চলচ্চিত্র জগতে ‘অভিনেতা’ উত্তমকুমারের বাণিজ্যিক সাফল্যের নিশ্চয়তা ছিল, কিন্তু ‘প্রযোজক’ হিসাবে তিনি বরাবরই আর্থিক ঝুঁকি নিয়েছেন। তাঁর প্রযোজনায় ‘আলোছায়া প্রোডাকশন প্রাইভেট লিমিটেড’-এর ব্যানারে প্রথম ছবি ১৯৪২ সালে অস্কার মনোনীত রোম্যান্টিক সিনেমা ‘Random Harvest’-এর গল্প অবলম্বনে ১৯৫৭ সালে অজয় করের নির্দেশনায় উত্তম-সুচিত্রা অভিনীত ‘হারানো সুর’। এই ‘প্রযোজক’ উত্তমকে আমরা কতখানি চিনি? লিখছেন প্রেমেন্দু বিকাশ চাকী।
উত্তমকুমারকে আমরা ‘মহানায়ক’ বলেই জেনে এসেছি। তবে তিনি শুধু সিনেমার অভিনেতা ছিলেন না; ছিলেন প্রযোজক, সুরকার, সুগায়ক, পরিচালক এবং একজন সফল থিয়েটার অভিনেতা। সিনেমার বাইরে তঁার ব্যক্তিগত জীবনের নানা দিক নিয়ে বাঙালির উৎসাহ থাকলেও উত্তমকুমারের অন্যান্য সত্তা সম্পর্কে সাধারণের উৎসাহ যথেষ্ট কম।
অরুণ চট্টোপাধ্যায়, পাড়ায় ‘লুনার ক্লাব’ নামে শখের নাট্যদল গড়ে সেখানে ‘কর্ণার্জুন’-এ শ্রীকৃষ্ণ, ‘দুই পুরুষ’-এ সুশোভন এবং ‘সাজাহান’ পালায় ‘দিলদার’-এর ভূমিকায় অভিনয় করার সঙ্গে সঙ্গে নিয়মিত কলকাতার অন্যান্য দলের নাটক দেখতেন এবং সেসব নাটকের বিষয় ও অভিনয় ধারা নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে রীতিমতো আলোচনা করতেন।
এক সময় তিনি পোর্ট ট্রাস্টের চাকরি সামলে হাতিবাগানের ‘হুজুগে সঙ্ঘ’-এ নিয়মিত রিহার্সালে হাজিরা দিতেন। পরে সেই দলের নাম বদলে হয় ‘কৃষ্টি ও সৃষ্টি’। এই দলের
ভানু চট্টোপাধ্যায় (বন্দ্যোপাধ্যায় নন)-এর পরিচালনায় ‘আজকাল’ নাটকে উত্তম-সাবিত্রী প্রথম একসঙ্গে অভিনয় করেন। তারপর ‘কঙ্কাবতীর ঘাট’ এবং ‘কানাগলি’-তেও ওঁদের জুটি অক্ষুণ্ণ ছিল।
উত্তমকুমারের সঙ্গে অভিনেতা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম সাক্ষাৎ ‘সাড়ে চুয়াত্তর’
-এর ছবির সেটে। তখন থেকেই তঁাদের বন্ধুত্ব এবং পেশাদার সম্পর্ক গড়ে ওঠে, যা পরে বাংলা রঙ্গমঞ্চ এবং সিনেমাতে সফল ছবিতে একসঙ্গে কাজ করার পথ খুলে দেয়। ‘কৃষ্টি ও সৃষ্টি’ এবং ‘উত্তর সারথী’ এই দুই নাট্যদলেই ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় যুক্ত ছিলেন। সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় সে-সময় অভিনয় করতেন ‘উত্তর সারথী’-র প্রযোজনায় ‘নতুন ইহুদি’ নাটকে। সেই নাটকের রিহার্সালে ভানুবাবুর মাধ্যমেই উত্তমকুমারের সাবিত্রী দেবীর সঙ্গে প্রথম পরিচয়। এক সাক্ষাৎকারে সাবিত্রীদি আমাকে বলেছিলেন, প্রথম যেদিন তঁাদের বাড়িতে উত্তমবাবু স্বয়ং উপস্থিত হয়ে তঁার বাবার কাছে মেয়েকে তঁাদের নাট্যদলে অভিনয় করার অনুমতি আদায় করেন, সেই দিনে তঁার অন্তরের একান্ত অনুভূতির কথা। বাবা শর্ত দিয়েছিলেন– মেয়েকে বাড়ি থেকে নিয়ে যেতে হবে, নাটক শেষে বাড়ি পৌঁছে দিতে হবে, সঙ্গে কিছু পয়সা। প্রস্তাব শুনে উত্তমবাবু এককথায় রাজি।
