ইউরোপ জুড়ে যখন দক্ষিণপন্থার জয়গাথা লেখা শুরু হয়েছে, তখন ব্রিটেন ও ফ্রান্সের সংসদীয় নির্বাচনের ফল রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের নজর কাড়ছে। লিখলেন সুতীর্থ চক্রবর্তী।
ইউরোপ জুড়ে দক্ষিণপন্থীদের উত্থান ঘটছে বলে যখন বিশ্বজুড়ে হইচই, তখন আচমকা ব্রিটেন ও ফ্রান্সের ভোটের ফল এক অন্যরকম বার্তা নিয়ে এসেছে বিশ্ব রাজনীতিতে। ব্রিটেনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় ফিরে এসেছে বামেদের দিকে ঝুঁকে থাকা মধ্যপন্থী দল হিসেবে পরিচিত ‘লেবার পার্টি’। ফ্রান্সের ভোটে এগিয়ে বাম নেতৃত্বাধীন জোট ‘নিউ পপুলার ফ্রন্ট’। ফ্রান্সের সংসদীয় নির্বাচনে কোনও দলই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাক্রেঁার মধ্যপন্থী দল দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। কিন্তু সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হল মারিন লো পেনের দক্ষিণপন্থী ‘ন্যাশনাল র্যালি’-র পরাজয়। তারা তৃতীয় স্থানে চলে গিয়েছে।
ইউরোপ জুড়ে এখন দু’টি ইসু্য প্রাধান্য বিস্তার করেছে রাজনীতিতে। প্রথমটি জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি, দ্বিতীয়টি অভিবাসন ও শরণার্থী সমস্যা। এই দুই ক্ষেত্রেই একটা চরমপন্থী অবস্থান নিয়ে কিছু দিন ধরে জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করছে দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দলগুলি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে অতি-দক্ষিণপন্থী রাজনীতির প্রতি ইউরোপের যে ভীতি তা-ও কাটতে শুরু করেছে বিভিন্ন দেশে। দক্ষিণপন্থীরাও অবশ্য আগের অবস্থানে দঁাড়িয়ে নেই। ‘স্কিনহেডস’, ‘নিও নাৎসি’ ইত্যাদি গোষ্ঠীর মোড়ক ছেড়ে দক্ষিণপন্থী দলগুলি জাতীয়তাবাদী ও জনবাদী রাজনীতির পরিচিত ছকে কাজ শুরু করেছে। মূলধারার রাজনীতির অঙ্গ হয়ে উঠছে। ইউরোপের দক্ষিণপন্থী দলগুলির সঙ্গে বিজেপির মিল দেখতে পাওয়া যায়। নরেন্দ্র মোদির অামলে বিজেপির সঙ্গে অধুনা জনপ্রিয় হয়ে ওঠা ইউরোপের দক্ষিণপন্থী দলগুলির বিশেষ তফাত নেই। ইতিমধে্য এহেন দক্ষিণপন্থী দলগুলি ক্ষমতায় এসেছে– ইতালি, ফিনল্যান্ড, স্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরি, ক্রোয়েশিয়া, চেক ইত্যাদি দেশে। সম্প্রতি চরম দক্ষিণপন্থী দল ক্ষমতায় এসেছে নেদারল্যান্ডসে।
[আরও পড়ুন: ভারতীয় ফুটবলপ্রেমীদের জন্য সুখবর! কোপার শেষ পর্ব হয়তো দূরদর্শনে]
