‘ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভ’-এর হিসাব বলছে, দেশের প্রায় ৭৫-৮০ শতাংশ হিন্দুই আমিষাশী। নিরামিষভোজীর সংখ্যা গড়ে ২০-২৩ শতাংশ। তবে এই হার অঞ্চলভেদে ব্যাপকভাবে বদলে যায়, যেতে পারে। যেমন– রাজস্থান, গুজরাট, হরিয়ানা ও মধ্যপ্রদেশে নিরামিষভোজীর হার তুলনামূলক বেশি, প্রায় ৩০-৪৫ %। এই নিয়ম ভাঙলেই কি হেনস্তা? ময়দানে চিকেন প্যাটিস-বিক্রেতার সঙ্গে যা হল, ভয় লাগে, এ শহরকে চিনি তো? লিখছেন আদিত্য ঘোষ।
এ-বছর দুর্গাপুজোয় বেশ কিছু জায়গায় মাছ-মাংসের দোকান বন্ধ রাখার ফতোয়া জারি করেছিল কিছু কট্টরপন্থী সংগঠন। কিছু অবাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চলে বাজার সম্পূর্ণ বন্ধ ছিল। কেউ কেউ কানাঘুষো বলছিল, ‘ইয়ে বঙ্গালি লোক ইতনা মছলি কিঁউ খাতা হ্যায়?’ শুধু তা-ই নয়, বাড়ির ছাদে গেরুয়া পতাকা লাগানো, প্রতি সোমবার শিবের মাথায় জল ঢালা, প্রতি মঙ্গলবার হনুমান মন্দিরে যাওয়া– এসব বিষয় নাকি বাঙালিরা মানে না। সেই কারণে এসব বিষয় প্রচণ্ডভাবে মানা উচিত বলে মনে করে কিছু ধর্মীয় সংগঠন। এসব না-মানলে ‘প্রকৃত হিন্দু’ হওয়া যায় না, তাদের বক্তব্য। আর, ‘প্রকৃত হিন্দু’ না হলে তো বিভিন্ন সংগঠনের লোকেরা উচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য অপেক্ষায় আছে। কোথায় কী খাব, কোথায় কী পরব, কোথায় কী বলব– সব ফতোয়া তৈরি। এমনকী, কোথায় কী বিক্রি হবে, তাও তারা ঠিক করে দেয় পারলে। ধর্মের মাঝে এঁকে দেয় বিভাজনের রেখা, যা ঠিক করে দেবে আমার-তোমার ধর্ম কী! সেই বিভাজন-রেখা ঠিক করে দেবে, তুমি কী খাবে আর কী খাবে না!
ভারতের রাজনৈতিক পরিমণ্ডল বরাবরই খাদ্যাখাদ্যে আবর্তিত। ‘খাদ্য রাজনীতি’-র মতো মারণাস্ত্র হয়তো আর কোথাও দেখা যাবে না। কে জানে, হয়তো সেজন্যই ভারতের রাজনীতির চিত্র এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও বদলাল না। এখনও মাছ-মাংস, নিরামিষ-আমিষ নিয়ে খণ্ডযুদ্ধ বেঁধে যায়, এবং যে-ঘটনার রেশ কোর্ট পর্যন্ত পৌঁছয়– সেই দেশ আদৌ কি ধর্মনিরপেক্ষ? আমরা কি দিনের শেষে বলতে পারি, আমরা মেরুকরণের বিশ্বাসী নই?
খাদ্য এবং ধর্মীয় রীতিনীতিকে মিলিয়ে দেওয়ার প্রবল চেষ্টা তো সেই মেরুকরণের চেষ্টাকেই প্রকট করে। ময়দানে কেন চিকেন প্যাটিস বিক্রি করবেন একজন বিক্রেতা? তাও গীতা পাঠের মতো অনুষ্ঠানের আবহে! তেড়েফুঁড়ে গেল কিছু যুবক। তাকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য যা-যা করতে হয়, তা-ই করল। আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে শিক্ষা দিল। প্রসঙ্গত, বিক্রেতার অন্যায়, সে চিকেন প্যাটিস বিক্রি করছিল। অর্থাৎ সে কেন আমিষ খাদ্য বিক্রি করছিল একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে!
