২০২৪ সালে ভারত এক ‘নতুন’ হিন্দুত্ববাদী নির্মাণ-আলেখ্যর সাক্ষী হতে চলেছে। অযোধ্যায় ৭০ একর জমির উপর তৈরি ১৬১ ফুট উঁচু রামলালা মন্দিরের প্রাণপ্রতিষ্ঠা হবে ২২ জানুয়ারি। যে মন্দির তৈরির খুঁটি পোঁতা হয়েছিল আডবাণী-বাজপেয়ী যুগে। আর, দেশপ্রেমের এই অাখ্যান ১৪০ কোটি মানুষকে গিলিয়ে নিতেও প্রচেষ্টার অন্ত নেই। লিখলেন জয়ন্ত ঘোষাল
ইদানীং আমাদের দেশে যেন নতুন করে ‘প্রাদুর্ভাব’ ঘটেছে হিন্দু ধর্মের! আধুনিক শব্দকোষে এর নতুন নামকরণ ‘হিন্দুত্ব’। হিন্দু ধর্ম আগেও ছিল, তবে তা নিয়ে আমাদের শঙ্কিত হয়ে ওঠার কারণ ছিল না। মঙ্গলবার অলাবু ভক্ষণের নিষেধের মধে্য, অশ্লেষা আর ত্র্যহস্পর্শে হিন্দু ধর্ম ছিল, তবু আমরা ত্র্যস্ত ছিলাম না। সেদিনও বীর সাভারকারের রাজনৈতিক হিন্দুত্ব ছিল, সেদিনও দেশহিতৈষীরা ধর্মরক্ষার জন্য হইচই করে দাঙ্গা বাধিয়ে দিত।
যে কোনও দাঙ্গাই পীড়াদায়ক। তা সে নোয়াখালি হোক বা গোধরা। তবে মানুষের ভুলে যাওয়া আর ভুলে থাকার ক্ষমতা অসাধারণ। আমরাও ভুলে যেতাম, ভুলে থাকতাম। সুখে-দুঃখে দিন কেটে যেত আমাদের। ২০১৪ সাল থেকে অবস্থা পালটেছে। ’৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই দেশ বদলাচ্ছে। জওহরলাল নেহরু ভেবেছিলেন ইস্পাত কারখানা-শিল্প-শিক্ষার উন্নয়নই হল নতুন ভারতের নতুন ধর্ম। উগ্র ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র হিন্দু ধর্মের অনাচার-অধর্ম হল ঔপনিবেশিকতাবাদ।
[আরও পড়ুন: রাইমার সিনেমা দেখতে বলছেন মোদি, লোকসভা ভোটের আগে কেন এই টোটকা প্রধানমন্ত্রীর?]
২০২৩ বিদায় নিয়ে ২০২৪ সমাসন্ন। ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের যুদ্ধের আগে ‘হিন্দু ধর্ম’, যাকে এখন আমরা বলি ‘হিন্দুত্ব’, তা শুধু তো রাজনৈতিক রূপ নয়, নতুন সামাজিক রূপ নিয়েছে। আমরা বলছি, ‘মোদি গ্যারান্টি’। হিন্দু জাতীয়তাবাদের কথা শুনেছিলাম আমরা, হিন্দু সোশালিজমের কথাও কানে এসেছিল কিন্তু হিন্দু রাষ্ট্রবাদের মোদি গ্যারান্টি– এ এক অভিনব দুর্দান্ত প্যাকেজ। ২০১৪ সালে মোদি ক্ষমতায় আসার আগে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরব হওয়া প্রশাসনিক নীতিপঙ্গুতার বিপ্রতীপে সেই কড়াপাক রেসিপির নাম দেওয়া হয়েছিল ‘মোদিত্ব’।
সেই মোদিত্বের উপাদানে ছিল রাষ্ট্রবাদ+শক্তিশালী দেশশাসক+সনাতনী হিন্দুত্ব। এর পর দশ বছর অতিবাহিত। ২০১৯-এর ভোটেও বিরোধীদের আশায় ছাই ঢেলে মোদি আরও বিপুল ভোটে জিতেছেন। সেবারও নির্বাচনী রাজনীতির বিপণনের মূল থিম ছিল এক। কিন্তু তা আরও সময়োপযোগী। বিজ্ঞাপনে যেমন অমুক দঁাতমাজন বা তমুক ডিটারজেন্টের পর জুড়ে দেওয়া হয় ‘প্লাস’ শব্দটি, তেমনই ২০১৯ মোদি প্লাস। পুলওয়ামা আক্রমণ, পাকিস্তান বিরোধিতা, উগ্র-সংখ্যালঘু বিরোধিতার জন্য নাগরিকত্ব বিলের প্রচার। আবার জিতলেন মোদি। বিজেপি হল ‘থ্রি নট থ্রি’ পার্টি।
