ভারতের আকাশপথের ৬৪.২ শতাংশ এখন ‘ইন্ডিগো’র দখলে। ফল, অব্যবস্থা, উড়ান পরিষেবা বিপর্যয়, যাত্রী হয়রানি। নরেন্দ্র মোদির ‘নতুন ভারত’-এ এটাই ‘সিস্টেমেটিক ফরমুলা’– ‘মনোপলি’ ও ‘ডুয়োপলি’। বাজার থেকে ছোট ও মাঝারিদের সরিয়ে দাও। প্লেয়ার থাকবে একটা বা দুটো। বাকিরা এলেবেলে। লিখেছেন সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়।
‘মনোপলি’ শব্দটির পরিচিত বাংলা অর্থ ‘একচেটিয়া’। মানে, একার আধিপত্য। সেটা ব্যবসা-বাণিজ্য, খেলাধুলো-বিনোদন-রাজনীতি সর্বত্র হতে পারে। কিন্তু ‘ডুয়োপলি’, মানে যেখানে আধিপত্য দু’জনের মধ্যে ভাগাভাগি, তার প্রচলিত বাংলা প্রতিশব্দ পাওয়া দুষ্কর। শব্দ দু’টি নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন দেখা দিল ‘ইন্ডিগো’ অচলাবস্থা ও হাজার হাজার মানুষের দুর্ভোগের কারণে। এই সংকট এক বিশেষ বার্তাও দিয়ে গেল। বুঝিয়ে দিল, সমাজের যে কোনও ক্ষেত্রে ‘মনোপলি’ বা ‘ডুয়োপলি’ কীভাবে মানুষকে অসহায় করে তোলে। একচেটিয়া কারবারিদের হাতে জনতা কীভাবে বন্দি হয়ে যায়।
ভারতের আকাশপথের ৬৪.২ শতাংশ এখন ইন্ডিগোর দখলে, এয়ার ইন্ডিয়ার দখলে ২৭.৩ শতাংশ। অর্থাৎ, দুই সংস্থা নিয়ন্ত্রণ করছে বাজারের ৯১.৫ শতাংশ। ‘আকাশ’ বা ‘স্পাইসজেট’-এর হাল ‘অলসো র্যান’-এর মতো। চিনের দিকে তাকান। প্রথম তিন সংস্থার দখলে ৬০ শতাংশ। আমেরিকার প্রথম চার সংস্থার মার্কেট শেয়ার ৭৫ শতাংশ হলেও কারও একার শেয়ার ২৫ শতাংশের বেশি নয়। এই একাধিপত্য ইন্ডিগোর ঔদ্ধত্য এতটাই বাড়িয়েছে যে, তারা ধরাকে সরা জ্ঞান করছে। সরকারকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে ২২ মাস ধরে সংস্কারের রাস্তায় না হেঁটে দাদাগিরি চালাচ্ছে। ২০২৪ সালের জুন মাসে যা করার কথা ছিল, ২০২৫ সালের নভেম্বরেও তা তারা করেনি। হয়তো ভেবেছিল, আরও কিছুকাল সরকারকে অগ্রাহ্য করে মুনাফার থলে ভরবে।
প্রশ্ন হল, সরকার কী করেছে? জেনেশুনেও ব্যবস্থা নেয়নি কেন? উত্তর রয়েছে সরকারি অভিপ্রায়ে। ১১ বছর ধরে এই সরকারই চেয়েছে সর্বত্র ‘মনোপলি’ বা ‘ডুয়োপলি’ গড়ে তুলতে। হাতেগোনা কয়েকজনকে বাজারের নিয়ন্ত্রণ দিয়ে বৃহৎ পুঁজি সৃষ্টি করে বিশ্ববাজারে সমীহ পেতে। ইন্টারন্যাশন্যাল প্লেয়ার গড়ে তুলতে। সৃষ্টি বহু সময় স্রষ্টাকেও নিয়ন্ত্রণ করে। ইন্ডিগো-সংকট সেটাই দেখাল। তাদের চাপে সরকার কীভাবে নতজানু হতে পারে দেখিয়ে দিল তাও।
অথচ ২০ বছর আগের ছবিটা এমন ছিল না। সে-সময় রাষ্ট্রায়ত্ব ‘এয়ার ইন্ডিয়া’র পাশাপাশি বাজারে ছিল ‘জেট এয়ারওয়েজ’, ‘কিংফিশার’, ‘এয়ার সাহারা’, ‘গো ফার্স্ট’, ‘এয়ার ডেকান’-এর মতো সংস্থা। এই সময় রাহুল ভাটিয়া ও রাকেশ গাঙ্গোয়াল গড়ে তোলেন ‘ইন্ডিগো’। লক্ষ্য, দেশের মধ্যবিত্ত সমাজ। বাজার দখল করতে তঁারা নজর দেন নিয়মানুবর্তিতা, দক্ষতা, শৃঙ্খলাবোধ ও যাত্রীবহরের দিকে। ২০০৬ সালে যাত্রা শুরু করে ২০১০ সালে