ধর্ম এবং আমিষ। ধর্ম এবং নিরামিষ। কার সঙ্গে কে যাবে, সেই লড়াই শুরু হয়েছিল কোনও এক ইতিহাসে, সে লড়াই এখনও চলছে। এখন তো আবার রাজনীতির রং লেগেছে সেই ধর্মে– আমিষে, নিরামিষে। ‘ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভ’-এর হিসাব বলছে, দেশের প্রায় ৭৫-৮০ শতাংশ হিন্দুই আমিষাশী। নিরামিষভোজীর সংখ্যা গড়ে ২০-২৩ শতাংশ। তবে এই হার অঞ্চলভেদে ব্যাপকভাবে বদলে যায়, যেতে পারে। যেমন– রাজস্থান, গুজরাত, হরিয়ানা ও মধ্যপ্রদেশে নিরামিষভোজীর হার তুলনামূলক বেশি, প্রায় ৩০-৪৫ %। আবার বাংলা, অসম, ওড়িশা, কেরল ও তামিলনাড়ুতে নিরামিষভোজী হিন্দুদের সংখ্যা মাত্র ৫-১০ %। ‘ইন্ডিয়ান হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট’-এর গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বলছে– ভারতে ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের মধ্যেও প্রায় অর্ধেক মানুষ আমিষভোজী। বিশেষ করে কাশ্মীরি, বাঙালি ও দক্ষিণ ভারতীয় ব্রাহ্মণদের মধ্যে এই প্রবণতা প্রকট। বৈদিক গ্রন্থে যজ্ঞে পশুবলির উল্লেখ আছে, শাক্তধর্মে মাংস-মৎস্য নৈবেদ্য এখনও প্রচলিত, অর্থাৎ শাস্ত্রেই নিরামিষকে সর্বজনীন বিধান বলা হয়নি। আসলে নিরামিষ খাওয়া মূলত আঞ্চলিক সংস্কৃতি, সামাজিক অভ্যাস ও মধ্যযুগীয় বৈষ্ণব প্রভাবের ফল, সনাতন ধর্মের কোনও নির্ধারিত ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা নয়। কিন্তু এই সবজান্তা দেশে কে কাকে ধর্ম বোঝাবে আর কে কাকে পড়ে শোনাবে পুরাণের বাণী?
ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মীয় উৎসবকে কেন্দ্র করে মাছ-মাংস-ডিম বিক্রি বন্ধ রাখার প্রবণতা স্পষ্টভাবে বেড়েছে। উত্তরপ্রদেশে নবরাত্রি ও রাম নবমীর মতো উৎসবের সময়ে ধর্মীয় স্থানের ৫০০ মিটারের মধ্যে মাংস বিক্রি ‘নিষিদ্ধ’। আবার কোথাও কোথাও দোকান সম্পূর্ণ বন্ধ রাখারও নির্দেশ জারি হয়। রাজস্থানের বিশেষ কিছু উৎসব উপলক্ষে দু’-দিন মাংস ও ডিম বিক্রি বন্ধ রাখার সরকারি আদেশ বিতর্ক সৃষ্টি করেছিল। মহারাষ্ট্র, তেলেঙ্গানা ও হায়দরাবাদের মতো শহরেও স্বাধীনতা দিবস বা অন্যান্য বিশেষ দিনে মাংসের দোকান বন্ধ রাখার নিয়ম চালু হয়েছে, যা নিয়ে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা প্রশ্ন তুলেছেন। তঁাদের দাবি, মানুষের খাদ্যাভ্যাসের উপর প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ সংবিধান দ্বারা সুরক্ষিত ব্যক্তিগত অধিকারের পরিপন্থা এবং এটি সমাজে বিভাজন তৈরি করতে পারে।
এ বিতর্কের নেপথ্যে আসলে লুকিয়ে রয়েছে আরও বড় বাস্তবতা। ভারতে ‘খাদ্য’ এখন আর শুধুই ব্যক্তিগত পছন্দ নয়। এটি ‘পরিচয়বাচক রাজনীতি’-র অন্যতম শক্তিশালী হাতিয়ার। ধর্মীয় সংগঠনসমূহের দাবি, উৎসবের সময় ধর্মীয় রীতি বজায় রাখতে মাংস বিক্রি বন্ধ রাখা উচিত। অন্যদিকে, বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ধরনের পদক্ষেপ আসলে সামাজিক মেরুকরণ বাড়ায় এবং ধর্মীয় সংখ্যাগুরু এবং সংখ্যালঘুর বিভাজনবাদী মনস্তত্ত্বকে উসকে দেয়। অতীতে খাদ্যকে কেন্দ্র করে সহিংসতার ঘটনাও ঘটেছে। খাবারকে কেন্দ্র করে এখনও ভারতের বহু জায়গায় সামাজিক টানাপোড়েন তৈরি হয়, এবং খাদ্যনীতি ক্রমশই রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের এক কার্যকর অস্ত্রে পরিণত। রাজ্যে রাজ্যে যত ভোট এগিয়ে আসে, খাদ্যনির্ভর ধর্মীয় মেরুকরণ তত বাড়ে।
সংস্কৃতির ধারাকে অব্যাহত রাখতে, স্বধর্ম রক্ষা করতে, ঠিক কী কী করণীয়, তা নিয়ে চূড়ান্ত ঘেঁটে বিভিন্ন সংগঠন। ‘জেনজি’ প্রজন্ম মোটেও এই খাদ্য রাজনীতিকে ভালো চোখে দেখছে না। এই ডিজিটাল যুগে অনৈতিক, অহেতুক মেরুকরণ তাদের সংসদীয় রাজনীতি সম্বন্ধে নেতিবাচক মনোভাবাপন্ন করে তুলছে। যা আগামী দিনের জন্য ভয়ংকর হতে পারে। আর কবে আমরা মেরুকরণ দিয়ে নয়, শুধুমাত্র মানুষ রূপেই মানুষের বিচার করব?
(মতামত নিজস্ব)
