মেয়েরা স্মার্ট হলে দোষ। মেয়েরা সাবেক সংস্কার বয়ে চললেও সমালোচিত। এমন মেরুকরণ তৈরি করা হয়তো-বা পুরুষতন্ত্রেরই সাজানো ছক!
মৃণাল সেনের সিনেমায় একটি মেয়ে রাতে বাড়ি ফেরেনি। কেন ফেরেনি, স্পষ্ট করে বলা নেই। অকথিত, অজ্ঞাত কারণটি ঘিরে সিনেমায় যে কৌতূহল ও রহস্য ঘনিয়ে ওঠে, তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে মেয়েটির সতীত্ব, নারীত্ব, আব্রু। কেন একটি মধ্যবিত্ত বাঙালি বাড়ির মেয়ে সারা রাত বাড়ির বাইরে থাকল, কোন সে-কারণ বা বাধ্যবাধকতা– তা সমূলে না জানতে পারলে পাড়াপ্রতিবেশীর যেন ভাত পরিপাক হয় না!
এই যে মানসিক ও সামাজিক স্থবিরতা, চাকুরিরত একটি মেয়ের চরিত্রহনন করতে যা ঘুণপোকার মতো ছটফট করছে, সেই মনোবৃত্তির উদঘাটন করে মৃণাল সেন আমাদের
ছঁ্যাকা দিয়েছিলেন। কথা হচ্ছে– সেই দাগ কি মিলিয়ে গিয়েছে? কপিল শর্মার শোয়ে বিখ্যাত টেনিস স্টার সানিয়া মির্জা এসেছেন। তঁার সঙ্গে কপিল একটি কাল্পনিক দৃশ্য তৈরি করেন। সেটি স্ক্রিপ্টের অংশ, না কি সত্যিই তাৎক্ষণিকের উপহার, স্পষ্ট না হলেও, বিষয়টি ঘটছে সামনাসামনি। কপিল একজন দাপুটে ‘শাশুড়ি’-র ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। সানিয়া অবতীর্ণ হন ‘গৃহবধূ’ রূপে। কাল্পনিক সংলাপ শুরু হয়: শাশুড়িকে বউমার চা এনে দেওয়া থেকে। কপিল-রূপী শাশুড়ি চায়ে মুখ দিয়েই ‘থুঃ’ করে চা ফেলে দেয়। এত খারাপ খাওয়া যাচ্ছে না? বিষবৎ মনে হচ্ছে। বউমাা-রূপী সানিয়া বলে, আমি তো চা-ই বানিয়ে দিলাম, হয়তো আপনার জিভের স্পর্শে তা বিষে পরিণত হয়েছে!
রিয়ালিটি শোয়ের দর্শকরা মুগ্ধ হয়ে হাততালিতে ফেটে পড়ে। দেখার সময় টিভি ও মোবাইলের দর্শকরাও হেসে খুন। তবে একটু তলিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে, এখানে শাশুড়ি ও বউমাকে লড়িয়ে দিয়ে যে-আবহ তৈরি করা হয়েছে তা ‘তু তু ম্যায় ম্যায়’ সংস্কৃতির দোসর। শাশুড়ি টিগরমবাজ। ঘর-সংসারের প্রশ্নে বউমাকে তরোয়ালের ধারে খেলাতে চায়। কারণ, তার শাশুড়িও তার সঙ্গে অনুরূপ ব্যবহার করেছিল। এটিই হয়, হয়ে চলেছে প্রজন্মব্যাপী। অন্যদিকে, বউমা বুনো তেঁতুল। মুখে মুখে চোপা করতে দু’বার ভাবে না। সে আধুনিকা, স্বাবলম্বী, বা স্বাবলম্বনের খেঁাজে ব্যস্ত। ‘শাশুড়ি’ নামক সাবেক প্রতিষ্ঠানের চোখরাঙানি বউমা শুনতে রাজি নয়। অথচ, অবমাননা হল আসলে মহিলাদের।
প্রবীণাদের চোখে বউমার মেজাজ প্রশংসিত হবে না হয়তো। আবার নবীনাদের চোখে, এই বউমা যা করেছে বেশ করেছে। এমনই হওয়া শ্রেয়। একটি কাল্পনিক সংলাপের হাস্যময়তা কোথাও যেন সমাজের পুরনো ঘাগুলিকে অতিজীবিত করে তোলে। মহিলা সমাজের প্রতি বিভক্ত হয়ে যায় সমর্থনের হাততালি। এরও নেপথ্যে স্থবিরতা। মেয়েরা কাঠগড়ায় উঠছে হয় অতিরিক্ত স্মার্ট হওয়ার জন্য। নয়তো তারা অভিযুক্ত হচ্ছে সংসারের শ্রী ও শান্তি ভঙ্গ করার জন্য।
ভেবে দেখলে, দু’ক্ষেত্রেই কিন্তু মেয়েদের সম্ভ্রমচেতনা প্রশ্নের মুখে। খবরে প্রকাশ, সম্প্রতি ক্যানিংয়ের একটি পরিবার মাতৃসদন থেকে সদ্যোজাত কন্যাকে তাসা পার্টি সহযোগে আনন্দ করে বাড়িতে নিয়ে গিয়েছে। মনখুশি করা খবর। তবে এমন ‘খবর’ নেহাত ব্যতিক্রম হয়ে রয়ে গেলে, তিমিরবিনাশী হব কী করে আমরা?