[আরও পড়ুন: ৪৫০ টাকায় রান্নার গ্যাস, লক্ষ-লক্ষ সরকারি চাকরি! লোকসভা ভোটের আগে ঢালাও প্রতিশ্রুতি শুভেন্দুর]
এবার ২০২৪-এর লোকসভা ভোটেও প্রধান মুখ, প্রধান ব্র্যান্ড ইকুইটি নরেন্দ্র মোদি। বিজেপির প্রধান পণ্য। ২০১৪ সালের জনপ্রিয়তা আজ না-ও থাকতে পারে, কিন্তু এখনও দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা। আর বিজেপি, তার সোশ্যাল মিডিয়া ও আইটি টিম জানে– কীভাবে এই জনপ্রিয়তাকে নব-নব অ্যাড্রিনালিন দিয়ে বঁাচিয়ে রাখা যায়। অখণ্ড ভারতের অপ্রতিহত নেতার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির নিরন্তর বিপণন! যেমন, রেলমন্ত্রক দেশের প্রতিটি ছোট-বড় প্ল্যাটফর্মে মোদির কাটআউট বসিয়ে সেলফি সেন্টার নির্মাণ করা হয়েছে, যাতে মানুষ মোদির সঙ্গে সেলফি তুলতে পারে।
২০২৪ সালে এহেন মোদি গ্যারান্টির প্যাকেজে আছে এক নতুন হিন্দু ভারত নির্মাণের অালেখ্য। আসলে এ আলেখ্য নতুন নয়। আরএসএস (১৯২৫), জনসংঘ (১৯৫১) এবং বিজেপি (১৯৮০)-র পুরনো অ্যাজেন্ডা ছিল রামমন্দির নির্মাণ, কাশ্মীরে ৩৭০ ধারার অবলুপ্তি, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি। বাজপেয়ী-অাদবানি যুগে জোট সরকার থাকার সময় থেকেই এই তিনটি কোর ইসু্যকে ম্যারিনেট করে কোল্ড স্টোরেজে তুলে রাখা হয়েছিল। আদবানি এদেশে হিন্দু জাতীয়তাবাদের যে থিওরেটিক্যাল ক্লাস শুরু করেন, মোদি-শাহ তঁারই প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস নিচ্ছেন ২০১৪ থেকে। সংখ্যাগরিষ্ঠতার গণতন্ত্র, নেহরুর কমপ্যাশনেট গণতন্ত্র থেকে মাসকিউলার গণতন্ত্র।
তবে এ গণতন্ত্রের প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য, এই দেশপ্রেমী অাখ্যান ১৪০ কোটি মানুষের স্বার্থেই বিরচিত। অযোধ্যায় ৭০ একর জমির উপর তৈরি ১৬১ ফুট উঁচু রামলালার মন্দিরের ২২ জানুয়ারি প্রাণ প্রতিষ্ঠা। সরকারি সমর্থনে ও সাধুদের ট্রাস্টের উদে্যাগে একটি ধর্মীয় তথা রাষ্ট্রীয় ইভেন্টের সাক্ষী থাকতে চলেছে গোটা দেশ। অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিতদের তালিকায় আছেন অমিতাভ বচ্চন, শচীন তেন্ডুলকর-সহ দেশের বহু বিরোধী নেতাও। রামলালা-মন্দিরে প্রাণ প্রতিষ্ঠার আগে গোটা দেশের নানা রাজ্য, নানা প্রান্ত থেকে নানা উপকরণ আসছে– ১০৮ ফুট লম্বা ধূপকাটি অথবা সেগুন কাঠের দরজা। গর্ভগৃহে ৫১ ইঞ্চি রামলালা মূর্তির হাতের ধনুক। ধনুকধারী মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রীরামচন্দ্র যেন জীবন্ত হয়ে উঠবেন!
