জানাচ্ছে ‘গ্লোবাল টর্চার ইনডেক্স, ২০২৫’। মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এবং বিভিন্ন এনজিও যা তথ্য দিয়েছে, তাতে রীতিমতো শিউরে উঠতে হয়। আন্তর্জাতিক মহলও সমালোচনায় বিদ্ধ করেছে ভারতকে। হেফাজতে মৃত্যু, বিচারবহির্ভূত হত্যা, জাতিগত ও সাম্প্রদায়িক হিংসা ইত্যাদি নানবিধ সমস্যায় জর্জরিত দেশ। যার কোনও প্রতিকার জানা নেই শাসকের। লিখছেন চিরঞ্জীব রায়
পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র। গণতন্ত্র অর্থাৎ, জনগণের রায়ে যেখানে দেশ চলে। এমন এক দেশে জনগণ বা মানবের অধিকার নিয়ে সংশয় থাকার কথা ছিল না। কিন্তু তেমনটা ঘটছে কই? নির্দিষ্ট একটি দিবস পালন করার অবকাশে চারপাশে তাকালে হতাশ হতে হচ্ছে, ভারতের মানবাধিকারের আকাশ ভারি মেঘলা!
বিশ্বের সমস্ত দেশের সকল মানুষের বঞ্চনা-রহিত এবং বিভিন্ন মৌলিক অধিকারপ্রাপ্ত জীবনযাপন সুনিশ্চিত করতে ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর প্যারিসে রাষ্ট্র সংঘের সাধারণ সভায় ‘ইউনিভার্সাল ডিক্ল্যারেশন অফ হিউম্যান রাইটস’ বা মানবাধিকার রক্ষার আন্তর্জাতিক ঘোষণাপত্র গৃহীত হয়। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সাম্য, সম্ভ্রম, অত্যাচার থেকে মুক্তি, শিক্ষা এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার রক্ষাই ছিল এই ঘোষণাপত্রের লক্ষ্য। ভারতও বলা বাহুল্য এর আওতায় পড়ে।
কিন্তু, সম্প্রতি, ভারতে মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সমালোচনার মাত্রা বেড়েই চলেছে। রাষ্ট্র সংঘ বা ‘ইউএন’ থেকে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ থেকে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর, তাদের বিভিন্ন রিপোর্টে হেপাজতে মৃত্যু, বিচারবহির্ভূত হত্যা, জাতিগত ও সাম্প্রদায়িক হিংসা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ এবং বিশেষত সংখ্যালঘু, দলিত এবং জনজাতিদের ক্ষেত্রে বৈষম্য এবং কাশ্মীরে যথেচ্ছ মানবাধিকার লঙ্ঘনের উল্লেখ করেছে। এবং তাদের অভিযোগ, এই বিষয়ে সরকারি হাতিয়ার হল– বেআইনি কার্যকলাপ (প্রতিরোধ) আইন বা ইউএপিএ, সশস্ত্র বাহিনী (বিশেষ ক্ষমতা) আইন বা এএফএসপিএ-র মতো কিছু সন্ত্রাস-বিরোধী এবং নাগরিকত্ব সংশোধন আইনের (সিএএ) মতো কিছু বৈষম্যমূলক আইন।
কেন্দ্র সরকার অবশ্য বহু অভিযোগই অস্বীকার করেছে। বস্তুত, ২০১৯ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে রাষ্ট্র সংঘ ৮৩ বার ভারতের সঙ্গে লিখিত যোগাযোগ করলেও, হয় উত্তর ছিল না বা উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে না করায়, কেন্দ্র সরকার জবাব দিয়েছে মাত্র ২০টি ক্ষেত্রে। ভূরাজনৈতিক সংঘাত, অর্থনৈতিক রেষারেষি, আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি খারাপ করে দেওয়ার চেষ্টা, কূটনৈতিক টানাপোড়েন বা কোনও কোনও দেশ ও সংগঠনের খবরদারির মনোভাবও এত অভিযোগে ভারতকে জর্জরিত করে রাখার কারণ হতে পারে।
তাই দেশে মানবাধিকার-চিত্রের আভাস পেতে পরিসংখ্যানের শরণ নেওয়াই শ্রেয়। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন (‘এনএইচআরসি’) এবং বিভিন্ন এনজিও-র দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ভারতের আমজনতার অধিকার দিন-প্রতিদিন আরও বেশি খর্ব হচ্ছে। ২০২৩ সালে হেপাজতে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ২৪০০। ’২৪ সালে সেই সংখ্যা বেড়ে দঁাড়িয়েছে ২,৭৩৯। সে বছরের প্রথম নয় মাসে পুলিশ হেপাজতে ১২১ জন এবং বিচারবিভাগীয় হেপাজতে ১৯৯৫ জন মারা যায়।