তারা তৃতীয় বৃহত্তম বিমান সংস্থা হয়ে যায় ১৭.৩ শতাংশ মার্কেট শেয়ার দখল করে। নতুন এয়ারক্রাফট, দক্ষতা, তুলনামূলক কম ভাড়া, নানাভাবে খরচ কমানো এবং ঠিক সময়ে ওঠানামার মধ্য দিয়ে ক্রমেই তারা হয়ে ওঠে মার্কেটলিডার। হালে তালগাছের মতো সব মাথা ছাড়িয়ে তারা দঁাড়িয়ে রয়েছে ৪১৮টি এয়ারক্রাফট ও ৫ হাজার পাইলট নিয়ে। ১৬ কোটি ভারতীয় প্রতি বছর বিমানযাত্রা করে। অধিকাংশের প্রথম পছন্দ ইন্ডিগো। এটা তারা নিজের যোগ্যতায় অর্জন করেছে। দেশ ও বিদেশ মিলিয়ে প্রতিদিন তাদের ২৩০০ ফ্লাইট ওঠানামা করে। সাফল্য ঈর্ষণীয়।
কিন্তু মাত্রাছাড়া সাফল্য জন্ম দেয় ঔদ্ধত্য ও অহংবোধের। রাজনৈতিক প্রশ্রয় আইন অমান্যর সাহস জোগায়। উপেক্ষা করতে শেখায়। ইন্ডিগো এই প্রবণতা থেকে মুক্ত হতে পারেনি। দেশের পাইলটদের সংস্থা অনেক দিন ধরেই পর্যাপ্ত বিশ্রামের দাবি জানাচ্ছিল। আমেরিকা ও ইউরোপ বহু বছর ধরে যা করে চলেছে, দেরিতে হলেও বিমান পরিবহণ নিয়ন্ত্রক সংস্থা (‘ডিজিসিএ’) সেদিকে নজর দেয়। পাইলটদের সপ্তাহে ৩৬ ঘণ্টার জায়গায় ৪৮ ঘণ্টা বাধ্যতামূলক বিশ্রাম, নাইট ল্যান্ডিংয়ের সংখ্যা সপ্তাহে ছয় থেকে কমিয়ে দুইয়ে নামানোর বিধান তাদেরই। নাইট ল্যান্ডিংয়ের সময় আগে ছিল রাত বারোটা থেকে ভোর পঁাচটা, নতুন নিয়মে তা ভোর ছ’টা করা হয়। আর বলা হয়, পর পর দু’দিনের বেশি নাইট ডিউটি পাইলটদের দেওয়া যাবে না। উদ্দেশ্য একটাই, পাইলটরা যাতে তাজা থাকে। ক্লান্তি বোধ না করে। শ্রান্ত-ক্লান্ত পাইলট মানে দুর্ঘটনার সম্ভাবনা বৃদ্ধি। ‘ডিজিসিএ’ এই নতুন ‘ফ্লাইট ডিউটি টাইম লিমিটেশন’ (‘এফডিটিএল’) নিয়ম তৈরি করে ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে। তখনই জানানো হয়েছিল, ৬ মাস পর ১ জুন থেকে নতুন নিয়ম বলবৎ হবে। কিন্তু ইন্ডিগোর অনুরোধে তা পিছনো হয় ২০২৫ সালের ১ মার্চ পর্যন্ত। মার্চে জানানো হয় দু’টি পর্যায়ে নতুন নিয়ম চালু হবে। প্রথম পর্যায় ১ জুলাই, পরেরটি ১ নভেম্বর থেকে।
অথচ সেই ডেডলাইনও ইন্ডিগো মানল না। ডিসেম্বরে শীতকালীন শিডিউল চালু হতে-না-হতেই ভেঙে পড়ল পুরো ব্যবস্থা। বেশি ছুটি মানে বেশি পাইলট। আলু-পেঁয়াজের মতো বাজারে পাইলট মেলে না। সেজন্য পরিকল্পনা দরকার। আগে থেকে প্রস্তুতি প্রয়োজন। কোনওটাই ইন্ডিগো করেনি। ফলে যা হওয়ার তা-ই হল। ২৫ শতাংশ বিমান বাতিল হতে থাকল প্রতিদিন। যাদের দিনে ২৩০০ বিমান ওঠানামা করে তাদের উড়ান সংখ্যা কমে যায় ৫০০-রও বেশি। হাহাকার দেখা দেয় প্রতিটি বিমানবন্দরে।