এরপর ১৯৫৩ সালে ১৫ অক্টোবর দুর্গাপুজোর সময় বাংলার পেশাদার মঞ্চে উত্তমকুমারের পদার্পণ। ‘স্টার থিয়েটার’-এ নিরুপমা দেবীর ‘শ্যামলী’ নাটকে নায়ক ‘অমল’-এর চরিত্রে তিনি এবং বিপরীতে নায়িকা ‘শ্যামলী’ চরিত্রে সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় অভিনয় করেছিলেন। অমলের মা সরলার চরিত্রে ছিলেন নাট্যসম্রাজ্ঞী সরযূবালা দেবী সঙ্গে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়।
‘বসু পরিবার’ ও ‘সাড়ে ৭৪’ ছবি মুক্তি হওয়ার ফলে বাংলার দর্শকদের সঙ্গে উত্তম এবং ভানুর জনপ্রিয়তার দরুন স্বল্প সময়েই নাটক জমে উঠে। এই প্রসঙ্গে বলতে হয় তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ডা. বিধানচন্দ্র রায় একদিন এই নাটক দেখা শেষে গ্রিনরুমে গিয়ে উত্তমবাবুর নতুন নামকরণ করলেন ‘শ্যামল’। পরবর্তীতে তিনি উত্তমকুমারকে ওই নামেই ডাকতেন।
সেই সময়ের প্রতিটা সন্ধ্যায় উত্তম তঁার অভিনয় দেখে দর্শকের প্রতিক্রিয়াকে ভীষণভাবে গুরুত্ব দিতেন। মঞ্চ-ই তঁার অভিনয়ে নিজস্বতার প্রতি আত্মবিশ্বাস গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিল। সপ্তাহে চারটে করে শো টানা তিন বছরে মোট ৪৮৪ ‘রজনী’ অভিনয় করার পর হঠাৎই তঁার শারীরিক সমস্যা দেখা দেওয়ায় সাময়িকভাবে তিনি মঞ্চ থেকে বিদায় নিতে বাধ্য হন। উত্তমকুমারের বিকল্পে ‘অমল’-এর চরিত্রে ম্যাডান থিয়েটারের গায়ক-নায়ক নির্মলেন্দু লাহিড়ীর ছেলে নবকুমার যথেষ্ট দক্ষতার অভিনয় করেও দর্শকের মন জয় করতে পারেননি।
উত্তমকুমার বৈচিত্র এনেছিলেন বাংলা সিনেমার প্রযোজনার ক্ষেত্রেও। বাংলা ছবির মানোন্নয়ন ও স্বাধীন সৃজনশীল কাজের জন্য তিনি স্বেচ্ছায় প্রযোজনার দায়িত্ব নেন। তঁার প্রযোজনায় আমরা পেয়েছি ‘হারানো সুর’ (১৯৫৭), ‘সপ্তপদী’ (১৯৬১), ‘উত্তর ফাল্গুনী’ (১৯৬৩), ‘ভ্রান্তি বিলাস’(১৯৬৩), ‘জতুগৃহ’ (১৯৬৪), ‘গৃহদাহ’ (১৯৬৭)। প্রযোজক হিসাবে তিনি তঁার প্রায় প্রতিটি ছবিকে শুধু আর্থিক সাফল্য দেখাননি, এর অতিরিক্ত সাধারণ দর্শক-সমালোচকদের প্রশংসা এবং বাংলা সিনেমাকে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরে পৌঁছে দিয়েছেন। তঁার সাহসী উদ্যোগের জন্য তঁাকে সম্মান করা হয়, কারণ তিনি মূলধারার বাইরে গিয়ে সাহিত্যনির্ভর ও নান্দনিক ছবি প্রযোজনা করেছিলেন। অর্থাৎ, নায়ক হিসাবে তিনি দর্শকের হৃদয়ে চিরস্থায়ী জায়গা দখল করার সঙ্গে সঙ্গে প্রযোজক হিসাবে চলচ্চিত্র জগতের মান উন্নত করেছিলেন।
