিক ভাষার সংবাদপত্রেও, ছবি-সহ লিড স্টোরি হয়েছিল। ‘অল ইন্ডিয়া রেডিও’-য় ফাইনাল ম্যাচের ধারাবিবরণীর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। জয়ের পর উল্লসিত মানুষ বেরিয়ে এসেছিলেন রাস্তায়। বিভিন্ন জায়গায় বেরিয়েছিল বিজয়মিছিল। খেলা হয়েছিল অকাল হোলি। এই উপলক্ষে, উত্তর কলকাতাযর একটি পাড়ায়, রেডিওতে মালা পরানোর মতো ঘটনাও ঘটে। বিশ্বজয়ী ভারতীয় হকি দল কলকাতা বিমানবন্দর হয়ে ফিরে যায় নিউদিল্লি। উভয় জায়গায় বিশ্বসেরা দল পেয়েছিল সাদর ও উষ্ণ অভ্যর্থনা। ফুল, মিষ্টি, উল্লাসবাক্য।
এবার জাম্পকাট ২০২৫, ১৫ মার্চ। হকিতে বিশ্ব সেরার খেতাব জেতার ৫০ বছর পূর্তি। সারা দেশে একটিই বলার মতো অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল ‘হকি ইন্ডিয়া’-র উদ্যোগে। দিল্লিতে। সেখানে সেই দলের ১৬ জনের মধ্যে যাঁরা জীবিত, তাঁদের সম্মান জানানো হয় কন্দ্রীয় ক্রীড়া দপ্তর আর হকি ইন্ডিয়ার তরফে। গুটিকয়েক চ্যানেলে এই অনুষ্ঠান দেখানো হয়। হাতেগোনা সংবাদপত্রে পরের দিন সে-খবর স্থান পেয়েছিল। অধিকাংশ দেশবাসী ও ক্রীড়াপ্রেমী মানুষের মনে এই জয়ের কোনও স্মৃতি হয় নেই, বা খুব অল্প লোকের মধ্যে আছে, এবং যেটুকু আছে তা ঝাপসা, রংচটা, অবহেলার সামিল হয়ে। সেদিনের বিশ্বজয়ী চরিত্ররা অদ্ভুতভাবে প্রায় তলিয়ে গিয়েছেন বিস্মৃতির অন্ধকারে। অথচ, এর আট বছর পরে লর্ডসের ব্যালকনিতে কপিল দেবের লাজুক মুখে ক্রিকেট বিশ্বকাপ হাতে নিয়ে ছবিটি– ভারতের প্রান্তিক এলাকায় ভীষণ জীবন্ত ও ঝলমলে।
ক্রিকেটের প্রথম বিশ্বজয় যা পারল, কেন হকিতে প্রথম বিশ্বখেতাব জেতা তা পারল না– মানে, মানুষের মনে তা স্থায়ী আসন তৈরিতে ব্যর্থ হল? ক্রিকেটের জনপ্রিয়তার যদি এর কারণ হয়, তাহলে প্রশ্ন– কেন হকির জনপ্রিয়তা কমল? মনে রাখতে হবে, হকিতে বিশ্বখেতাব জয়ের ৩ মাসের মধ্যে দেশে জারি হয়েছিল ‘জরুরি অবস্থা’ (২৫ জুন ১৯৭৫)। এই ‘ইমার্জেন্সি’ শেষে নির্বাচন হয় এবং নির্বাচনশেষে দেশের ক্ষমতায় পালাবদল ঘটে ফের। নতুন সরকারের নীতিতে খেলার বিষয়ে কোনও সুনির্দিষ্ট নীতি ছিল না। সত্যি বলতে, তৎকালীন অনিশ্চিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সেই সুযোগও সরকারের কাছে হয়তো সেভাবে ছিল না।
১৯৭৬ অলিম্পিক থেকে শুরু হয় হকিতে অ্যাস্ট্রোটার্ফের প্রচলন, যা ভারতকে দুম করে পিছনের সারিতে ঠেলে দেয়। মস্কোতে, ১৯৮০ সালের হকিতে, ভারত অলিম্পিকে সোনা জিতলেও তা ছিল কার্যত ভাঙা হাট। কারণ মার্কিন গোষ্ঠী সেবারের অলিম্পিক বয়কট করায় হকির শক্তিধর দেশগুলি খেলতে যায়নি। সবথেকে খারাপ বিজ্ঞাপন হয়ে দঁাড়ায়, দিল্লি এশিয়ান গেমসের ফাইনালে পাকিস্তানের কাছে ১-৭ গোলে পরাজয়। প্রকৃতপক্ষে ১৯৬৭-’৯৪ পর্যন্ত এশিয়ান গেমসের হকি ইভেন্টে ভারতীয় দল একবারও সোনা জিততে পারেনি।
অন্যদিকে, ১৯৮৩ সালে ক্রিকেট দল পায় সেই ঐতিহাসিক সাফল্য। তারপর ১৯৮৫ সালে ‘বেনসন অ্যান্ড হেজেস’ কাপ জয়। ১৯৮৭ সালে ভারতের মাটিতে ‘রিলায়েন্স’ ওয়ার্ল্ড কাপের আয়োজন। সব মিলিয়ে, ক্রিকেটের সাফল্য, সরকারি পৃষ্ঠোষকতা ও নয়ের দশকের খোলা হওয়াবাহিত পুঁজি-সম্বল করে ফুলেফেঁপে ওঠে। এর সঙ্গে আরও একটি বড় বিষয়ের উল্লেখ করতেই হবে। তা হল: আইকনের উপস্থিতি। ভারতীয় ক্রিকেটে সুনীল গাভাসকার, কপিল দেব হয়ে শচীন-সৌরভ-দ্রাবিড় থেকে হালের বিরাট কোহলি ও রোহিত শর্মা– একের পর এক তারকার ‘আবির্ভাব’ ঘটেছে– যঁারা ব্যক্তিপ্রতাপে প্রভাবিত করতে পারেন একাধিক প্রজন্মকে। হকির দুনিয়ায় সেই ধরনের সর্বগ্রাসী ‘আইকন’ কই? ১৯৮৪ সালে ‘অপারেশন ব্লু স্টার’ জনিত কারণে পাঞ্জাবে অস্থিরতা তৈরি হয়। এর প্রভাব পড়ে সেখানকার হকিতে। কলকাতার মতো শহরেও হকি উঠে যেতে থাকে। এর সঙ্গে তো আছেই হকি ফেডারেশনের নিজস্ব প্রশাসনিক সমস্যা। পরিণতি: এত বড় সাফল্য মানুষের স্মৃতি থেকে কখন যেন হারিয়ে গেল!
আশার কথা, প্রায় চার দশক পরে, পরপর দু’টি অলিম্পিকে ভারত পুরুষদদের হকিতে পদক পেয়েছে। গড়ে উঠেছে আন্তজার্তিক মানের অ্যাস্ট্রোটার্ফ-সহ বেশ কয়েকটি হকি স্টেডিয়াম। তার মধ্যে কলকাতার ডুমুরজলা স্টেডিয়ামও আছে। এর ফলে কলকাতা প্রিমিয়ার হকি লিগে জোয়ার এসেছে বলে কথিত। প্রথম হকি বিশ্বকাপ জয়ের ৫০ বছরে যতখানি এই গৌরবগাথার উপর আস্তরণ পড়েছে– ৭৫ বছরে গিয়ে হয়তো এতখানি বিস্মৃতির আড়াল না-ও থাকতে পারে।
(মতামত নিজস্ব)
লেখক ক্রীড়া ঐতিহাসিক
subhransuroy1@gmail.com