পৌষ মাসের শুক্ল পূর্ণিমার দিন রামায়ণ পাঠ হবে দেশের সব মন্দিরে সন্ধ্যায় জ্বালানো হবে প্রদীপ। এ হল ধার্মিক রাষ্ট্র নির্মাণের আখ্যান– যেখানে ধর্মীয় নেতারা দেশের সামাজিক আবহে যুক্ত করছেন হিন্দুত্ববাদী সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদ। একইভাবে কাশ্মীরে ৩৭০ ধারার উচ্ছেদ। সুপ্রিম কোর্টে তার ঐতিহাসিক অনুমোদন। এমন ধারণা হচ্ছে, ভারতের শীর্ষ আদালতও ধার্মিক রাষ্ট্রদর্শনকে মেনে নিচ্ছে। কাশ্মীরে এখনও পাক-মদতপুষ্ট জঙ্গি সন্ত্রাস চলছে। কাশ্মীরি বিচ্ছিন্নতাও সতি্য। ভারত সরকারও ইজরায়েল সরকারের ধঁাচে ফের সার্জিকাল স্ট্রাইকের জন্য প্রস্তুত।
আর হিন্দু-মুসলমান মেরুকরণ? মুসলিম বিচ্ছিন্নতা? ‘সিএএ’? মুসলিম অনুপ্রবেশকারী আর হিন্দু শরণার্থী বিভাজন? এ-ও নতুন আলেখ্য নয়, কিন্তু মোদি শুধু ১৪০ কোটি মানুষের সামনে নয়, দুনিয়ার সামনে নিজেকে ‘বিশ্বগুরু’ হিসাবে সুপ্রতিষ্ঠিত করছেন। এ-ও হল ভারতীয় রাজনীতির এক অসাধারণ বিপণন।
ভাবসাব এমন– যেন কেউ মুসলমান হলেও কোনও অসুবিধা নেই, কিন্তু কেউ বিরোধিতা করলে সে ঈর্ষাকাতর, ‘প্রকৃত দেশপ্রেমী’ নয়। ঠিক যেভাবে তিন তালাক রদের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছে জনগণ, সেভাবেই ‘মোদির ভারতীয় প্রজা’ হতে গেলে ‘হিন্দু ভারত’-কে মেনে নেওয়াই কাম্য। তাহলে ল্যাঠা চুকে যায়। হিটলার যেমন বিশ্বাস করতেন আর্যরা আদতে আর কেউ নয় বিশুদ্ধ রক্তবাহী জার্মানদেরই আদিপুরুষ, অর্থাৎ ‘আর্য’ শব্দ ও ‘জার্মান’ শব্দ পরস্পর সমার্থক, ঠিক তেমনই ভারত ভূ এবং নৃতাত্ত্বিকভাবে আদতে হিন্দুদেরই। কেউ মুসলমান বা অন্য ধর্মের হলেও ধর্মান্তরিত, কারণ জন্মসূত্রে সে প্রাথমিকভাবে হিন্দু রক্তবাহী-ই। তাহলে ‘হিন্দু ভারত’কে মেনে নিতে আর সমস্যা কোথায়?
রোমিলা থাপারের মতো মার্কসবাদী ঐতিহাসিক বা অমর্ত্য সেনের মতো নোবেলজয়ী তাত্ত্বিক বা আকবর-ভক্তরা ঐক্যর চেয়ে বৈচিত্রকে গুরুত্ব দেন বেশি। আমজনতা মোদির বিজেপি ঐকে্য জোর দেয়। যেন দেশবাসীর প্রথম পরিচয় হিন্দু ভারতীয়, তারপর তারা মুসলমান-খ্রিস্টান-জৈন-বৌদ্ধ। এই ভারত নির্মাণ সম্ভব হলে ভারতের উন্নয়নও সম্ভব। ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটের প্রচারে মোদির এই কঠোর অাখ্যানের বিরুদ্ধে বিরোধীদের অাখ্যান কোথায়? রাজে্য রাজে্য বেশ কিছু আঞ্চলিক দল মোদি-বিরোধী আওয়াজ তুলতে সচেষ্ট। বামপন্থী এবং সচেতন ধর্মনিরপেক্ষ বহুত্ববাদী এই মোদি অাখ্যানের অসহিষ্ণুতার কথা বলছেন। আর্থিক সাম্য-বেকারত্ব-কর্মহীনতা, উন্নয়নের মিথে্য ফানুসের কথা তুলে ধরার চেষ্টা করছেন। কিন্তু তাদের কণ্ঠস্বরে কোরাস কোথায়? বড় দুর্বল খণ্ড-বিখণ্ড বিরোধী আখ্যান। বরং মোদি-বিশেষজ্ঞরা রিজার্ভ ব্যাঙ্কের বৃদ্ধি-পরিসংখ্যান, শেয়ার মার্কেটের প্রবল উচ্ছ্বাস দেখিয়ে প্রচার চালাচ্ছেন, ‘মোদি হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়’।
দেশে একমাত্র পশ্চিমবঙ্গ মমতা বন্দে্যাপাধ্যায় এই প্রবল প্রতিকূল পরিস্থিতির মধে্যও বাঙালির প্রাণসত্ত্বাকে প্রতিনিয়ত প্রতিষ্ঠিত করে চলেছেন। তামিলনাড়ুতে স্ট্যালিনও করছেন, কিন্তু সেখানে বিজেপি নেই। রাহুল গান্ধী আবার ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’ শুরু করছেন, কিন্তু বিজেপি ও আরএসএসের দেশজোড়া সাংগঠনিক শক্তি, অর্থবল, মিডিয়া সমর্থন, রণকৌশলের তুলনায় কংগ্রেস এখন অনেক দুর্বল। লোকসভা ভোটের বাকি মাত্র চার মাস। বিধানসভা ভোটের বিপর্যয়ের ক্ষত এখনও তাজা। তাই বড় অসম এ লড়াই। তবু এ দুর্যোগে হতাশাবাদী হব না। রবীন্দ্রনাথ ভেবেছিলেন, বাঙালির সাধনা ভারতে মুক্তি পাবে। এ-ই ছিল তঁার আশা। মনে হচ্ছে, রবীন্দ্রনাথের মহাজাতি চিন্তা ভারতবাসীর এখন বড় প্রয়োজন।