ইউরোপ জুড়ে যখন দক্ষিণপন্থার জয়গাথা লেখা শুরু হয়েছে, তখন ব্রিটেন (UK) ও ফ্রান্সের (France) সংসদীয় নির্বাচনের ফল রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের নজর কাড়ছে। ব্রিটেনে ব্রেক্সিটের হাওয়ায় গত নির্বাচনে বিপুল জয় হয়েছিল বরিস জনসনের ‘কনজারভেটিভ পার্টি’-র। কিন্তু সেই ব্রেক্সিট-বিরোধী হাওয়াই এবারে ভরাডুবি ঘটিয়েছে তাদের। লেবার পার্টি ৪০০ পার করে ঐতিহাসিক জয় পেয়েছে। উল্লেখযোগ্য হল, বামপন্থী হিসাবে পরিচিত ‘লিবারাল ডেমোক্র্যাট’-রাও এবার রেকর্ড সংখ্যক আসনে জিতেছে।
ব্রিটেনের রাজনীতিতে এই ফলকে দক্ষিণপন্থার পরাজয় হিসাবে দেখা হচ্ছে। যদিও ‘কনজারভেটিভ পার্টি’ ও নাইজেল ফারাজের ‘ইউকে রিফর্মস’ পার্টির ভোট যোগ করে কোনও কোনও মহল থেকে বলা হচ্ছে– সামগ্রিকভাবে দক্ষিণপন্থীরা উদার মধ্যপন্থী ‘লেবার পার্টি’ ও বামেদের চেয়ে বেশি ভোট পেয়েছে। নাইজেল ফারাজের দল বিভিন্ন কেন্দ্রে দক্ষিণপন্থী ভোট ভেঙে দিয়ে ঋষি সুনকের ‘কনজারভেটিভ পার্টি’-র জয়ের কঁাটা হয়েছে। কিন্তু সংসদীয় রাজনীতির ওয়েস্টমিনস্টার মডেলে কে বেশি সংখ্যক আসন জিতল, সেটাই বিচার্য। কার কত শতাংশ ভোট, সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। ব্রিটেনের ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে, ব্রেক্সিট ও সুনকের করা অভিবাসন নীতির কুফল মানুষ উপলব্ধি করছে। ব্রেক্সিট করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসার মূল্য চোকাতে হচ্ছে ব্রিটেনের সাধারণ মানুষকে।
[আরও পড়ুন: বিদেশ নয়, দেশের মাটিতেই ‘ড্রিম হোম’, ভারত ছাড়ার জল্পনার মাঝেই পোস্ট বিরাটের]
জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে অস্বাভাবিক হারে। কড়া অভিবাসন নীতি মেনে নিতে চাইছেন না বয়স্ক নাগরিকদের বড় অংশ। কারণ, টান পড়ছে বিভিন্ন পরিষেবায়। তবে ৬৫০ আসনের ‘হাউস অফ কমন্স’-এ যে এবার ‘লেবার পার্টি’ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে চলেছে, তা অনেক দিন ধরেই স্পষ্ট হচ্ছিল। ব্রিটেনে লেবারদের জয় দিয়ে ইউরোপের সার্বিক রাজনীতি ব্যাখ্যা করতে অনেকেই রাজি নন। কারণ কনজারভেটিভদের বিরুদ্ধে একটানা ১৪ বছরের শাসনের ফলে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতাও সক্রিয় ছিল।
ব্রিটেনের নির্বাচনের ফল অনেকটা প্রত্যাশিত হলেও ফ্রান্স সারা দুনিয়াকে আলোড়িত করে দিয়েছে। কয়েক দিন আগে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভোটে ফ্রান্সে দক্ষিণপন্থী মেরিন লো পেনের ‘ন্যাশনাল র্যালি’-র বিরাট জয় হয়েছিল। সেই জয় দেখে সংবাদমাধ্যম ইউরোপে দক্ষিণপন্থার উত্থান নিয়ে লেখালিখি বেড়ে গিয়েছিল। ‘ন্যাশনাল র্যালি’-র জয়ে কিছুটা চাপে পড়ে সংসদ ভেঙে দিয়ে অন্তর্বর্তী নির্বাচনের ডাক দিয়েছিলেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাক্রেঁা। রাজনৈতিক মহলে বলা হচ্ছিল, ২০২৭ সালে তঁার নিজের নির্বাচনকে কণ্টকমুক্ত করতে মাক্রেঁা সংসদের অন্তর্বর্তী ভোট