চলচ্চিত্র জগতে ‘অভিনেতা’ উত্তমকুমারের বাণিজ্যিক সাফল্যের নিশ্চয়তা ছিল, কিন্তু ‘প্রযোজক’ হিসাবে তিনি বরাবরই আর্থিক ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছিলেন। তঁার প্রযোজনায় ‘আলোছায়া প্রোডাকশন প্রাইভেট লিমিটেড’-এর ব্যানারে প্রথম ছবি ১৯৪২ সালে অস্কার
মনোনীত রোম্যান্টিক সিনেমা ‘Random Harvest’-এর গল্প অবলম্বনে ১৯৫৭ সালে অজয় করের নির্দেশনায় উত্তম-সুচিত্রা অভিনীত ‘হারানো সুর’। এই ছবি ভারতের জাতীয় পুরস্কারের মঞ্চে পুরস্কৃত হয়েছিল।
১৯৬১ সালে সেই একই পরিচালক ও অভিনেতা-অভিনেত্রীর ত্রয়ীতে হল ‘সপ্তপদী’। এই ছবি শুধু ভারতীয় জাতীয় পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে এমনটা নয়, মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের ‘সেরা অভিনেত্রী’-র শিরোপা লাভ করেছিলেন সুচিত্রা সেন। ‘আলোছায়া প্রোডাকশন প্রাইভেট লিমিটেড’-এর নাম পরিবর্তন করে হল ‘উত্তমকুমার ফিল্মস প্রাইভেট লিমিটেড’। এই প্রতিষ্ঠানের প্রথম প্রযোজনায় উইলিয়ম শেক্সপিয়রের ‘কমেডি অফ এররস’ অবলম্বনে ১৯৬৩ সালে ‘ভ্রান্তিবিলাস’। একই গল্প হিন্দিতে ১৯৬৮ সালে কিশোরকুমার-তনুজা অভিনীত ‘দো দুনি চার’, আবার ১৯৮২-তে সঞ্জীবকুমার, মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় এবং দীপ্তি নাভাল অভিনীত ‘আঙ্গুর’ নির্মাণ হয়।
১৯৬৩-তেই পরিচালক অসিত সেনের সুচিত্রা (দ্বৈত ভূমিকায়) ও বিকাশ রায় অভিনীত নীহাররঞ্জন গুপ্তর কাহিনি অবলম্বনে ‘উত্তর ফাল্গুনী’ মুক্তি পায়। প্রযোজক উত্তমকুমার বিশেষ কারণবশত এই সিনেমায় অভিনয় করেননি। ১১তম জাতীয় চলচ্চিত্র উৎসবে এই ছবি শ্রেষ্ঠ বাংলা ছবির পুরস্কার অর্জন করে। পরবর্তীতে অসিত সেন হিন্দি ভাষায় এই একই গল্পে ‘মমতা’ (১৯৬৬) করেছিলেন। হিন্দি ছাড়াও এই গল্প অবলম্বনে তামিল এবং মালয়ালি ভাষাতেও সিনেমা হয়েছে।
পরবর্তী প্রযোজনায় উত্তম বেছে নিলেন সুবোধ ঘোষের কাহিনি। সেই ছবির পরিচালনার আরজি জানালেন তপন সিংহ-কে। উত্তম-সুচিত্রা জুটির বাইরে গিয়ে উত্তম-অরুন্ধতীর জুটিতে ১৯৬৪ সালে মুক্তি পেল ‘জতুগৃহ’। এই ছবি ১২তম জাতীয় পুরস্কারের মঞ্চে ‘সার্টিফিকেট অফ মেরিট’ লাভ করে। এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভাল যে, সেই বছর সত্যজিৎ রায়ের ‘চারুলতা’ সর্ব ভারতীয় সিনেমা জগতে শ্রেষ্ঠ পূর্ণদৈর্ঘ্যর জাতীয় চলচ্চিত্রের জন্য ‘স্বর্ণকমল’ লাভ করেছিল।