২০২৪ সালের প্রথম নয় মাসে বিচারবহির্ভূত মৃত্যুর সংখ্যা ৯৩। এছাড়া রয়েছে পাচার এবং নির্যাতনের সমস্যা। যার মূল বলি শিশু ও নারীরা। ‘ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো’ (এনসিআরবি) ‘ভারতে অপরাধ’-এর সাম্প্রতিকতম তথ্য প্রকাশ করেনি। ২০২২ সালের নথিতে দেখা যাচ্ছে, মানবপাচারের ২২৫০টি মামলা দায়ের হয়েছিল। সংশ্লিষ্ট অভিযোগে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার জন গ্রেফতার হয়। কিন্তু পুলিশ-প্রশাসনের গাফিলতি হোক বা নির্দোষ হওয়ার কারণে, দোষী সাব্যস্ত হয়ে সাজাপ্রাপ্তের সংখ্যা মাত্র ৫ শতাংশ। এই ২০২২ সালের ‘এসিআরবি’ নথিই প্রকাশ করছে, সে বছর ৩১ হাজার ৫১৬ জন মহিলা ধর্ষণের শিকার। দেশে প্রতিদিন গড়ে শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ইজ্জত ধুলোয় লুটোয় ৮৬ জন নারীর। ৯৫ শতাংশ ধর্ষণের মামলার ফাইল দিনের পর দিন ধুলো খায় এবং শেষ পর্যন্ত সাজা হয় মাত্র ২৬-৩০ শতাংশ অভিযুক্তের। ‘এনএইচআরসি’-র তথ্যই জানাচ্ছে, ‘গ্লোবাল টর্চার ইনডেক্স, ২০২৫’ অনুযায়ী ভারত এক ‘উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ’ দেশ হিসাবে চিহ্নিত।
একমাত্র আদালত এই সমস্ত সমস্যার ন্যায়সংগত নিষ্পত্তি করতে পারে, প্রতিষ্ঠা করতে পারে মানবাধিকার। কিন্তু ব্যবস্থাপনায় চরম দীর্ঘসূত্রিতা ও পর্যাপ্ত পরিকাঠামোর অভাবে তারিখের পর তারিখের গল্প চলছে এবং দেশের আদালতগুলিতে প্রায় সাড়ে তিন কোটি ফৌজদারি মামলা বিচারের অপেক্ষায় স্তূপীকৃত হয়ে রয়েছে।
সরকারের দায়িত্ব, দেশবাসীর মানবাধিকার সুরক্ষিত রাখা। দেশের নাগরিকের কর্তব্য, মানবাধিকার রক্ষার প্রহরীর মতো সরকারের পাশে দাঁড়ানো। সঠিক পথ দেখানো এবং প্রতিকারে বাধ্য করা। এই ব্যবস্থা তো সেই কবেই হয়েছে, ভারতীয় সংবিধানে। এবং বেশ পাকাপোক্তভাবেই হয়েছে। সংবিধানের ১২-৩৫ ধারায় দেশবাসীর জাতপাত, ধর্ম, সম্প্রদায়, সামাজিক শ্রেণি-নির্বিশেষে দেশের সমস্ত বাসিন্দার মৌলিক অধিকার– যেমন, সমতা বা সমানাধিকার, বাক্স্বাধীনতা, জীবন ও স্বাধীনতার, এবং শোষণের বিরুদ্ধে সুরক্ষার অধিকার সুরক্ষিত করা হয়েছে। সরকারের দায়িত্ব, যথাযথ আইন প্রণয়ন ও কার্যকর করার মাধ্যমে সেই অধিকারগুলি সুনিশ্চিত করা। সেই লক্ষ্যে মানবাধিকার রক্ষা আইন জারি হয়েছে। অধিকার লঙ্ঘন রুখতে ও নিরাপত্তা দিতে জাতীয় ও রাজ্যস্তরে মানবাধিকার কমিশন গঠিত হয়েছে।
বিচারের গতি বাড়াতে, প্রশাসনে স্বচ্ছতা আনতে ২০২৪ সালের জুলাই মাসে নতুন ফৌজদারি দণ্ডবিধি ‘ভারতীয় ন্যায় সংহিতা’-র প্রবর্তন হয়েছে। কিন্তু সংবিধানের ৭৫ বছর বয়স হয়ে যাওয়ার পরেও মানবাধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে আদর্শ এবং বাস্তবের মধ্যে ফারাক থেকেই যাচ্ছে।
আসলে, যে-লোকটার দু’-বেলার নুন-ভাতের জোগাড় নেই, যে মহিলা শতচ্ছিন্ন কাপড়ে ঘুঁটে বিক্রি করে, যে শিশু স্কুলে বই ঘঁাটার বদলে চায়ের দোকানে কাপ ধুতে যায়, তারা একটু ভাত-কাপড় আর ছাদের চিন্তায় এতটাই গ্রস্ত থাকে যে, সংবিধান-বর্ণিত অধিকার চাইতে যাওয়া তাদের কাছে বাহুল্য। তার উপর প্রশাসনের খবরদারি বা নেতার নজরদারিতে এবং আর্থিক অনটন ও প্রতিবাদের প্রয়োজনীয় সামাজিক ক্ষমতার অভাবে, ইচ্ছা থাকলেও মানবাধিকার থেকে বঞ্চনার প্রতিকার চাইতে তাদের আদালতের দরজায় পৌঁছনো হয় না। ন্যায়ের, আইনের আশ্রয় চাইতে পারে না। মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক শর্ত আমজনতার আর্থিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা। যার এগুলি কুক্ষিগত, সে-ই পারে মানব হিসাবে বঁাচার অধিকার দাবি করতে। প্রতিকার চাইতে। অর্থাৎ, ‘কমলাকান্তের দপ্তর’-এর সেই অমর উক্তিই আজও প্রাসঙ্গিক হয়ে রয়েছে, ‘আইন (এক্ষেত্রে মানবাধিকার) সে তো তামাশা মাত্র! কেবল বিত্তবান লোকেরাই পয়সা খরচ করিয়া সেই তামাশা দেখিতে পারে।’
(মতামত নিজস্ব), লেখক প্রাবন্ধিক