সরকার হম্বিতম্বি করছে খুব। তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে। জবাবদিহি করতে বলেছে। কিন্তু শাস্তির পথে হঁাটেনি। কী করেই বা হঁাটবে? ইন্ডিগোর বোর্ডে রয়েছেন নরেন্দ্র মোদির ‘ব্লু আইড বয়’ অমিতাভ কান্ত, এই সেদিনও যিনি ছিলেন জি২০-র শেরপা, নীতি আয়োগের সিইও। রয়েছেন মোদি-জমানার (২০১৬-২০১৯) প্রাক্তন এয়ার চিফ মার্শাল বীরেন্দ্র সিং ধানোয়া। আরও রয়েছেন ‘সেবি’-র প্রাক্তন চেয়ারম্যান (২০০৫-২০০৮) মেলেভিটিল দামোদরন।
নতজানু ‘ডিজিসিএ’ ১০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ইন্ডিগোকে সময় দিয়েছে। দিতে হবেই। বিজেপির নির্বাচনী তহবিলে এই বছর তাদের দান ৩১ কোটি টাকা! ‘মনোপলি’ বা ‘ডুয়োপলি’-তে জনতার কাছে তৃতীয়, চতুর্থ বা অন্য কোনও পছন্দ বা বিকল্প থাকে না। জনতা তাদের ইচ্ছায় ওঠাবসা করে। সংকট শুরুর ঠিক আগে খবরে প্রকাশ, সবচেয়ে বড় দুই বিমানবন্দর দিল্লি (জিএমআর) ও মুম্বইয়ে (আদানি) ‘ইউজার ডেভেলপমেন্ট ফি’ (ইউডিএফ) দশগুণ বাড়তে চলেছে। অভ্যন্তরীণ উড়ানে দিল্লিতে টিকিট প্রতি যা এখন ১২৯ টাকা, তা বেড়ে হবে ১২৬১ টাকা। বিদেশ গেলে দিতে হয় টিকিট প্রতি ৬৫০ টাকা, তা হতে চলেছে ৬৩৫৬ টাকা। দেশের ১৩টি সমুদ্রবন্দর আদানি গোষ্ঠীর হাতে। মুম্বই-সহ ৭টি বিমানবন্দরের পরিচালকও তারা।
মোদি-জমানা যত দীর্ঘায়িত হবে, আদানি-আম্বানিদের সাম্রাজ্যও তত বিস্তারলাভ করবে। ইন্ডিগো ও এয়ার ইন্ডিয়া আকাশপথ শাসন করছে। সমুদ্রবন্দরের একচেটিয়া শাসক আদানি। বিমানবন্দরের পরিচালনভার আদানি ও জিএমআর-এর হাতে। ডিটিএইচে সর্বেসর্বা ‘টাটা’ ও ‘এয়ারটেল’। টেলিকমের দুই প্লেয়ার ‘জিও’ ও ‘এয়ারটেল’। গণমাধ্যমের শাসক আদানি ও আম্বানি। সিমেন্ট ইন্ডাস্ট্রিতেও ঢুকেছে আদানিরা। ‘এসিসি’, ‘অম্বুজা’, ‘পেন্না’ ও ‘ওরিয়েন্ট’ সিমেন্ট কিনে তারা এখন শ্বাস ফেলছে ‘আল্ট্রাটেক’-এর ঘাড়ে। ‘শ্রী’ সিমেন্ট ও ‘ডালমিয়া ভারত’ এখনও টিকে আছে, কিন্তু কত দিন টিকবে বলা কঠিন। অ্যাপভিত্তিক ট্যাক্সি সার্ভিসেও দুই প্রধান প্লেয়ার ‘উবার’ ও ‘ওলা’। মাল্টিপ্লেক্সের দখলদার ‘পিভিআর’ ও ‘আইনক্স’। ই-কমার্সে ‘অ্যামাজন’ ও ‘ফ্লিপকার্ট’। খাবার ডেলিভারিতে ‘সুইগি’ ও ‘জোম্যাটো’। ডিজিটাল পেমেন্টে ‘গুগ্ল’ ও ‘ফোনপে’। ‘মনোপলি’ ও ‘ডুয়োপলি’-র তালিকা দীর্ঘায়িত হচ্ছে।
নরেন্দ্র মোদির নতুন ভারতে এটাই ‘সিস্টেমেটিক ফরমুলা’। ‘মনোপলি’ ও ‘ডুয়োপলি’। বাজার থেকে ছোট ও মাঝারিদের সরিয়ে দাও। প্লেয়ার থাকবে একটা বা দুটো। তারাই সবকিছু কন্ট্রোল করবে। রাজনীতির দিকে তাকান। একই প্যাটার্ন। একই মাৎস্যন্যায়। দেশে একটাই দল। একজনই নেতা। একটাই ধর্ম। এক খাদ্যাভ্যাস। একটাই পছন্দ। একজনের ইচ্ছাই শেষ কথা। একজনই সর্বশক্তিমান। বাকিরা এলেবেলে। অকিঞ্চিৎ।