এখন এ-কথা আমরা বলতেই পারি যে, উত্তমকুমারের প্রযোজিত সবক’টা বাংলা ছবি সর্বসাফল্যময় ছিল। শিল্পমান ও পুরস্কারের নিরিখে যতটা সফল এবং প্রশংসা লাভ করেছিল, অন্যদিকে হিন্দিতে ‘ছোটি সি মুলাকাত’ প্রযোজনা করে ঠিক ততটাই ব্যর্থ হয়েছিলেন। সেই অসফলতা তঁার উপর দীর্ঘমেয়াদি ঋণ এবং শরীর ও ব্যক্তিগত জীবনে বাড়তি বোঝা হয়ে চেপে বসে।
উত্তম-সুচিত্রা এবং প্রদীপকুমার অভিনীত ‘গৃহদাহ’ ছবির শুটিং শেষ হয়েছিল বছর তিন আগে, কিন্তু তঁার সর্বশেষ প্রযোজিত অসফল হিন্দি ছবি ‘ছোটি সি মুলাকাত’ (১৯৬৭)-এর পর একই বছর সে ছবি মুক্তি পায়। ‘গৃহদাহ’-র ব্যবসায়িক সাফল্য এবং শ্রেষ্ঠ অভিনেতার স্বীকৃতি (BFJA) সে সময় তঁাকে কিছুটা অক্সিজেন জুগিয়েছিল। অভিনেতা উত্তমকুমারের খ্যাতি যদি তঁাকে জনমনে ‘চিরকালীন’ করে রাখে, তবে প্রযোজক উত্তমকুমার বাংলা সিনেমাকে জুগিয়েছেন
গভীরতা ও স্থায়িত্ব।
ছয়ের দশকের শেষদিকে বাংলা ছবির জগতে এক বিরাট টালমাটাল অবস্থা। বাংলা ছবির স্বার্থরক্ষার জন্য প্রযোজক এবং শিল্পীদের নিয়ে গড়ে উঠে ‘পশ্চিমবঙ্গ চিত্রশিল্প সংরক্ষণ সমিতি’। বিরোধ বাধল সমিতির সঙ্গে সিনেমা হল-মালিক বা প্রদর্শকদের। ঘটনার সূত্রপাতের কারণ বাংলা সিনেমা না দেখিয়ে বছরের পর বছর ধরে হল-মালিকরা নির্দ্বিধায় হিন্দি ছবি চালিয়ে যাচ্ছিলেন। সেই সময় নিয়ম ছিল ছবির সেন্সর সার্টিফিকেটে উল্লিখিত দিনের ক্রমানুযায়ী পরপর ছবি মুক্তি পাবে।
কিছু হল-মালিক সে নিয়মের তোয়াক্কা না করে পিছনের ছবিকে আগে নিয়ে এসে ইচ্ছেমতো মুক্তি করে। এই অবস্থা দেখে সিনেমা-হল শ্রমিকরা ধর্মঘট ডাকে। ফলে সব ছবি মুক্তি বন্ধ হয়ে যায়। সে-সময় অন্যান্য ছবির সঙ্গে উত্তমকুমারের ‘চৌরঙ্গী’, ‘তিন অধ্যায়’, ‘গড় নাসিমপুর’ তিনটে ছবি মুক্তি আটকে যায়। ধর্মঘট মিটে গেলে ‘তিন অধ্যায়’ এবং ‘চৌরঙ্গী’ একই মাসে মাত্র কয়েক দিনের তফাতে মুক্তি পেয়েছিল।
তখন বাংলা সিনেমার অভিনেতাদের একমাত্র সংগঠন ‘অভিনেতৃ সঙ্ঘ’। এই সংগঠনের সভাপতি ছিলেন উত্তমকুমার। সিনেমা জগতের টালমাটাল পরিস্থিতিতে সংগঠনের সদস্যদের মধ্যে মতান্তর থেকে ক্রমশ বিষয়টা মনান্তরের চরম পর্যায়ে চালিত হওয়ায় উত্তমকুমার ‘অভিনেতৃ সঙ্ঘ’-র সভাপতি পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে ‘শিল্পী সংসদ’ নামে পৃথক সংগঠন গড়ে তোলেন। ‘শিল্পী সংসদ’-এ সিনেমা শিল্পীদের সঙ্গে বঙ্গ সংস্কৃতির অন্যান্য বিভাগের এমনকী থিয়েটার এবং যাত্রার বহু শিল্পী যোগ দেন। উত্তমবাবুর নেতৃত্বে এই সংগঠনের মূল উদ্দেশ্য ছিল দুঃস্থ চলচ্চিত্র শিল্পকর্মীদের সংগঠিত করে তঁাদের জন্য গঠনমূলক কাজের মাধ্যমে আর্থিক ও সামাজিক সহায়তা করা। একই সঙ্গে অভিনেতা এবং কলাকুশলীদের সম্মিলিত অংশগ্রহণে মানসম্মত বাংলা ছবি তৈরি করা।