ডেকে একটি জুয়া খেলতে চাইছেন। অর্থাৎ, মাক্রেঁা জানেন যে, সংসদে দক্ষিণপন্থী লো পেনের দল ‘ন্যাশনাল র্যালি’ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে, তবুও তিনি সংসদের ভোট ডেকেছেন এই কারণে যে, ’২৭ সালের ভোটে সরকারের যাবতীয় ব্যর্থতার দায় পেনের ঘাড়ে দিয়ে তিনি ফের ভোটে জিতবেন। সংসদের প্রথম পর্বের ভোটে এগিয়েই ছিলেন লো পেন। কিন্তু সব হিসাব ওলটপালট রবিবারের দ্বিতীয় পর্বের ভোটে। বিশ্বকে চমকে দিয়ে ৫৭৭ সদসে্যর ফরাসি সংসদে ১৮২টি আসন জিতে বৃহত্তম জোট হয়েছে বামপন্থীদের নিউ পপুলার ফ্রন্ট। মধ্যপন্থী মাক্রেঁার দল পেয়েছে ১৬৩টি আসন। আর লো পেনের ‘ন্যাশনাল র্যালি’ জিতেছে মাত্র ১৪৩টি আসন।
‘ন্যাশনাল পপুলার ফ্রন্ট’ বৃহত্তম জোট হিসাবে নির্বাচিত হলেও মাক্রেঁা বামপন্থীদের হাতে ক্ষমতা ছাড়তে নারাজ। ফ্রান্সের রাজনীতিতে এখন অনেক উথালপাথাল আসন্ন। হেরে গেলেও পিছু হটতে রাজি নন দক্ষিণপন্থী লো পেন। তঁার দাবি, ‘দক্ষিণপন্থার ঢেউ উঠছে। এখনও সেটা যথেষ্ট উচ্চতায় ওঠেনি ঠিকই, কিন্তু তার উচ্চতা ক্রমশই বাড়ছে। এটাকে বলা চলে আমাদের বিলম্বিত জয়।’ কেন ফ্রান্সের ফল এইরকম হল তার কাটাছেঁড়া শুরু হয়ে গিয়েছে। ব্রিটেনের ফলের সঙ্গে অনিবার্য তুলনা টানা হচ্ছে। ফরাসি নাগরিকদের বড় অংশের মত, দক্ষিণপন্থী দলের অভিবাসন নীতিকে সমর্থন দিতে নারাজ দেশের প্রবীণ ও বয়স্করা। প্রথম পর্বের ভোটের পর তঁারাই জোট বেঁধে দক্ষিণপন্থীদের পরাজয় সুনিশ্চিত করেছেন।
ভোটের ফল ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এক দীর্ঘ দিনের বঙ্গসন্তান প্যারিসবাসীর কথায়, ‘আমাকে এক সাদা চামড়ার ফরাসি বলেছিলেন, আসলে আমরা ফরাসিরা সবসময় শুধু সাদা দেখতে চাই। আমরা চাই মরক্কো ও আফ্রিকার কালো মানুষগুলি এসে আমাদের দেশের রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি ইত্যাদির সব আবর্জনা সরিয়ে, নতুন রাস্তাঘাট বানিয়ে, সব কায়িক পরিশ্রমের কাজগুলি করে আবার রাতের অন্ধকারেই প্লেনে করে তাদের নিজের নিজের দেশে ফিরে যাক।’ আসলে প্রবীণ ফরাসিরা উপলব্ধি করছেন যে, অভিবাসীদের না-স্বীকার করলে বিপন্ন হবে দেশের যাবতীয় পরিষেবা। বিধ্বস্ত হবে অর্থনীতিও। ঠিক ব্রিটেনবাসীকে যেমন ব্রেক্সিটের মূল্য চোকাতে হচ্ছে। এই উপলব্ধি থেকেই নারাজ তারা দক্ষিণপন্থীদের ক্ষমতায় আনতে।
মোদ্দা কথা, ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মানুষ উগ্র দক্ষিণপন্থীদের অভিবাসন নীতির বিরুদ্ধেই রায় দিয়েছে। যে অভিবাসন নীতিকে হাতিয়ার করে ইউরোপের দেশে-দেশে দক্ষিণপন্থী দলগুলি এগিয়ে চলেছে, সেই নীতি ধাক্কা খেয়েছে ব্রিটেন ও ফ্রান্সে। এর ঢেউ এখন ইউরোপের অন্যান্য দেশ ও আমেরিকার ভোটেও কীভাবে পড়ে তা নজর রাখার।