শিল্পী ও কলাকুশলীদের অর্থসাহায্যের প্রয়োজনে ‘শিল্পী সংসদ’ নিয়মিত নাটক মঞ্চস্থ করত। ফলে উত্তমকুমারের অন্তরে নাট্যচর্চার সুপ্ত বাসনা এই সংস্থার নাটক পরিচালনার মধ্য দিয়ে অনেকটাই পূরণ করে নিতেন। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যেতে পারে ১৯৭২ সালে বঙ্গ রঙ্গমঞ্চের শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে ‘শিল্পী সংসদ’ পরপর তিন সন্ধ্যায় বিশ্বরূপা মঞ্চে ‘চারণকবি মুকুন্দ দাস’, ‘সাজাহান’ (নাম ভূমিকায় অভিনয় করেন ঠাকুরদা মিত্র, ঔরঙ্গজেবের ভূমিকায় ছিলেন মহেন্দ্র গুপ্ত এবং দিলদারের ভূমিকায় বিকাশ রায়) এবং ‘চরিত্রহীন’ মঞ্চস্থ হয়। এই তিনটে নাটক শুধুমাত্র পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন উত্তমকুমার। বাংলার নাট্য ইতিহাসের এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ, যা থিয়েটারের প্রতি বাঙালি দর্শকের আবেগ ও আগ্রহে নাড়া দিয়েছিল। পরবর্তীর প্রযোজনা ‘আলিবাবা’। সেখানে ‘বাবা মুস্তাফা’ কুৎসিতদর্শন এক বৃদ্ধ মুচির মাত্র দুটো সিনে অভিনয় করে সেদিন রবীন্দ্র সদনের উপস্থিত সকল দর্শককে চমকে দিয়েছিলেন উত্তমকুমার।
‘শুধু একটি বছর’ রোম্যান্টিক-সামাজিক ঘরানার এই ছবি দিয়ে চলচ্চিত্র পরিচালক উত্তমকুমারের আত্মপ্রকাশ। ১৯৬৬ সালের প্রেক্ষাপটে এই ছবি বাণিজ্যিকভাবে যথেষ্ট সফল হয়। ‘শিল্পী সংসদ’-এর প্রযোজনায় তঁার দ্বিতীয় ছবি ‘বনপলাশীর পদাবলী’। রমাপদ চৌধুরীর কাহিনি অবলম্বনে এই ছবি পরিচালনার প্রাথমিক দায়িত্ব বর্তেছিল ঋত্বিক ঘটকের উপর। তিনি সম্মতি দিয়ে অগ্রিম গ্রহণ করা সত্ত্বেও শারীরিক অসুস্থতার কারণে ছবিটা করে উঠতে পারেননি। কিন্তু উত্তমের সঙ্গে ঋত্বিকের যে এই ছবির বিষয়ে গভীর অলোচনা হয়েছিল, তার প্রতিফলন উত্তমের লেখা চিত্রনাট্য, আবহসংগীত এবং পরিচালনায় ভীষণভাবে ধরা পড়ে।
রমাপদ চৌধুরী উপন্যাসে মূলত আদর্শবাদ বনাম বাস্তবতার সংঘাত, এবং গ্রামীণ অবক্ষয়ের কাহিনি তুলে ধরেছিলেন। সেখানে উত্তমকুমার সিনেমার ভিজু্যয়াল ন্যারেটিভে সমাজ, গ্রামের রাজনীতি, আবেগ ও হিংসার জটিল উপাদান নিয়ে অনেক বেশি মানবিক-নাটকীয় দিক ফুটিয়ে তুলেছেন। ব্যক্তিগত প্রেম ও প্রতিশোধ-রোমাঞ্চ নাটকীয় ভাষাকে প্রাধান্য দিয়ে মনস্তত্ত্ব ও আবেগের বিচিত্র মেলবন্ধনে এক অসাধারণ ক্যানভাস তৈরি করেছিলেন তিনি। ট্র্যাজেডিকে প্রাধান্য দিলেও একই সঙ্গে ছবিতে নান্দনিক পূর্ণতাও রয়েছে বলেই সমালোচকরা বলেছিলেন, ‘এই চলচ্চিত্র নির্মাণে উত্তমকুমারের প্রতিভা বহুস্তরীয়, যা পূর্বের পরিচালনা থেকে প্রগতিশীল এবং গ্রামীণ-অঞ্চলের বাস্তবতাকে উচ্চমাত্রায় উপস্থাপন করেছে।’
‘শিল্পী সংসদ’-এর ব্যানারে পরবর্তী প্রযোজনা শৌনক গুপ্তর ‘শীত গ্রীষ্ম অনেক ঋতু’ কাহিনি অবলম্বনে ‘দুই পৃথিবী’। পরিচালক পীযূষ বসু।
তখন ‘শিল্পী সংসদ’-এর তহবিল ছিল খুব সীমিত। কোনও বড় প্রযোজনা সংস্থা বা বিতরণ সংস্থা এই গল্পে বিনিয়োগ করতে রাজি হয়নি। অগত্যা উত্তমকুমার স্বয়ং সংসদের সবাইকে বলেন, ‘এই ছবি আমরা আমাদের নিজের ঘর থেকে বানাব, পারিশ্রমিকের জন্য নয়, শিল্পীর সম্মানের জন্য।’ ফলে এই ছবিতে অংশ নেওয়া শিল্পীরা তঁাদের সংগঠনের প্রতি ঐক্য ও দায়বদ্ধতার কারণে পারিশ্রমিক ছাড়াই অভিনয় করেছিলেন। একেই বলে ‘সম্মিলিত আত্মনিবেদন’। ‘দুই পৃথিবী’ শুধু সামাজিক বৈষম্যের সিনেমা নয়– এটা একদিকে ‘শিল্পী সংসদ’-এর আদর্শ ও ঐক্যের প্রকাশ, অন্যদিকে বাংলা চলচ্চিত্র শিল্পের সংগ্রামী মুখের প্রতিচ্ছবি। সে-সময় তঁারা প্রমাণ করেছিলেন চলচ্চিত্র শুধুমাত্র ব্যবসা নয়, চলচ্চিত্র শিল্প ও সমাজচেতনার অন্যতম স্তম্ভ।
উত্তমকুমারের পরিচালিত তৃতীয় ছবি ‘কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী’। নীহারঞ্জন গুপ্ত-র কাহিনি অবলম্বনে এই ছবির শুটিং শুরু করেছিলেন পীযূষ বসু, কিন্তু অকস্মাৎ তঁার মৃত্যুতে পরিচালনার দায়িত্ব নেন স্বয়ং উত্তমকুমার। এই সিনেমা সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই উত্তমকুমারের মৃত্যু হয়। পরবর্তীতে কলাকুশলীরা ছবিটা সম্পন্ন করেছিলেন। মহানায়কের মৃত্যুর পর এই ছবি শুধু ব্যবসায়িক সফলতার লাভ করেছে এমনটা নয়, রাহুল দেববর্মণের সুরে ছবির গান এখনও ভীষণ জনপ্রিয়।
উত্তমকুমার প্রমাণ করেছিলেন যে, তিনি শুধু রোম্যান্টিক নায়ক নন, বরং চলচ্চিত্র নির্মাণের নান্দনিক দিকটাও সম্পূর্ণ আয়ত্ত করেছিলেন। তঁার প্রযোজনা এবং পরিচালনা– উভয়ক্ষেত্রেই সাহিত্যের সঙ্গে সিনেমার সেতুবন্ধন রয়েছে। প্রায় সব ছবিতেই তিনি অভিনয় করেছেন, ফলে পরিচালনা ও চরিত্রাভিনয়ের মধ্যে ভারসাম্য রাখাটা তঁার কাছে একটা বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। তঁার পরিচালনায় নিজের ‘স্টার ইমেজ’ ভাঙার চেষ্টা কম হলেও, ন্যারেটিভ ও সাহিত্যকেন্দ্রিক বিষয়বস্তুর প্রতি তঁার দায়বদ্ধতা স্পষ্ট। পরিচালনা জীবনে ছবির সংখ্যা কম, কিন্তু তঁার প্রতিটি ছবিই দর্শক-সমালোচক উভয়ের কাছে এখনও বিশেষভাবে আলোচিত হয়।
(মতামত নিজস্ব)
লেখক চিত্র পরিচালক
pbchaki@gmail.com
